জীবনের প্রথম ইন্টারভিউতে সফল হওয়ায় বাড়িতে একটি উৎসবের আবহ তৈরী হয়েছিল । মায়ের একটি খাসি মোরগ ছিল । দুবছরের উপরে বয়স । বেশ মোটাসোটা হওয়ার কারনে থপ থপ করে হাঁটতো । আমার বোন ওকে আমাদের আরেকটি ভাই বলে ডাকতো । নাম দিয়েছিল 'সর্দার '। সর্দারের হাঁটা চলাচল সত্যিই সর্দারের মতন । সারাক্ষণ রান্নাঘরের আশেপাশে থাকতো । ওর ভয়ে পাড়ার একটি বিড়ালও এবাড়িতে আসতো না । যদিও কদাচিৎ আসে, এমন করে ঘাড়ের পালক উঁচু করে কো কো করতে করতে ছুটে যেতো যে ভয়ে আর কেউ ত্রিসীমানায় ঘেষতে সাহস পেতোনা । সেদিন সর্দারকে জবাই করার জন্য মা প্রস্তাব দিতেই, বাবা সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিয়ে দিলেন । আমার আপত্তি ধোপে টিকল না । খাওয়ার সময় কাউকে সেটি বুঝতে দিলাম না যে সর্দারকে জবাই করার জন্য আমি কতটা ব্যাথা পেয়েছি । বোনের অবশ্য চোখেমুখে কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না । ও দিব্বি বহুদিন পরে খাসিমোরগের মাংস মহানন্দেই খেয়ে নিল । রাতে মা ঢেঁকিছাটা চালের পাটিসাপটা ও সরু পিঠে করলেন । এবারও আমি মাকে এসব করতে বারণ করে ব্যর্থ হলাম । বাড়িতে উৎসবকালীন মেজাজের সমারোহ যতটা চোখে পড়ছে ততটাই আমার অন্তরে গুরু গুরু করছে বেসরকারি মিশন স্কুলের কম বেতনে চাকরী করার যন্ত্রণা। তবে জন্মাবধি অভাব- দারিদ্র্য যেখানে নিত্যসঙ্গী সেখানে এই মেকি সোনার হরিণ পাওয়ার আনন্দকে মাটি না করতে আমিও মা- বাবাকে বেতন নিয়ে কিছু বলতে সঙ্কোচ বোধকরলাম।
আমার চাকরী পাওয়াতে আমার প্রতিবেশীদের চোখে - মুখের ভাষাও বদলে গেল । বদলে গেল গ্রামের বন্ধুদের আচরণও । সবচেয়ে মজার লেগেছিল বাড়ি ফেরার পরেরদিন সকালে পূর্বের ন্যায় ব্রাশ করতে করতে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, এমনসময় পাড়ার মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে প্রতিবেশী মারুফচাচার নেতৃত্বে সাত - আটজন মুরুব্বিগোছের লোকের আমার সঙ্গে দেখা করতে আসাটা । আমার বাবার চেয়ে বয়সে সামান্য ছোটো চাচাজি আমাকে এতদিন পর্যন্ত খুব নিরসভাবে 'খোকা 'বা 'তুই 'বলে সম্বোধন করে এলেও আজ হঠাৎ ওনার আপনি বলাতে ক্ষনিকের জন্য মাথাটা যেন ঘুরে গেল । ধাতস্থ হয়ে আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আপত্তি করলাম । বিনিময়ে চাচাজি বললেন,
-আপনি আমাদের গ্রামের গর্ব । আপনার বাবা ছিলেন শিক্ষক । আবার আপনিও হলেন শিক্ষক । এইজন্য কথায় বলে, মাস্টারের ছেলে মাস্টার হয় আর চাষার ব্যাটা চাষা ।
- চাচাজি ! দয়াকরে আপনি আমাকে তুই বা তুমি বলুন, যেমন আগে বলতেন । আমি প্রচন্ড অস্বস্তিবোধ করছি ।
- না না, বাবা ! আমরা আগে এর তার কথা শুনে আপনার বাবার সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছি । প্রতিহিংসায় জড়িয়েছি । আপনাদের বাড়ির বর্ষার পানি বার হতে দিইনি । সমবায়ের কিস্তি বাকি পড়তেই আপনাদের গাই গরু তুলে নিয়ে গেছি । বিচুলি গাদায় আগুন দিয়েছি । আপনার বাবাকে গ্রামের স্কুল থেকে তাড়িয়েছি । তবুও আপনাদের লেখাপড়া বন্ধ করাতে পারিনি । উল্টে আমাদের ছেলেপুলের লেখাপড়া হলোনা , আর আপনারা ভাই- বোন দুজনেই শিক্ষিত হয়ে মাস্টার হয়েগেলেন । আমি নিজে হাই সুগারে ভুগছি,সঙ্গে থাইরয়েড ও হাঁপানিতে জেরবার । কমবয়সের কৃতকর্মের জন্য এখন নামাজের পাটিতে বসে আল্লাহপাকের কাছে ক্ষমা চাই । জানিনা উনি আমার আবেদনে সাড়া দেবেন কিনা । কিন্তু সারাক্ষণ যে এ অপরাধ বয়ে বেড়াচ্ছি বাবা।
- না চাচাজি!আপনি কোনও অন্যায় করেন নি । গ্রামে ছোটো থেকে আমরা কিছু বাঁধা পেয়েছি ঠিকই, তবে সেটা আমাদের কপালে ছিল বলে হয়েছে । আর তাছাড়া আপনি একাতো আর করেননি । সেখানে আপনার একার অবদানই বা কতটুকু ।
- আহা! বাপ আমার । এই না হলে মাস্টারের ছেলে । আমরা বুঝতে পারিনি যে মাস্টারভাই কত বড় মনের মানুষ । আপনি যথার্থই বাবার সন্তান । এমন চিন্তা যে বাপ- মা গুনেই হয় ।
উপস্থিত বাকিরা অবশ্য 'তুমি 'বলে সম্বোধন করে আমার স্কুলের খোঁজখবর নিলেন । এতক্ষণে আমার বাবাও বেড়িয়ে এলেন ।
- আরে ! মারুফসাহেব যে!
- হ্যাঁ মাস্টারভাই! বাবু মাস্টারি চাকরী পেয়েছে শুনে মসজিদ থেকে ওনারা এসছেন দেখা করতে ।
- বেশ!খুব ভালো কথা। তবে বাইরে কেন? সবাই ভিতরে এসো।
আমার বাবার কথায় সাড়া দিয়ে চাচাজিরা সকলে ভিতরে চলে এলেন । মা তখন বাড়ির ভিতরে কি একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। একসঙ্গে এতজনকে আসতে দেখে মুখে ঘোমটা টেনে তাড়াতাড়ি আড়ালে চলে গেলেন । চাচাজিদের বাবার সঙ্গে গল্প করতে বসিয়ে আমি গেলাম রান্নাঘরে মাকে কিছু টিফিন করার কথা বলতে । গিয়ে দেখি মাও ততক্ষণে রেডি। ছেলের চাকরী পাওয়ার আনন্দে এতজনকে আপ্যায়ন করার সুযোগ পেয়ে মায়ের মুখে একটা প্রশান্তি ঝড়ে পড়লো ।
- তোর বাবাকে গিয়ে বল এখান থেকে টিফিন না খেয়ে যেন কেউ না যায় ।
আমি বাধ্যছেলের মত মায়ের নির্দেশ পালন করলাম। আর মনেমনে ভাবলাম, হায়রে ! আমি কি এমন চাকরী পেয়েছি ; সেটি যদি বোঝাতে পারতাম ।
দুদিন বাড়িতে বেশ ধুমধাম করে কাটিয়ে তৃতীয়দিন খুব সকালে বাবা - মায়ের পায়ে হাতদিয়ে ছালাম করে জীবনের প্রথম কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম । শেষ মুহূর্তে মাকে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে আমারও ভিতরটা আদ্র হয়ে গেল । পড়াশোনা কালীন হোস্টেলে আসার সময়ে মাকে কোনওদিন এভাবে কাঁদতে দেখিনি । কিন্তু আজ মায়ের এমন কান্না দেখে গোটা রাস্তাতে বারবার মায়ের মুখোচ্ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল । প্রথমদিন বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে যাওয়ার আনন্দ আর আজ একা যাওয়ার নিঃসঙ্গতা ও মায়ের মুখোচ্ছবি - সবমিলিয়ে এক প্রচন্ড বিষন্নতা সেদিন আমার সাথী হয়েছিল ।
বাড়ি থেকে হাওড়া পর্যন্ত বেশ ভিড়ভাড়টা থাকলেও সকালে মেদিনীপুর লোকাল একেবারে ফাঁকা পেলাম । জানলার ধারে একটি সিটও পেয়ে গেলাম । প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ বাইরের প্রকৃতি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হওয়াই একটা সময় ঝিমুনি চলে এলো । কখনযে ঘুমিয়ে গেছিলাম খেয়াল নেই । আচমকা পাশের এক জনের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম ইয়া পদ্মজা নাইডু চেহারার এক মোটু মহিলা আমার দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।এমন নয় যে আমি বেশকিছু জায়গা দখল করে ঘুমাচ্ছিলাম, কিন্তু ওনার বোধহয় ধারনা সেরকম হয়েছিল । আমি বেশ আড়ষ্ট হয়ে আরও জানলার দিকে সরে যেতেই জিজ্ঞেস করলেন ,
- কোথায় নামবে তুমি?
- আজ্ঞে, মেদিনীপুর।
- একেবারে শেষে? আমার প্রচন্ড গরম লাগে, ভাবছিলাম যদি জানালার ধারে একটু বসতে পারতুম।
ওনার ধাক্কা দেওয়ার প্রকৃতিতে ওনার কথার আর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ না করে আমি ইচ্ছা করে ঘুমের ভান করে থাকলাম । কিছুক্ষন পরে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। তবুও রাস্তা যেন শেষ আর হচ্ছিল না। ট্রেন চলছে তো চলছেই। ইন্টারভিউ এর দিন সকলে মিলে একসঙ্গে যাওয়ার কারনে কীভাবে যে সময় শেষ হয়েছিল বুঝতে পারিনি । কিন্তু আজ যেন সময় কাটতেই চাইছিল না ।
অবশেষে এগারোটার একটু পরে আমি স্কুলে পৌঁছেছিলাম । আগে থেকে জয়নিং লেটার রেডি করা ছিল । অফিসে জমা দিতেই, হাজিরা খাতার একেবারে শেষে আমার নাম লিখে দেওয়া হল । যথাস্থানে আগে থেকে সিলেক্ট করা যুতসই ইনিশিয়ালটি দিয়ে স্টাফরুমে চলে গেলাম । ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক মহাশয়ের সঙ্গে প্রথমদিন পরিচয় হয়েছিল। আজ উনি আমাকে উপস্থিত বাকিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে ক্লাসরুমে ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় করাতে নিয়ে গেলেন । উল্লেখ্য স্টাফরুমে প্রথমদিনের পরিচয় পর্বে সহকর্মী কারো নাম মনে রাখতে পারিনি । পরে একে অপরের নাম ধরে দাদা বলে ডাকাতে আমার খুব সুবিধা হয়েছিল । কয়েকজন ছিলেন আমারই সঙ্গে ইন্টারভিউ দিয়ে আগত । কয়েকদিনের মধ্যে সমবয়সীদের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল ।
আগেই বলেছি স্কুলটি কো - য়েড মিশন স্কুল । কিচেনরুম সংলগ্ন ডাইনিং রুমের একদিকে ছেলেদের হোস্টেল ও ক্লাসরুম। আর কিচেনরুমের ঠিক উল্টোদিকে মেয়েদের হোস্টেল ও ক্লাসরুম । ডাইনিং রুমটি ছিল যেন মিলনমেলা । খাওয়ার সময় দেখতাম পুরানো শিক্ষকদের সঙ্গে দিদিমনিদের হেসেহেসে কথা বলা, গল্প বা আড্ডা চলতো সমানে । অন্যদিকে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছাত্র- ছাত্রীরাও নানান কৌতুকে মেতে উঠতো । এরকম স্থানে আড্ডার ছলে গায়ে হাত দেওয়ার সুযোগ ও উপভোগ তাদের অভিব্যক্তিতে প্রকাশ ঘটতো । এসবনিয়ে কোনও শিক্ষক - শিক্ষিকাকে কোনওদিন বকাঝোকা করতে দেখিনি । মাসিরা মাঝে মাঝে একটু আধটু বকা দিলেও, কে শোনে কার কথা । যেকারনে বেশকিছু দিন এখানে থেকে খাওয়ার সময়ের পরিবেশটি আমার বেশ অস্বস্তি লাগতো । ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন দিদিমণির সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছিল আমার। টুকটাক কথাবার্তা হত। কিন্তু ঐ পর্যন্তই । অন্যরা যেখানে ধীরে সুস্থে আয়েশ করে খেতে ত্রিশ/ চল্লিশ মিনিট সময় লাগাতো আর আমি সেখানে ঝড়ের মত দ্রুত খেয়ে বড়জোর মিনিট পনেরোর মধ্যে খাওয়া শেষ করে চলে আসতাম ।
সম্ভবত দিন পনেরো পরে ডিনারে সিনিয়র মজ্ঞুশ্রী দিদিমণির সঙ্গে দেখা হয়ে কুশল বিনিময়ের সময় পাশে অপরিচিত আরেকজন দিদিমণির দিকে তাকাতেই, চোখের ঈশারায় জিজ্ঞেস করলেন,
-চৌধুরীভাই ওর সঙ্গে পরিচয় আছে?
- না, ওনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ওঠেনি ।
-শেফালি বিশ্বাস। ইংরেজির দিদিমণি ।
আমি দাঁড়িয়ে উঠে নমস্কার করাতে উনিও প্রতিনমস্কার করে মুখে কিছু বললেন না, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের চোখাচোখিতে আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ এর তরঙ্গ বয়ে গেল । আমিও মুখে কিছু বলতে পারলাম না । চোখ নামিয়ে জায়গায় বসে পড়লাম । টেবিলে রাখা জলের পাত্রটি তুলে দুঢোক জল খেয়ে আবার জায়গায় বসতে না বসতে আমার খাবার চলে এল । দুই দিদিমণি বেশ কিছুটা দূরে একটা ফাঁকা টেবিল লাগোয়া চেয়ারে বসলেন । সেদিন ডাইনিংরুমের মুহূর্তটা ছিল এই কদিনে স্কুলে আমার সেরা অনুভূতি । খাওয়া শেষ করে ওনাদেরকে সৌজন্যসূচক আসি বলতেই দুজনেই মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন ।
( চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৯ সকাল ১০:২৩