নিজের ঘরে শান্তিমতো ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার ঘরটা ছোট। গোছানো, কেমন স্নিগ্ধ একটা ভাব আছে। রাত বোধহয় তিনটার মতো বাজে। হঠাৎ ঘরটা শীতল হতে শুরু করে। সামারে কাঁথা পাবো কোথায় ! কিছুটা বিরক্তবোধ করি, কিছুটা আশ্চর্য হই। কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকি সাপের মতো। ঘুম ভেঙ্গেছে খানিকক্ষণ হলো। বোধহয় তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায়।
আব্বা আম্মা বাসায় নাই। কাছের আত্মীয় অসুস্থ। তাকে দেখতে গিয়ে দেরি হয়ে যাওয়ায় সেখানেই থেকে গেছে। বাসায় যে আমি একা, মনে পড়ে যাওয়ায় কিছুটা অস্বস্তিবোধ করি। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি সেটাতে চার্জ নাই। গভীর রাত পর্যন্ত অহনার সাথে দুষ্টুমিষ্ট কথা হয়েছে। মেয়েটাও যেন কেমন! মুখে কিছু বলতে বাধেনা ! আমারই কান টান গরম হয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো।
বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খাবো কিনা ভাবছি, এমন সময় রাস্তা থেকে না চেনা কিছু আওয়াজ আসছিলো। ডাইনিং পর্যন্ত যাবার পর সেটা স্পষ্ট কানে আসতে থাকে। আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তায় তাকিয়ে দেখি শত শত সাদা পাঞ্জাবি পড়া মানুষ চারজনের দল করে একেকটা কফিন নিয়ে যাচ্ছে। তারা কোনোদিকে তাকাচ্ছেনা। চাঁদের আলোয় পুরো বিষয়টাকে অপার্থিব, অবাস্তব মনে হচ্ছিলো।
কিছুক্ষণ এই দৃশ্য দেখে অসুস্থবোধ করতে থাকি। বাথরুমে গিয়ে ভালো করে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে আসি। পুরো বাড়ি এখনো আজগুবি ধরণের শীতল হয়ে আছে। ঘরে লুকিয়ে রাখা ভ্যাট সিক্সটিনাইনের বোতল থেকে বুদ্ধি করে কয়েক চুমুক মাধুকরী তরল খাই। কিছুটা সুস্থবোধ করতে থাকি। ডাইনিং রুম হয়ে কিচেনে যাবার জন্য পা বাড়াতেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার যোগাড় হলো।
পনেরো ষোলটার মতো মুরগি ডাইনিং টেবিলে দাঁড়িয়ে আছে। বিষয়টা যে কি ভীষণ অস্বাভাবিক বলে বোঝাতে পারবোনা। তারা নড়াচড়া করছেনা। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। আমি ছোটবেলার ধর্ম বইতে পড়েছিলাম কিছু সুরা মনে করার চেষ্টা করতে থাকি। একবার মনে হলো, দৌড়ে ছুটে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই।
আব্বা আম্মা বাসার দায়িত্ব দিয়ে গেছে, তাই বা করি কি করে ! তরকারি কাটার ছুরি নিয়ে কিচেন থেকে বের হই। না, টেবিলে সেই মুরগিগুলো আর নাই। নিজের উপর বিশ্বাস ফিরে আসতে থাকে। ডাইনিং পেরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি, প্রকান্ড একটা শয়তানের মুখোশ পূর্ব দিকে দেয়ালে লেপ্টে আছে। সেটা জীবন্ত এবং আমাকে ঢুকতে দেখেই আশ্চর্য শান্ত গলায় নিজের পরিচয় দিলো, "আমি তোর মৃত্যু। আমাকে ভয় পাবার কিছু নাই।"
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। মরণের আগে বীভৎস দেখতে এই জীবন্ত মুখোশ আমাকে কয়েক ঢোক পানি খেতে দিবে কিনা কে জানে ! বোধহয় আমার মনের কথা জিজ্ঞেস করে সে বললো, "শেষবারের মতো সামান্য মদ খেয়ে নিতে পারিস। তোর আত্মাকে নিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিবো। পথে ভালোমন্দ খেতে পাবিনা।" এই পর্যায়ে আমার মনে হলো আমি সত্য সত্য স্বপ্ন দেখছি। জোরে একটা গগনবিদারি চিৎকার দেবার পর আমার আর কিছু মনে নাই।
পরের দিন দুপুর বারোটার দিকে আব্বা আম্মা প্রতিবেশীদের সাহায্য নিয়ে দরজা ভাঙে। আমার ঘরে তখন প্রবেশ করেছে বাঁধভাঙ্গা সূর্যের আলো। আত্মা ছাড়া আমার নিথর শরীরটা পড়ে আছে। মুখে রাজ্যের আতঙ্ক, হতাশা অবিশ্বাস। আমি বোধহয় আর কিছুদিন বাঁচতে চেয়েছিলাম। অবশ্য কে না চায় ! আম্মার কোলে তারপর আমার প্রাণহীন শরীরটা শুয়ে ছিলো। বহুদূর থেকে আত্মা হয়ে উড়ে চলবার কারণে জন্মদাত্রীকে বলতে পারছিলাম না, কতো বিচিত্র বিস্ময় দেখে চলেছি। আরো কতো বিচিত্র বিস্ময় সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১৬ সকাল ১০:০৪