গত শুক্রবারই বান্দরবানের দামতুয়া ঘুরে এসেছিলাম । এই সপ্তাহেও আবার যাবো ভাবি নি । কিন্তু যখন সময় সুযোগ চলে আসে তখন আর নিজেদের দুরে রাখা খানিকটা কষ্টকর হয়ে পড়ে । তাই এই বৃহস্পতিবারও বের হয়ে পড়লাম বান্দরবানের পথে । এবারের আমাদের লক্ষ্য বান্দরবানের তিনাপ সাইতার জলপ্রপাত ! তিনাপ সাইতার শব্দটা বম শব্দ । বম ভাষার তিনাপ অর্থ হচ্ছে নাকের সর্দি আর সাইতার শব্দের অর্থ হচ্ছে জলপ্রপাত বা ঝর্ণা । এই জলপ্রপাত টি পাইন্দু খালের ভেতরে অবস্থিত । পানি প্রবাহের পরিমানের দিক দিয়ে তিনাপ সাইতার বাংলাদেশের সব থেকে বড় জলপ্রপাত !
তিনাপ সাইতার ভ্রমন আগে বেশ কষ্ট সাধ্য ছিল । রোয়াংছড়ি উপজেলা দিয়ে যেতে হত তখন । সব মিলিয়ে পাহাড়ি পথে মোটামুটি ২৭ কিলো মিটার হাটতে হত । তিন চার দিনেও কষ্টকর হয়ে পড়ে ট পড়ে যতটা সহজ মনে হচ্ছে বাস্তবে এখানে যাওয়াটা ছিল তার থেকেও কষ্টকর । যারা কোন পাহাড়ে ট্রেকিং করেন নি তাদের ব্যাপারটা কোন দিন কল্পনাতেও আসবে না ! বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে কল্পনাও করা সম্ভব না । তখন এটাই ছিল একমাত্র পথ । তবে আরেকটা পথে যাওয়া যায় ! এখন এই পথটা অনেকটাই সহজ। এখন মানুষ রোয়াংছড়ি দিয়ে না গিয়ে যায় রুমা উপজেলা দিয়ে । এখানে মাত্র দুই ঘন্টার সহজ ট্রেকিং ।
আমাদের প্লানও ছিল একদিনেই আমরা তিনাপ দেখে ফিরে আসবো । কিন্তু সমস্যা হয়ে দাড়ালো বাংলাদেশ আর্মি ! রুমা উপজেলা দিয়ে এখানে যাওয়ার অনুমতি নেই । আমাদের যেতে হবে পালিয়ে আর্মির চোখ এড়িয়ে । কিন্তু প্রথমদিন আমরা যেতে পারলাম না । আর্মি থেকে আমাদের বাধ্যতামূলক ভাবে গাইড ধরিয়ে দেওয়া হল । এই গাইড আমাদের কোন ভাবেই তিনাপে নিয়ে যাবে না । বাধ্য হয়ে আমাদের ট্যুরের পরিধি বাড়াতে হল । শুক্রবারটা আমরা রয়ে গেলাম রুমা বাজারে । রুমা বাজারের কাছেই সাঙ্গু নদীর কাছেই রয়েছে রিঝুক ঝর্ণা । সময় যখন আছে তখন আমরা চললাম সেই ঝর্ণা দেখতে । দুইটা ট্রলার ভাড়া করা হল । ভট ভট করে এগিয়ে চলল আমাদের ট্রলার।
ট্রলার থেকে তোলা ছবি
রিঝুক ঝর্ণার ছবি
অন্য দিক থেকে তোলা আরেকটা ছবি
অনেকেই এখানে নেমে গোসল করলো । আমি নৌকাতেই বসে বসে দেখতে লাগলাম ঝর্ণাটা । বেশ কিছু সময় পরে আমরা আবার ফিরে এলাম রুমা বাজারে । এখানেই আমাদের কটেজ নেওয়া হয়েছে । রাতটা এখানেই থাকতে হবে আজকে আমাদের । এরপরই শুরু হল বৃষ্টি । গোসলটা বৃষ্টিতেই সেরে নিলাম । বড় অদ্ভুত লাগলো । ট্রেকিংয়ের সময় প্রায়ই আমরা বৃষ্টিতে ভিজেছি । কিন্তু এভাবে আলাবে এই বান্দরবানে বৃষ্টিতে কোন দিন গোসল করবো ভাবি নি ।
ব্যালকোনি থেকে তোলা সাঙ্গু নদী আর বৃষ্টির কম্বিনেশনে একটা ছবি ।
আমি বলতে গেলে পুরোটা সময় এই ব্যালকনিতেই বসে ছিলাম । সত্যি বলতে, কী এক মোহ যে ছিল সামনের ছবিতে সেটা আমার জানা নেই । কেবল মনে হচ্ছিলো যে এই দিকে তাকিয়ে থাকি । এই তাকিয়ে থাকার কোন শেষ নেই ।
পরদিন খুব ভোরে উঠেই আমরা রওয়ানা দিয়ে দিলাম আততা পাড়ার দিকে । সকালে রওয়ানা দেওয়ার কারণ হচ্ছে যে যত সকাল হবে মানুষজন উঠে পড়বে । আর তখন আর্মি ক্যাম্পে খবর চলে যেতে পারে । ফলস্বরূপ আমাদের তিনাপ না দেখেই ফিরে যেতে হবে ।
আমাদের জন্য বাইক রেডি করাই ছিল । আমরা বাইকে চেপে বসলাম । উচু পাহাড়ি পথে ছুটে চলল বাইক । পাহাড়ি রাস্তায় সব ময় চাঁদের গাড়িতে করেই যাওয়া আসা করেছি । তবে এই রাস্তায় চাঁদের গাড়ি বেশ বিপদজনক । সেটা টের পেলাম বাইকে চড়তে গিয়েই । আপনি সমতলের যত দক্ষ বাইকারই হৌউন না কেন আপনি এই রাস্তা বাইক চালাতে পারবে ন না । এখানকার স্থানীয়রা দীর্ঘদিন বাইক চালিয়ে হাত পাঁকিয়েছে ।
আততা পাড়ার যেতে বেশি সময় লাগলো না । তবে সেখানে বাঁধ সাধলো পাড়া প্রধান । আমাদের যেতে দিবে না । কারণ আর্মি কাছে খবর চলে গেলে আর্মি এসে গ্রাম প্রধানকে ধরবে । তবে আমাদের টিম লিডার বেশ করিৎকর্মা মানুষ । সে কিভাবে কিভাবে জানি পাড়া প্রধানকে রাজি করিয়ে ফেলল । তবে তিনি আমাদের সাথে গ্রাম থেকে আরও দুইজন গাইড দিয়ে দিলেন । আমরা সাথে করে আলাদা ভাবে দুইজন গাইড নিয়ে এসেছিলাম । এখানে যোগ হল আরও দুইজন । আমাদের যাত্রা শুরু হল !
আততা পাড়ায় তোলা দুইতা জবা ফুল । জবা ফুল দেখেই জলদস্যু ভাইয়ের কথা মনে পড়লো । ভাবলাম ছবি তুলে নিয়ে যাই ।
আমরা হাটা শুরু করে দিলাম । আমার বান্দরবানের এই পাহাড়ে হাটাহাটিই সব থেকে বেশি পছন্দ । এটা আমি খুব বেশি উপভোগ করি । চলতি পথে দুটি ছবি ।
ঘন্টা খানেক হাটার পরেই আমরা চলে এলাম পাইন্দু খালে । তিনাপ সাইতারকে অনেকে পাইন্দু সাইতারও বলে । এই খালের পানিই মূলত তিনাপের পানির মূল প্রবাহ
নাম না জানা ছোট একটা ঝিরি বের হয়ে পাহাড়ের দেওয়াল থেকে
এরপরে আমরা এই খালের পাশ দিয়ে আবার কখনও খালের ভেতরে হাটতে শুরু করলাম ।পুরো যাত্রার এই হাটাটুকু সব থেকে মজার আর আনন্দময় । পানি পাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুভূতি সত্যিই চমৎকার । এটা আসলে যে কোন দিন হাটে নি সে কোন দিন বুঝবে না । আরও ঘন্টাখানের ভেতরে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌছে গেলাম । মূলত নিচের ছবিতা হচ্ছে প্রপাতের শুরু ।
আরেকটি ছবি
এরপরের পথটা একটু ঝুকিপূর্নি । একেবারে খাড়া একটা পাহাড়ে বেয়ে নিচে নামতে হয়েছে আমাদের সবার । গাইডদের সার্বক্ষনিক সহযোগিতায় সেটা আমরা পার হয়ে এলাম সহজেই । তারপরেই নেমে এলাম মূল জলপ্রপাতের নিচে !
আসলে ছবি দেখে কোন ভাবেই এই তিনাপের বিশালতা টের পাওয়ার কোন উপায় নেই । কাছ থেকে দেখলে টের পাওয়া যায় । আমি যতবার এই রকম বিশাল কিছুর সামনে গিয়ে হাজির হই তত বার আসলে টের পাই যে প্রকৃতির কাছে আমি কতখানি ক্ষুদ্র !
এখানে ইচ্ছে মত সময় কাটিয়ে আমরা আবারও ফিরে চললাম আততা পাড়ার দিকে । ঘন্টা দুয়েকের ভেতরেই পৌছে গেলাম । সেখানে পাড়ায় বসে পাঁকা পেপে খেলাম এতো বড় সাইজ আর মিষ্টি ঢাকায় এই জিনিসের ডাম কম করে হলেও তিন চার শ টাকা হবে ! আমরা কিনলাম মাত্র ৫০ টাকা দিয়ে ! তারপর আবারও বাইকে করে রুমায় চলে এলাম । সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে চাঁদের গাড়িতে করে বান্দরবান শহরে । রাতে ঢাকা পথে রওয়ানা দিলাম !
প্রতিবারই যখন কোন ট্যুর থেকে ঢাকা আসি মনের ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি এসে জড় হয় । এই অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা আমার জানা নেই ! এই অনুভূতি আমাকে বেশ কিছুদিন আচ্ছন্ন করে রাখে ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:৫৩