সীমা আর আসিফ পিঠা-পিঠি ভাই বোন। সীমার বয়স নয় আর আসিফের এগার। সীমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট তাদের আরেকটা ভাই হয়েছে। এই পিচ্চিটার নাম রাকিব। ওদের মা খুব দুষ্টু প্রকৃতির মহিলা। ছেলে মেয়েদের সাথে মাঝে মাঝেই তিনি খুব দুষ্টামি করেন।
রাকিবের জন্মের আগের কথা..........
সীমা আর আসিফ তখনও স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। সারা দুপুর খেলা করে ভাই-বোনে গাঁ-গতর নোংড়া করে, ক্লান্ত-ক্ষুধার্ত হয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, মা! খুব খিদে পেয়েছে........
তাদের মা তখন দুপুরের খাবার রান্না করতেছিলেন। তিনি বলেলন, শরীর যে পরিমাণ নোঙড়া করেছ এনেছ, তাতে আগে তো গোসল, তার পর না খাবার.......
এই বলে তিনি চুলার আগুনের আঁচ কমিয়ে দিয়ে তাদের দুই ভাই-বোন কে দ্রুত গোসল করিয়ে দুইজনের হাতে দুইটা মুড়ির মোয়া ধরিয়ে দিয়ে বলেলন, মোয়াটা খেয়ে যাও আরেকটু সময় খেলে আস, আমি রান্নাটা শেষ করি। আর সাবধান এবার কিন্তু শরীর নোংরা করবা না আর বেশি দুরেও যাবা না, একটু পরেই রান্না শেষ হবে.....
তারা দু’জন মোয়া পেয়ে ভাত খাবার বিষয় নিয়ে মায়ের সাথে আর কোন আর্গুমেন্ট এ গেলো না। রান্না ঘর থেকে বের হয়ে খেলতে চলে গেল....
রান্না শেষ হলে তাদের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে অল্প দুরেই তাদেরকে খেলতে দেখতে পেল। তিনি তাদেরকে ডাক দিয়ে বললেন যে, রান্না শেষ হয়েছে……….খেতে চলে আস………..
মায়ের ডাক শুনে তারা দুইজনই খেলা ধুলা ফেলে মায়ের কাছে ছুটে আসতে লাগল...
সীমা-আসিফ কে ছুটে আসেতে দেখে তিনি ঘরের ভিতর ঢুকে কাপড় রাখার আলনার আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন এই ভেবে যে তিনি দেখবেন তার আদরের বাচ্চারা তাকে না পেয়ে কি কান্ডটা করে.............!!
সীমা আর আসিফ ঘরে ঢুকে দেখল মেঝেতে খেতে বসার যায়গায় গরম ভাতের বাটি থেকে ভাপ বেরুচ্ছে আর তরকারীর পতিলের মুখটাও খোলা। কিন্তু আসল জিনিসটাই কোথাও দেখতে পাচ্ছে না, মানে মাকে....
ঘরের এদিকে সেদিকে খোঁজেও যখন কোথাও মাকে পাওয়া গেল না, আসিফ তখন সীমাকে জিজ্ঞাস করল, মা কোথায় গেলরে, সীমা বল তো............
সীমা বলল, আমরা আসার সময় তো মাকে ঘরেই ঢুকতে দেখলাম। পরে মনে হয় বাইরে গেছে, আমরা খেয়াল করিনি.............
আসিফ বলল, আমরা আসার সময় তো এদিকে তাকিয়ে তাকিয়েই আসলাম। বাইরে কখন যাবে? বাইরে গেলে তো আমরা দেখতে পেতাম তাই না? আমার কি মনে হয় জানিস সীমা...............???
সীমা বলল, কি মনে হয়.......??
আসিফ তখন সীমার কানের কাছে গিয়ে বলল, আম্মা মনে হয় ঘরেই কোথাও লুকিয়েছে.........
আড়াল থেকে ছেলের কথা শুনতে পেয়ে তাদের মার দম ফেটে হাসি পাচ্ছে.......
আসিফের কথা শুনে সীমা ক্ষেপে গিয়ে বলল, আম্মা কি তোমার মত বাচ্চা পোলাপান নাকি, যে লুকাবে? অন্য কোথাও গেছে হয়ত। আমরা টের পাইনি। চলে আসবে এখনই.........
মেয়ের কথা শুনে আড়ালের তিনি রীতিমত ভিমড়ি খেয়ে গেলেন। কি তেজী মেয়ে রে বাবা। আপন বড় ভাই কে ”পোলাপান” বলে শাষায়।
আসিফও বোনের ঝড়ি খেয়ে চুপসে গেল........
আরও কিছু সময় অতিবাহিত হল.......
এবার সীমা একটু কোমল হয়ে বলল, ভাইয়া, আম্মা মনে হয় কাকীদের বাড়ি গেছে। আমরা খেয়াল করিনি। চল কাকীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি........
আসিফ তার কথায় সায় দিয়ে বলল, আচ্ছা, চল যাই.....
খুব গম্ভীর মুখ করে তারা দুজন ঘর থেকে বের হল। দরজার নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মা আড়াল থেকে বের হয়ে এসে বলল, কে কোথায় যায় রে........!!!!!!
এই কথা শুনে ফিরে তাকিয়ে মাকে দেখতে পেয়েই তাদের মুখের সকল গম্ভীরতা ভুবন ভোলানো খুশির ঝলকে পরিনত হল। খিলখিল হাসি দিয়ে ভাই-বোন একসঙ্গে দৌড়ে গিয়ে মায়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ল.......
নিজ সন্তানদের এই অকৃত্তিম আনন্দ টুকু দেখার জন্যই হয়ত তিনি মাঝে মাঝে তাদের সাথে দুষ্টামি করে। অথবা কি কারণে করেন তা তিনি নিজেও জানেন না......
বাচ্চাদেরকে দৌড়ে আসতে দেখে তিনি তাদের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে ঘরের মেঝেতে হাটু গেরে বসে পড়লেন। আসিফ আর সীমা দৌড়ে এসে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। তিনি দুজনকে দুই হাত দিয়ে আলতো করে বুকের সাথে চেপে ধরলেন......
মায়ের কাধের সাথে মুখ ঠেসে ধরে অস্পষ্ট স্বরে আসিফ সীমাকে লক্ষ্য করে বলল, দেখলি সীমা, আমি বলছিলাম না, আম্মা লুকিয়েছে......!!
সীমা আসিফের কথায় কান না দিয়ে মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে বলল, আমরা কত খুজলাম,আপনি কোথায় ছিলেন? আমি তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম.......
তিনি সীমার নাকের ডগায় নাক ঠেকিয়ে বলেলন, ও আচ্ছা তাই বুঝি? চল, আর কোন কান্না-কাটি নয় এবার আমারা ভাত খাব…….
এভাবেই তিনি মাঝে মাঝে নিজের বাচ্চাদের সাথে দুষ্টামি করে থাকেন। কখনোও কখনোও ছেলে বা মেয়ে কোন একজন কে নিজের পক্ষে রেখে অন্য জনের সাথে দুষ্টামি করে আবার কখনোও তিনি একাই এক পক্ষ আর ভাই-বোন দুইজন এক পক্ষ..........
সীমাদের মামা বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দুরে। অধিকাংশ সময় সীমার মা ছেলে-মেয়েদেরকে নিয়েই বাবার বাড়ি বেড়াতে যান। তার বাবার বাড়ি যাওয়ার সম্পুর্ন রাস্তাই হেটে যেতে হয়। কোন যান-বাহন চলে না সে পথে .................
তখন আষাঢ় মাস।রাকিব হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে তিনি বাবার বাড়ি বেড়াতে এলেন। দুই-তিন দিন থাকার পর বাড়ি ফিরবেন। সকাল সকালই বের হলেন। বের হওয়ার সময় আকাশ মেঘলা মেঘলা ছিল। কিন্তু বের হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশের শেঘ কেটে গিয়ে কাঠ ফাটানো রোদ উঠে গেল। আসিফ আর সীমা মায়ের পিছু পিছু হাটছে, রাকিব মায়ের কোলে...........
সীমা মায়ের পিছন থেকে রাকিবের একটা হাত ধরে এটা ওটা বলে খুব হাসছে, তার সাথে সাথে রাকিবও মায়ের কোলে বসে বসে ফিক ফিক করে হাসছে.......
রাস্তার পারে ঘন ছায়া যুক্ত একটা গাছের নিচে এসে সীমা দাঁড়িয়ে পড়ল আর মাকে বলল, আম্মা এখানে কিছুক্ষন থেমে জিরিয়ে নেই চলেন, খুব গরম লাগতেছ...........!!
সীমার মা’রও খুব গরম লেগেছে। কাজেই তিনিও মেয়ের কথা শুনে গাছের নিচে থামলেন।......
রাকিবকে মাটিতে ছেড়ে দিয়ে তিন জন তাকে ঘিরে ধরে তাকে লক্ষ করে বিভিন্ন কথা বলতে লাগল। রাকিব সবার কথা শুনে মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসছে আর হাসছে.........
হঠাৎ সীমার মা দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, সীমা.......! চল আমরা রাকিবকে এখানে বসিয়ে রেখে একটু দুরে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি ও কেমন করে.........!!
সীমা আর আসিফ মায়ের কথায় খুব আগ্রহ নিয়ে রাজি হল। তিনজনই দাঁড়িয়ে পড়ল.......
তিন জনই এক পা এগিয়ে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকাল। দেখল রাকিব তাদের দিকে তাকিয়ে তখনও জিহ্বা বের করে হি হি করে হাসছে......
আর এক পা আগানোর পর তারা আবার ফিরে তাকিয়ে দেখল রাকিব এখন কেবল তাদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে......
এবার আর হাসছে না। তার চেহারায় কিছু অসহায় অসহায় ভাব….........
তারা আরও এক পা আগালো। রাকিব এবার এ্য…. এ্য…. করে কেঁদে হামগুড়ি দিয়ে তাদের দিকে আগাতে চেষ্টা করল...........
তাদের মা’র আরও দুই-এক পা এগিয়ে দেখার ইচ্ছা ছিল রাকিব শেষ পর্যন্ত কি করে.............
কিন্তু সীমা ছুটে এসে রাকিবকে কোলে তুলে নিল আর বলল, সোনা মানিক ভাই আমার, তোমাকে ফেলে আমি এক পাও যাব না। আমার এত পরীক্ষা নিরীক্ষার দরকার নাই..............
বলে সে তার ছোট্ট ভাই টিকে ছোট্ট বুকের সাথে যাপটে ধরল.....
রাকিব সীমার কোলে বসে তখনও ফিকরে ফিকরে কাঁদছিল।.......
ভাইয়ের প্রতি সীমার এই অকৃত্রিম টান দেখে তার মা খুবই অভিবুত হলেন...........
তিনি পেটের ছেলেকে নিয়ে যে দুষ্টামিটা অনায়াসে করতে যাচ্ছিলেন, সীমা একজন নাবালিকা বোন হয়ে সেই দুষ্টামিটা ভাইয়ের সাথে করতে পারল না…..
সীমার রক্তের টানের কাছে তার মায়ের নারীর টান পরাজিত হল। এবং এই পরাজয়কেই তিনি তার এই জনমের সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া বলে মনে করলেন………
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:৫৯