অনেক দিন পরে আজ ঢাবি ক্যাম্পাসে যাওয়া হল। একসময়ের খুব প্রিয় এই এলাকাটা এখন এড়িয়ে চলতে ইচ্ছে হয় এবং তাই চেষ্টা করি। ছাত্রত্ব হারালাম মাত্র ছয় মাস অথচ এখনই এই অবস্থা। আগে মাঝে মাঝেই নিজের উপর বিরক্ত হতাম এখানে ভর্তি হবার জন্য। কারনগুলো এখন আর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বিরক্তি সব ধুয়ে যেত যখন নীলক্ষেত দিয়ে রিক্সায় ক্যাম্পাসে ঢুকতাম। ভিসির বাসার সামনে মল চত্তরের বিশাল গাছটি মনে হয় স্বাগতম জানাতে দাঁড়িয়ে থাকত। কলাভবনের সামনের রাস্তায় দুই ধারের গাছগাছালি যেন মাথা নত করে স্বাগতম জানাচ্ছে। বিভিন্ন লতা পাতায় সাজানো রাস্তায় মাঝের আইল্যান্ডটা যেন কোন বিশাল প্রাসাদের মখমলে মোড়া সোফা। সব চাইতে মন কাড়ে যদি জারুল গাছে বেগুনী ফুলগুলো থাকে। ফাকে ফাকে লাল কৃষ্ণচুড়া, হলুদ রঙের ফুলের গাছ মাঝে একটা সাদা রঙের ফুল গাছও আছে কলাভবনে। মনটা নেঁচে উঠত, নিমিষেই হাওয়া হয়ে যেত সব অভিযোগ। বিকেলে যখন বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম, গাছগুলোর মাথায় সূর্যের আলো থাকত। মুগ্ধতায় স্তব্ধ হওয়া ছাড়া গতি ছিল না।
মোকাররম ভবনে ডিপার্টমেন্ট আর সাইন্স লাইব্রেরী দুটিই থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনান্য প্রান্ত গুলোতে তেমন যাওয়া হয়নি। এমনকি টিএসসিতেও না। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়ে নতুন আমেজে কয়েকবার বন্ধুরা মিলে গিয়েছিলাম সেখানে আড্ডা দিতে। পরে আর সময় কুলাতে পারিনি। সকালে নয়টা- একটা টানা ক্লাস, তারপর দুই-পাঁচটা প্রাকটিকাল, শনিবার সকালে মিডটার্ম থাকায় শুক্রবারে পরীক্ষার প্রস্তুতি আড্ডার জন্য রুটিনে কোন সময় বরাদ্দ করতে দেয় নি। অনেকটা কিন্ডারগার্ডেনের মতই ছিল আমাদের জীবন যা ঢাবিতে অনেকটাই অনাকাঙ্খিত।
আজকে রিক্সা দোয়েল চত্তর অতিক্রমের পরে মোকাররম ভবনের গেটে রিক্সাওয়ালাকে বললাম ডানে যাও। ঠিকই বলেছিলাম যদিও আমি প্রায়ই ভুলে ডান-বাম গুলিয়ে ফেলি। ডানের স্থলে বামে যাও বলায় রিক্সাওয়ালাও মাঝে মাঝেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের গেট দিয়ে রিক্সা ঢুকিয়ে দিত। আজ তেমনটি হল না। আমি আজও অনুভব করতে পারি, মোকাররম ভবনের প্রবেশ পথ দিয়ে প্রথম এখানে ঢুকবার অনুভূতি। আমাদের বিভাগটি আগে কার্জন হলে ছিল, তাই চান্স পাওয়ার পরে অনেকের কাছ হতেই জেনেছিলাম ডিপার্টমেন্টটা কার্জন হলে। পর পর দুই দিন খুজেও পাই নি তখন। পরে তখনকার অগ্রনী ব্যাংকের ম্যানেজার আংকেল বাবার কলিগ হবার সুবাদে নিজেই ডিপার্টমেন্টে পৌছে দিয়েছিলেন। আমাদের ডিপার্টমেন্টটা নতুন সাইন কম্পলেক্স বিল্ডিংএ খুবই আধুনিক লাগত। গর্বে বুক ফেটে যায়নি এই ভরসা।
বিভাগের প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে একটা সেমিনার লাইব্রেরী আছে, প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম চৌধুরী মেমোরিয়াল সেমিনার লাইব্রেরী।
ডিপার্টমেন্টে ঢুকে প্রথম এখানেই আসি ভর্তির ফর্ম ফিলাপের জন্য। এখানেই সেই সব বন্ধুদের সাথে দেখা যাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পাড়ি দিয়েছি। তখন কোন কম্পিউটার ছিল না, কিন্তু প্রানবন্ত ছিল। এখন অনেকগুলো কম্পিউটার, সাথে এসিও লেগেছে কিন্তু প্রান নেই। আসলে কি প্রান নেই? উক্তিটি আসলে আমার সাপেক্ষে। এখনকার ছাত্র ছাত্রীদের কাছে নিশ্চয়ই এই লাইব্রেরিই প্রানবন্ত। আমাকে প্রান দেবার জন্য আমার বন্ধুরা এখন আর নাই, আমার মত ওরাও ব্যস্ত। তবে হ্যা, আমরা আরো একটা এলাকা পেয়েছিলাম যা এখনকার ছাত্রছাত্রীরা পায় নি। আমাদের একটা রিডিংরুম ছিল। সেখানে সিনিয়র-জুনিয়র সবাই আড্ডা, চিল্লাচিল্লি সবই করা যেত। আমাদের ফিরোজ ভাই স্যারদের জন্য খাবার দাবারের ব্যবস্থা করতেন। সেই সাথে তিনি আমাদের জন্যও সিঙ্গারা, সমুচার ব্যবস্থা রাখতেন, ফ্রিজে সফট ড্রিকংসও থাকত। নিজ ঘরের মত নিয়ে খেয়ে ফেলতাম, তবে ফিরোজ ভাইয়ের হিসাবে কখনও ঝামেলা হয়েছে বলে শুনিনি। এই সুবিধাটা এখন নেই। জনৈক ধর্মপরায়ন ও নীলাভ শিক্ষক বিভাগীয় চেয়ারম্যান হবার পর রিডিং রুমটির অর্ধেক নামাজের জন্য বরাদ্দ দেন। ফলাফল এই যে আজ সেখানে কেউ নামাজও পড়ে না, ছাত্রছাত্রীদের গুঞ্জনও শোনা যায়না।
আমাদের আড্ডার অভাব পূর্ণ হয় ক্যাফে ক্যাম্পাসে। আইএসআরটিতে ঢুকবার রাস্তার পাসে কিছু জায়গা খালি ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেটাকে একটা ক্যাফেতে পরিনত করে। সুন্দরই ছিল জায়গাটা। সবুজ ঘাসে ঢাকা গাছগাছালির মাঝে টাইলস দিয়ে বাধানো সুন্দর সুন্দর বেঞ্চ। দুইটি কৃত্তিম ঝর্ণাও ছিল। আমাদের মত নিরস কিন্ডারগার্ডেনের ছেলেমেয়েদের জন্য জীবনে খানিকটা রস আনার ভাল সুযোগ ছিল সেখানে। বাইরের জুটিও আসত, তবে বিকেলের দিকে। ক্যাফে ক্যাম্পাসও এখন ইতিহাস। ক্যাফে ক্যাম্পাস নাম নিয়ে যা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মেসির এক কোনায় টিকে আছে তা টং দোকানের আধুনিক রূপ।
সাইন্স লাইব্রেরীর পেছনের অংশটা আসলেই মোহনীয়। ছেলে মেয়েরা সেই দিকটায় তেমন ভীড় করে না। সৌরশক্তি গবেষণা কেন্দ্রের সামনে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের একটা দারুন বাগান আছে। সেখানের সারাবছরই শাপলা ফোটে, নীল শাপলা। শাপলার ট্যাবের সামনেই একটা বাঁশ ঝাড়। এই বাশ ঝাড়টাও হয়ত একদিন হারিয়ে যাবে, তবে আমি এটার অসিত্ব অনুভব করব সব সময়। বিকেল বেলা যখন ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হতাম মূল মোকাররম ভবনের লম্বা ছায়া থাকত। শুধু বাঁশ ঝাড়টায় সূর্যের আলো থাকত, এটা একটা রুপ। আবার যখন ঝড় আসে আসে অবস্থা এই বাঁশ ঝাড়ের শন শন শব্দ ভুলিয়ে দিত আমরা ব্যস্ত ঢাকা শহরের মাঝে আছি। সাইন্স লাইব্রেরীর পেছনে একটা বিশাল গাছ আছে যার নিচের অংশ পুরোটাই মানিপ্ল্যান্টের বড় বড় পাতায় ঢাকা। এখানে একসময় আমাদের ডিপার্টমেন্টের ভেড়াগুলো চড়ত। এই ভেড়াগুলোকে আদর করে পালন করা হত কারন ওদের রক্ত আমাদের দরকার। জনৈক শিক্ষক চেয়ারম্যান হবার পর ভেড়াগুলোকেও বিক্রি করে দিলেন রাখলেন একটা। শিশু ভেড়াটা আর কতই বা রক্ত দিতে পারে। একদিন মরে গেল। এরপর আমাদের রক্তের জন্য মহা ঝামেলা করতে হত। যার দরকার তার নিজ টাকায় মুরগি কিনে রক্তের ব্যবস্থা করতে হত। শুনেছি, জুনিয়র এক মেয়ে ঝামেলা এড়াতে নিজের রক্তেই কাজ সাড়ে।
ডিপার্টমেন্টের বাইরে যেখানে আমার নিয়মিত যাওয়া হত সেটা সাইন্স লাইব্রেরী। প্রথম তিন বছর আমার লাইব্রেরী কার্ড কখনও খালি থাকে নাই। ১৫ দিনের মধ্যে বই জমা দিতে না পেরে কত যে পঞ্চাশ পয়সা জরিমানা দিতে টিএসসির জনতা ব্যাংকের লম্বা লাইনে দাড়িয়েছি তার সংখ্যা মনে নাই। একে একে ছেলে মেয়েরা জমা দিচ্ছে দুই হাজার তিন হাজার, পাঁচশ ছয়শ আর আমি দিচ্ছি পঞ্চাশ পয়সা। লাইব্রেরীটা ক্লোজ সিস্টেম, মানে আমাদের সেলফে এক্সেস নাই। তাই বইয়ের এক্সেস কোড লিখে দিতে হত। কত বইয়ের আইডি যে আমার মুখস্থ ছিল তার হিসাব নাই। একবার এক বই এক টাকাও জরিমানা না দিয়ে ছয় মাস রেখেছিলাম। ১৫ দিন পরে সবার শেষে জমা দিতাম, পরদিন সবার আগে তুলে ফেলতাম। লাইব্রেরীয়ান গাইগুই করত, কিন্তু আমি আইন দেখাতাম। আইনে এই ব্যবস্থাই রাখা হয়েছে। লাইব্রেরীতে একটা থিসিসের ছাত্রছাত্রীদের জন্য রুম ছিল। গুগল পাবমেডের যুগে সেই কোনায় কখনও যাওয়া হয় নাই।
সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত বোটানি আর বায়োকেমিস্ট্রি ক্লাস করতে কার্জন হলে যেতে হত। কেমিস্ট্রি ক্লাস ছিল ভোরে। বসন্ত ঋতুতে ভোরের বেলায় কার্জন হল অন্যরকম সাজে। বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের দিকের গেট দিয়ে ঢুকলে চারটা হলুদ ফুলের গাছ দেখা যায়। খুবই গাঢ় হলুদ সেই রঙ, গাছের নিচেও ছড়িয়ে আছে কার্পেটের মত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কয়টা নিয়মিত কাজের মাঝে একটা হয়ত কার্জন হলের পরিচর্যা। কাজটা সিরিয়াসলিই করা হয়।
পুরানো ঢাকায় মানুষ আমি। দাদার একটা বাড়ি আছে এলিফেন্ট রোডে। মাঝে মাঝে বাবার সাথে সেখানে যাওয় হত। মন খুব চাইত রিক্সা যেন রমনার সামনে দিয়ে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে যায়। বাবা কার্জন হল দেখিয়ে বলত, “লেখা পড়া ভাল মত না করলে এখানে চান্স পাবে না, গিফারি কলেজে পড়তে হবে”। জানি না এত কলেজ থাকতে উদাহরনে কেন গিফারি কলেজ আসত। যাই হোক গিফারি কলেজে পড়তে হয়নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েছি। জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সাত বছর কাটল এই ঠিকানায়। কেন গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তর হবে আমি আসলেই এখানে মানুষ হয়েছি, মানুষকে চিনতে শিখেছি। শিক্ষক হিসেবে যারা বেতন পান শুধু তারাই নয় আমার সহপাঠিরা, বন্ধুরা সবাই এক ধরনের শিক্ষক। এক একটা অদ্ভুত মানব চরিত্র, যা ভবিষ্যতের বিশাল পৃথিবীর একটা ছোট্ট সংস্করণ। ফেলে আসা দিনগুলোর পাতা উল্টালে দেখতে পাই ভয়ানক পার্থক্য সেই আমি আর এই আমির মাঝে। সেই আমি ভালবাসতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন আর বাসি না। সেই সুন্দর অঞ্চলটাতে রিক্সায় ঢুকতে হলে চেষ্টা করি যেন ভিন্ন পথ ধরা যায়।
জারুল ফুলগুলো এখন আর মান ভাঙ্গাতে পারে না।
বিদ্র: লেখাটা আবারো পড়লাম। হঠাৎ মনে হল, নতুন ব্লগাররা কেউ কেউ মনে করতে পারেন ছ্যাকা ট্যাকা খেয়ে ক্যাম্পাস এলাকার নিয়ে বিরহ কিনা। উত্তর হবে, না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:৫৬