নার্গিস, প্রমীলা, ফজিলতুন্নেসা এই তিন নারীই নজরুলের কাছ থেকে প্রেম বলতে আমরা যা বুঝি সেটা পেয়েছিলেন। এছাড়া নজরুলের জীবনকালে তার সাথে সংশ্লিষ্ট আরো কিছু নারীকে জড়িয়ে কিছু গুজব উঠেছিল বা তাদের প্রতি নজরুলের গভীর আত্মীক আকর্ষণ অনুভবের প্রমান মেলে। তাদেরই কয়েকজনের কথা উল্লেক করছি।
রানু সোম (প্রতিভা বসু)
একজন হলেন ঢাকার বনগ্রামের রানু সোম, যিনি পরবর্তিতে কবি বুদ্ধদেব বসুর সাথে বিবাহ বন্ধকে আবদ্ধ হয়ে প্রতিভা বসু নামে পরিচিতি লাভ করেন। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায় ঢাকায় এসে রানু সোমের গান শোনেন এবং নিজ আগ্রহে তাকে নজরুল গীতি শেখানো শুরু করেন। কলকাতায় সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়ের কাছে নজরুল প্রথমে রানু সোমের কথা জানতে পারেন। ১৯২৮ সালে ঢাকায় এসে কাজী মোতাহার হোসেনের সহায়তায় ঠিকানা খুঁজে নজরুল নিজেই রানু সোমের বাসায় উপস্থিত হন। সারা বাংলায় তখন সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়, রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্র বসু ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই তিনজনের জোয়ার। নজরুলকে নিজ দুয়ারে দেখে রানু সোম হতভম্ভ হয়ে যান। দিলীপ কুমার রায়ের মতই নজরুলও রানুকে নিজ আগ্রহে গান শেখানো শুরু করেন। তাদের মাঝে সুন্দর গুরু-শিষ্য সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরপূর্বে দিলীপ রায় ঢাকার টিকাটুলির রেনুকা সেনকে গান শেখান, যিনি রীতিমত বিখ্যাত হয়ে উঠেন। রেনুকা-দিলীপ রায়ের মাঝে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ছিল। কলকাতার ‘শনিবারের চিঠির’ সম্পাদক তাদের এই গুরু-শিষ্য সম্পর্কে বিকৃত করেন এবং দিলীপ রায়ের নাম দেন কানুরে। একই ভাবে এই সজনীকান্তের নজরুল-প্রতিভা সম্পর্ক নিয়েও গাত্র দাহ শুরু হয়। মুসলমান যুবক কবি প্রতিদিন হিন্দু যুবতীকে গান শেখানোর আড়ালে ঘনিষ্ট হচ্ছেন, এই অপবাদ চাপিয়ে নজরুলকে হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে সজনীকান্ত তার ‘শনিবারের চিঠিতে’ একটি প্যারোডি লেখেন যার নাম ছিল, ‘কে বিদেশী বন-উদাসী বাঁশের বাঁশী বাজাও বনে’।
সজনীকান্তের এই প্যারোডি প্রকাশের কিছুদিনের মাঝে একরাতে প্রতিভাদের বনগ্রামের বাসায় থেকে বের হবার পরে ৭/৮ জন হিন্দু যুবকের দল নজরুলকে আক্রমন করে। নজরুল তাদের পালটা আক্রমন করেন, পরে পুলিশ এসে আক্রমনকারি যুবকদের তাড়িয়ে দেন। এই সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, “স্থানীয় হিন্দু যুবকেরা সজনীকান্তের প্যারোডি সম্ভবত পড়েছিল। এতে তাদের মনে সন্দেহ দ্বিগুন হয়ে উঠে। তারা একটা কেলেঙ্কারীর কথা আঁচ করে তার একটা বিহিত করার চেষ্টা করছিল। রানু হিন্দু মেয়ে আর নজরুল মুসলমান ছেলে। সুতরাং তাদের হিন্দু রক্ত এই সম্পর্কটিকে একেবারে সহ্য করতে পারছিল না। এ যেন ছিল তাদের পৌরুষের উপর আঘাত”।
রানু সোম কবিকে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করেছিলেন। শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার সঙ্গে মিশেছেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে কবির তুলে দেওয়া গান শিখেছেন। কবির প্রত্যাশা ছিল রানু নজরুল গীতির বড় মাপের গুনী হবে। এজন্য উভয়ের সম্পর্ক গুরু-শিষ্যের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। প্রেমের কোন সম্পর্ক এখানে গড়ে উঠেনি।
উমা মৈত্র
১৯২৮ সালে ঢাকার তিনজন গুনী কন্যার সাথে নজরুলের পরিচয় হয়; ফজিলতুন্নেসা, রানু সোম ও উমা মৈত্র। উমা (ডাক নাম নোটন) ছিলেন ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে । নোটনের বাবা মা দু’জনেই বিলাতী ধাঁচের ব্রাহ্মন, বন্ধুবৎসল ও উদার মনের অধিকারী ছিলেন। পরিবারে হিন্দু মুসলিম কোন ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিল না, উভয় ধর্মের গুনী মানুষরাই এই পরিবারে সজ্জন ব্যবহার ও উষ্ণ অভ্যর্থণা পেত। অভিজাত ব্যক্তিত্ব ও শান্ত স্বভাবের অপূর্ব সুন্দরী নোটন সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন মন্তব্য করেন, ‘কাব্য প্রেরণাদায়ী আনন্দের নির্ঝরিণী’ Phantom of Delight রূপে। সেতার বাজাতেন নোটন, নজরুল তাকে গান শেখানোও শুরু করেন। গান শিখাতে গিয়ে নজরুল কি নোটনের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন কিনা তার উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে কবি জীবনে নার্গিস-প্রমীলা-ফজিলতুন্নেসার সাথে সাথে উমা মৈত্রের নামও উচ্চারিত হয়েছে। কাজী মোতাহার হোসেন নানা প্রবন্ধে উমা মৈত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। নার্গিস, প্রমীলা, বা ফজিলতুন্নেসাকে যে ভাষায় কবি প্রেম নিবেদন করেছিলেন উমা মৈত্রের ক্ষেত্রে সেরকম ভাষা পাওয়া যায় না। তবে, ‘গানের আড়াল’ কবিতাটি উমার প্রতি কবির দুর্বলতাকেই অনেকাংশে প্রকাশ করে। কবিতার কিছু অংশ উল্লেখ করছি,
তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি- মোর কন্ঠের গান-
এইটুকু শুধু রবে পরিচয়? আর সব অবসান?
অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথ্যা লুকায়ে রয়,
গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয়?
হয়তো কেবলি গাহিয়াছি গান, হয়ত কহিনি কথা,
গানের বাণী সে শুধু কি বিলাশ, মিছে তার আকুলতা?
এ প্রসঙ্গে কাজী মোতাহার হোসেন বলেন, ‘কিন্তু নোটনের কাছ থেকে কোন রকম সাড়া পাওয়া যায় নি। তাঁর মুখের ভাবে স্বীকৃতির বিন্দুমাত্র চিহ্নটুকু ফুটে ওঠেনি কখনও। যেন দা ভিঞ্চির মোনালিসার মত তিনি ছিলেন সকল ধরা ছোঁয়ার বাইরের এক মূর্তিমতী রহস্য। কারও কারও হয়ত মনে হতে পারে উল্লেখিত কবিতাটি প্রতিভা সোম ওরফে রানুকে উপলক্ষ করে লেখা; কিন্তু আমার আদৌ সন্দেহ নেই যে কবি তার কাব্যপ্রেরণাদাত্রীর পরিচয়টিকে যথা সাধ্য গোপন করার চেষ্টা করেছেন। কেবল নোটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অন্তরঙ্গতার জন্য নির্বাক আবেদনের যতটা প্রয়োজন ছিল অন্যের বেলায় তততা ছিল না’।
ধারণা করা হয় নোটনের স্মৃতি কবি তার ‘শিউলিমালা’ গল্পটিতে ধরে রেখেছেন, গল্পটির কিছু অংশ এইরুপ,
“শিউলি আমার কাছে গান শিখতে লাগল। কিছুদিন পরেই আমার তান ও গানের পুঁজি প্রায় শেষ হ্যে গেল। মনে হল আমার গান শেখা সার্থক হয়ে গেল। আমার কন্ঠের সকল সঞ্চয় রিক্ত করে তার কন্ঠে ঢেলে দিলাম। আমাদের মালা-বিনিময় হল না-হবেও না এ জীবনে কোন দিন- কিন্তু কন্ঠ বদল হয়ে গেল। আর মনের কথা …… সে শুধু মনই জানে……।
…. একমাস ওদের বাড়িতে ছিলাম। কত স্নেহ, কত যত্ন, কত আদর। অবাধ মেলা মেশা- সেখানে কোন নিষেধ, কোনো গ্লানি, কোন বাধা বিঘ্ন, কোন সন্দেহ ছিল না। আর এসব ছিল না বলেই বুঝি এতদিন ধরে এত কাছে থেকেও কারুর করে কর স্পর্শ-টুকুও লাগে নি কোনদিন। এই মুক্তিই ছিও আমাদের সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। কেউ কারো মন যাচাই করিনি। কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসার কথাও উদয় হয় নি মনে। একজন অসীম আকাশ, একজন অতল সাগর। কোন কথা নেই-প্রশ্ন নেই, শুধু এ ওর চোখে, ও এর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে”।
জাহানারা বেগম চৌধুরী
জাহানারা বেগম চৌধুরী ওরফে মীরা পশ্চিমবঙ্গের মেয়ে ছিলেন। বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখকদের নিয়ে তিনি ‘বর্ষবানী’ নামের একটি বার্ষীক পত্রিকা বের করতেন। তখনকার দিনের প্রায় সকল সাহিত্যিকই জাহানারা বেগমের পত্রিকায় লিখেছেন। জাহানারা বেগমের সাথে নজরুলের প্রথম পরিচয় হয় ১৯৩১ সালে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে। সেইবার দার্জিলিংএ আরো উপস্থিত ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৈত্রয়ী দেবী, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ও তার মেয়ে উমা মৈত্র সহ আরো বিখ্যাত কয়েকজন। তার সম্পর্কে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেন,
“জাহানারা বেগম চৌধুরী ছিলেন মুসলিম সমাজের মেয়ে। হিন্দু সমাজের মেয়েরা তখন একটু অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু জাহানারার মত-অতটা যাকে বলে ‘ফরোয়ার্ড’-হিন্দু মেয়েরাও ছিল না। আগে ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা পত্রিকা বের করতেন যেম্ন স্বর্ণকুমারী দেবী, সরলা দেবী এবং মাত্র কয়েকজন। কিন্তু সম্পাদক হিসেবে একেবারে পুরুষদের সঙ্গে সমান তালে চলা, সংগ্রাম করে যাওয়া-জাহানারা যা দেখিয়ে গেছেন, তার আগে অন্তত কোনো মহিলা দেখাতে পারেননি। তার চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, মাধুর্যের সাথে ছিল তেজস্বিতা। সব মিলিয়ে তিনি কিছু বললে, সেটা অস্বীকার করা যেত না”।
নজরুলের একটি গানের খাতা জাহানারা বেগমের কাছে ছিল যাতে ছিল ৮ টি কবিতা ও ৭ টি গান। নজরুলের জীবনকালে এগুলো অপ্রকাশিত থেকে যায়। জাহানারা বেগম চৌধুরী মৃত্যুর আগে এগুলো প্রকাশের অনুমতি দিয়ে যান। সেখানে কয়েকটি কবিতায় জানাহারাকে নিয়ে রচনা করা কয়েকটি কবিতা পাওয়া যায়। তবে নার্গিস-প্রমীলা বা ফজিলতুন্নেসার মত কবি জাহানারাকেও ভাল বেসেছিলেন কিনা সেই প্রশ্ন আজও প্রশ্নই রয়ে গেছে।
কানন দেবী
শিল্পী কানন দেবীকেও কবি নজরুল গান শিখিয়েছিলেন। কলকাতার পত্রিকা ‘শনিবারের চিঠির’ সম্পাদক সজনীকান্ত কানন দেবীকে নিয়েও রসালো কাহিনী প্রচারে পিছিয়ে রয়নি। কানন দেবীকে নিয়ে একটি সংবাদ রটানো হয়েছিল এমন যে, কবিকে কলকাতার কোথাও না পেলে কানন দেবীর বাড়িতে অবশ্যই পাওয়া যাবে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অথবা সুর ভাজতে গিয়ে গভীর রাত হয়ে যাওয়ায় কানন দেবীর বাড়িতে নজরুলের থেকে যাওয়া প্রভৃতি ঘটনাকেই নিন্দুকেরা গুজব রটনার উপকরণ হিসেবে বেছেন নেন। অথচ, বাস্তব হয়ত ভিন্ন ছিল।
শেষ কথা
বাংলার বিদ্রোহী কবির বাঁধ ভাঙা প্রেমের এই হল সাতকাহন। সৈয়দ আলী আশরাফের ‘নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়’ গ্রন্থ হতে কিছু অংশ দিয়ে শেষ করছি।
“………..তিনি আসলে সৌন্দর্যের পূজারী, ব্যক্তির উপাসক নন। যে নারীর ভিতর সেই সৌন্দর্যের বিকাশ দেখেছেন এবং সে নারী তার মনে সেই পূজার যে আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত করেছেন, তাকে পাওয়ার জন্য ন্যায়-অন্যায়, সমাজের বাধা নিষেধ মানতে তিনি রাজী নন। স্তবগান রচনা করতে তিন প্রস্তুত। অর্থাৎ এই প্রণয় হচ্ছে সেই পর্যায়ের প্রণয় যে পর্যায়ে যাকে ভালোবাসা যায় তাকে দেবী বলে মনে হয়, মানুষ হিসেবে গণ্যকরা হয় না। ………….. তিনি এই প্রেমকে কবি হিসেবে উপলব্ধি করেছেন, উপভোগ ক্রএছেন। তাই এই প্রেমে একদিকে দেখি সাময়িক উচ্ছ্বাস, অন্য দিকে দেহি আত্মতৃপ্তি। দুঃখকে উপভোগ করার জন্যই যেন এই প্রেম। ……….. নার্গিস, জাহানারা, ফজিলাতুন্নেসা এদের সঙ্গে তার প্রেম কি একই প্রেমের পুনরুক্তি নয়? শুধু মনে হয় ফজিলতুন্নেসার প্রতি তাঁর অনুরাগ বেশ গভীর হতে পারত কিন্তু সেই গভীরতা অর্জন করার সুযোগ পায়নি।
তথ্যসূত্র:
নজরুল জীবনে নারী ও প্রেম: ড. আবুল আজাদ
স্মৃতিকথা (প্রবন্ধ সংকলন) : কাজী মোতাহার হোসেন।
আরো পড়তে ক্লিক করুন:
নার্গিস পর্ব || প্রমীলা পর্ব-১|| প্রমীলা পর্ব-২ ||
প্রমীলা পর্ব-৩ || ফজিলতুন্নেসা পর্ব-১ ||
ফজিলতুন্নেসা পর্ব-২ || ফজিলতুন্নেসা পর্ব-৩
পোস্টের সাথে সম্পর্কহীন মন্তব্য এখানে করুন।