বৃষ্টিকে তিনি ভালোবাসেন। বৃষ্টিতে তার জন্ম। সকাল থেকে ফিরে ফিরে বৃষ্টি হলে এমন দিনে তার ভালো লাগলেও অন্য অনেকের হয়তো ভালো লাগবে না। অনেকেরই ভালো লাগে না। বৃষ্টি ভালোর থেকে যে কর্দমাক্ত শহরকে অতিষ্ঠ করে তোলে তা বিচরণশীল শহরবাসীর জন্য মোটেও ভালো লাগার কথা নয়। কিন্তু বৃষ্টিতে যার জন্ম তার তো ভালো লাগবেই বৃষ্টি। তার পছন্দকে তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বললে বিমুখতা পেয়ে বসবে। তিনি এই দিন অন্তত কিছুটা সময় তুমুল বৃষ্টি কামনা করতেই পারেন। যার বৃষ্টি প্রিয়, বৃষ্টি যার ভালো লাগে- এই ভালো লাগা ব্যক্তির নাম আল মাহমুদ। এই ভালোবাসার, ভালোলাগার মানুষটির জন্মদিনে তার ঘরমুখী কবি, সাহিত্যিকের অভিযাত্রা, শুভেচ্ছা জানাতে যাওয়া, ভালোবাসা জানাতে যাওয়ার আকাক্সক্ষা তাতে বৃষ্টি কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। লাগে কিভাবে, বৃষ্টি যে বাঁধা। কিন্তু বৃষ্টির দিনেই যে আল মাহমুদের জন্মদিন।
একটি আয়েশী দিনে ঢঙ তার বৃষ্টিময় হতেই পারে। আত্মার সাথে যে তার কবিতা মিশে আছে। তার হৃদয় কবিতার জন্য সদা উন্মুখ। তিনি নিজেই কবিতার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত অপেক্ষায় থাকেন। প্রকৃতি তার কবিতার অংশ। কবিতাকে তিনি প্রকৃতির ভিতর পেতে চান নিবিড় করে। কবিতার ভিতর তার বসবাস বলে একান্ত মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিতাকে নিয়েই তার বসবাস সাজাতে চান। প্রেম প্রকৃতিকে করে নেন আপন।
প্রকৃতির সব ধরনের শিহরণে কম্পিত হওয়ার অনুভূতি নেই আমার।
এর মধ্যে কতকিছুই তো নষ্ট হয়ে গেছে। শীত-গ্রীষ্মে উদ্বিগ্ন হওয়ারও
কোনো কারণ ঘটে না। কেউ হয়ত কাশ্মীরী শাল এনে গায়ে জড়িয়ে দেয়।
চায়ের কাপ রেখে যায় ইজিচেয়ারটার হাতলে। চোখের সামনে যাদের নড়াচড়া
তাদের চেহারা দেখতে চোখ দু’টি উৎসুক কিন্তু দৃষ্টির ঠিক মধ্যখানে কিসের
ছায়া? মানুষ বা প্রিয়জনের মুখ দেখতে না পারার কষ্টও আমার একটু একটু
করে সয়ে যাচ্ছে। কোনো অভিযোগ নেই। কার কাছেই বা অভিযোগ? (বৃষ্টি: নদীর ভিতরে নদী)
এর পরপরই কবি আল মাহমুদ বলেন-
দৃষ্টি ও স্পর্শের
অনুভূতি যে আমাকে আর সাহায্য করছে না তা তারাও বোঝে। কিন্তু
বৃষ্টি শুরু হলেই তারা যার যার আড়ালে চলে যায়। কারণ বৃষ্টিতেই
তারা আমার অতীতকে সম্ভবত আন্দাজ করে ফেলে।
তারা কি আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে? আমি যা দেখতে পাই, যেমন
কাঁচা মাটির উঠোনে সেই উদোম, উদ্ভিন্নযৌবনা এক পৃথিবী, তারা কি তাও দেখে? (বৃষ্টি: নদীর ভিতরে নদী)
এই যে বৃষ্টি ভালো লাগার কবি তার কবিতা আজ সাহিত্যের এক শক্তিমান সম্পদ। জীবন বহমান নদীর মতো তার কবিতা বহমান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে। প্রকৃত কবির একটি অহংকার। যা তার নিজের থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে অনেক দূর-দূরান্তে। যেখানটা শুধুই কবিতার ব্যঞ্জনায় গড়া এক কাব্যজগত। যেখানে প্রবেশ করে যে কেউ সহজে কবিতার খোড়াক নিতে পারে। নিজের মননশীলতাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
আল মাহমুদের কবিতা বহুমুখী। কোনো একটি নির্দিষ্ট অবয়বে আটকা পড়ে না। কোনো সীমাবদ্ধ গণ্ডির ভিতর তা সীমাবদ্ধ না। তিনি নিজের মতো উন্মুক্ত বিচরণের নানা প্রান্তরে কবিতাকে মেলে ধরেন। তিনি মানুষের হৃদয় জয় করতে নিজের একটি কাব্যভাষা তৈরি করে নিয়েছেন। তার ভিতর রয়েছে সকল প্রকার উপাদান। যখন যেমন প্রয়োজন। সে সময় যে জিনিসের প্রয়োজন। রসদ গুছিয়ে চমৎকার করে সাজাতে পারেন কবিতা। যার ফলে আজ তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার এক প্রবাদ পুরুষ।
তার কবিতায় রয়েছে লোকজ উপদান। এর সাথে রহস্যময় হয়ে ওঠে নারীর রূপ-রহস্য, নারীর সৌন্দর্য। যুক্ত হয় আশার আলো, সচেতন বাণী বিন্যাসে রাজনীতির পটভূমি। তার কবিতাগুলো ছন্দবদ্ধ আর অলংকারে ভরা। শব্দ গাঁথুনী বক্তব্য বয়নে কৌশলী করে। এসবই তার কবিতার শক্তি সঞ্চয়ে নিয়ামকের ভূমিকা রাখে। অনন্য হয় তার কবিতা। কবিতা হয় অমূল্য সম্পদ। তার কবিতার অমূল সম্পদ কবিতার শক্তি হিসেবে কাজ করে। তিনি তার কবিতায় যে জীবনের খোঁজ করেন তা মানুষ, প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা- এসব কিছু পরিষ্ফুটিত হয় গভীরভাবে। তার সৃষ্টির পথ চলা গ্রামকে তুলে আনে। শহরকে গ্রাম মুখী করে। শহরগুলো দেখতে পায় আধুনিকতার ছোঁয়া। গ্রামগুলো জীবন্ত রূপ নিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে প্রেরণা যোগায় শহর হৃদয়ে। অনুপ্রেরণার মশালগুলো জ্বলে ওঠে গ্রাম থেকে। সবটুকু রূপ-রস সঞ্চারিত হয় গতিময় জীবনের ভিতর। তাই তিনি শহরে থেকে গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান না। জীবন পরিভ্রমণে বারবার উঠে আসে গ্রামের জীবনযাপন, অপরূপ ভঙ্গিমায় সে সৌন্দর্য নদী নালা, মাঠ প্রান্তর ঘেরা চিরচেনা বাতাসের গন্ধ গায়ে মেখে বিলিয়ে দেয় কাব্য সৌন্দর্য।
সচেতন ঐতিহ্যচেতনা তার কাব্যকে সমৃদ্ধকরে। তিনি ঐতিহ্যসন্ধানী কাব্য বিনিমার্ণে সচেতন। তার দেশমাতৃকার অঙ্গীকার মূর্ত হয় শিল্পবোধ নিয়ে। তার কবিতাগুলো সমকালী দর্শন, জীবন বাস্তবতার হাত ধরে চলে। বিপ্লবের বাণী তার কাছ থেকে শোনা যায়। অত্যন্ত সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় তার সৃষ্টিশীলতায়। অনেকটা দৈবজ্ঞানে ডুবে থেকে তিনি যেন তার স্বপ্ন কল্পনাকে সাজান। তিনি নিজে অত্যন্ত আশাবাদী একজন কবি, নিজের কবিতা নিয়ে। নিজের সৃষ্টিশীল অহংকারে। তার এই অহংকার কাব্যের। নিজের উপর নিজের আত্মবিশ্বাসের। সেজন্য তার কাব্যগুলো সেরা হয় লোক- লোকান্তর, কালের কলস, সোনালি কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, বখতিয়ারের ঘোড়া, মিথ্যাবাদী রাখালের ভিতর দিয়ে।
কোথায় যাবেন আল মাহমুদ নিজেকে ছাড়িয়ে নিজে। তিনি নিজেই তা জানেনন না। তার কবিতাকেন্দ্রিক গন্তব্য তিনি প্রতিদিনই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। চোখের দৃষ্টি ক্ষয়ে গেলেও তার অন্তর দৃষ্টি ছিল প্রখর বরাবরের মতো, তা কখনো ক্ষয়ে যায়নি। তার দূরদৃষ্টি কবিতাকে বহুদূরগামী করে। তাকে নিয়ে যায় সত্যের সীমায়। তিনি নিজেই অন্ধত্বকে জয় করের হৃদয় দৃষ্টি দিয়ে। দেখেন সবকিছু। অতীত, নিকট, ভবিষ্যত- যা তার দেখার। সে দৃষ্টি তার কখনো লোপ পায়নি। তিনি শরীরে কাছে হৃদয়কে পরাজিত হতে দেননি।
পরাজয় মানিনিকো। কানা এই মামুদের আত্মার উড়াল,
পৃথিবীর মেঘবৃষ্টি, বোমাবর্ষণের আঁচে
ভেবেছি মানুষ তবে মানুষের রক্ত খেয়ে বাঁচে?
ভয় হয়, ভূমধ্যসাগর কবে আদমের রক্তে
হবে লাল?
মানুষের প্রতিবাদ, দীর্ঘশ্বাস অতলান্তিক পার হবে কবে
বুঝিনি, সন্দেহ ছিল। তবু অকস্মাৎ ভেঙে কি পড়েনি বলো
আলিশান পুঁজির প্রতীক?
মানুষের হাহাকার পরাভব মানবে না, এগোবে সে
চূড়ান্ত আহবে। (কানা মামুদের উড়ালকাব্য : উড়ালকাব্য)
আল মাহমুদের কবিতা পাঠে ক্লান্তি লাগে না। একেক কবিতা একেক রকম, একেক আঙ্গিকে গড়া। বৈচিত্র্যময় হয়েও কোনো কোনোটা অনেক রহস্যপূর্ণ, বিস্ময় জাগা। তার কবিতা সাহিত্যে যে সম্পদ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তা তিনি বারবার নতুন নতুন বিষয়-আশয় দিয়ে গড়ে তুলেছেন। প্রতিনিয়ত লিখে যাচ্ছেন। কোনোটার সাথে কোনো মিল না থাকায় একগুয়েমী নেই। ফরে পাঠ থেকে প্রকৃত সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করা যায়। কানা বলে নিজের স্বীকারোক্তি থাকলে তার কবিতাগুলো অন্ধ বা কানা নয়। সেগুলোর দৃষ্টি আছে। সেগুলো মানুষকে, প্রকৃত পাঠককূলকে আনন্দ দেয়। চিন্তাচেতনা, মন-মননের সাথে মিশে ব্যক্তি হৃদয়কে সজীব করে, সমৃদ্ধ করে। তার গ্রামীণ চেতনা আর নাগরিক চেতনা তাই স্বতঃস্ফূর্ত থাকে। বিচ্ছিন্নতার মধ্যে না পড়ে সত্যিকার অর্থে কাব্যগুণের সহচর্যে, প্রভাবে গ্রামীণ বলয় থেকে শহরমুখী কবিতাগুলো বৈশিষ্ট্য গুণে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। এ জন্যই তিনি বিশিষ্ট হতে পেরেছেন। তার কবিতাগুলো জীবনমুখী হয়েছে। এজগৎ তার নিজের সৃষ্টি একান্ত আপন করা সৃষ্টি। আর তিনি তো আপদমস্তক কবিই। কবিতা তার গর্ব। তিনি নিজে কবি হিসেবে গর্বিত।
আল মাহমুদ কবিতাকে কেমন ভালোবাসেন তা খুব অল্প কয়েকটি বাক্যেই বোঝা যায়। তিনি বলেন, কবিতা তো হৃদয়ের পরেই (কথোপকথন: আল মাহমুদ; ওমর বিশ্বাস সম্পাদিত)। সঙ্গত কারণেই বোঝা যায় তার কবিতা কতটা হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা। কতটা প্রাণের ঝংকারে সজীব হয়ে ওঠা। তার কাজ হলো জীবন পরিশোধনের বাক নির্মাণ- যে বাঁকের স্বপ্ন তিনি দেখেন তার সৃষ্টির আনন্দ সেখানে ধরা দেবেই, এটাই তো স্বাভাবিক।
একদা পর ছিলে, এখন তো আমার কবিতা। ছন্দ তুমি,
অনন্তকালের দিকে চোখ তোলো, দেখো যতদূর দেখা যায়
নীলাচঁলে রক্তিমের রেখাঙ্কন দোলে...
মিল তুমি স্বর্গ ও মর্ত্যরে মিলনে। আমার বাসনা তুমি
ধরে আছো মৃৎপাত্র হয়ে। তোমাকেই পান করি
তোমাকেই গান বলে ভাবি।স্নান অবগাহনের মৃৎকুম্ভ তুমি। (আমার মৃত্তিকা : বিরামপুরের যাত্রী)
বাংলা সাহিত্যে সোনালি কাবিনের যে মর্যাদা তা অনেক উঁচুতে। কাবিন শব্দের যে ব্যবহার তার প্রয়োগ এভাবে বিরল। অথচ অসাধারণ। সে কারণে এর মর্যাদা অনেক উঁচুস্তরে। অনেক কিছু তিনি সাহিত্যে দিয়েছেন। তিনি দেশ মাতৃকার জন্য কত কিছুই না দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছে। তার নিজের সবটুকু যা তার আছে উজার করে বিলিয়েছেন। তিনি কোনো কিছুর বিনিময় চান না। শুধু কবি হতে চান। তার প্রচেষ্টা তাকে সফলতার শিখরে নিয়েছে। তার নিজের পরিশ্রমকে তিনি দেখছেন দেশ মাতৃকায়। তিনি যে দেশ-দশের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন।
একজন কবি আর কি দিতে পারে? এই নাও আমার পরিস্রুত ভাষা
নাও কবিতা-
আমার রক্ত। কলমের কালির চেয়েও মহার্ঘ। নাও আমর অশ্রুজল
দ্যাখো এতে যদি তোমার মরে যাওয়া স্রোতগুলো
নদীকে বিহবল করে ঘোলা পানির তোড় নিয়ে
সমুদ্রের দিকে ধাবমান হয়।
নাও অক্ষিগোলক। যদি এতে তোমার ভবিষ্যৎদৃষ্টি একবিংশ শতাব্দীকে
দুটি তীক্ষ তীরের মতো গেঁথে ফেলে। আমার চামড়া দিয়ে তোমার
রাঙা পায়ের জুতো বানিয়ে দিলাম। পরো
আর হেঁটে যাও আগামী দিনের দিগবলয়ের দিকে।
পৃথিবী দেখুক আমার সমস্ত গান পাখি হয়ে তোমার শরীরে বাসা বেঁধেছে।
আমার শব্দ তোমার শাড়ির পাড়ে মাছের আকৃতি নিয়ে
ঝাঁক বেঁধে সাঁতার কাটছে, তোমার ঘোমটায়।
দেখুক আমার ছন্দ তোমর কণ্ঠহার হয়ে দুলছে। আর
আমার উপমা? (দেশ মাতৃকার জন্য : দ্বিতীয় ভাঙন)
আমরা তার কবিতায় তাকে দেখি। তার স্বপ্নগুলো দেখি। তাকে খুঁজতে গিয়ে তার কবিতার গুপ্তধন পেয়ে যাই। তাকে কবিতার ভিতর প্রাণবন্ত দেখি। দেখি কবি, কবিতার ভিতর দিয়ে চমৎকার স্বপ্নময়, স্বপ্ন-বাস্তবার এক মিশ্রিত অপরূপ নান্দনিক পৃথিবী। সে কারণেই তিনি বলতে পারেন, কবিতা তো হৃদয়ের পরেই।
১০.০৭.২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ১০:৩৫