“এমন করে তাকায় আছিস কেন?”
আমি মায়ার হাতের মেহেদী দেখতে থাকি।এত সুন্দর করে কেউ মেহেদী আকতে পারে তা কখনো ভাবতে পারিনি।আমি ওকে লজ্জা লজ্জা মুখ নিয়ে বলি, “বিয়ের সময় আমার বউ এর হাতে তুই মেহেদী একে দিবি?”
মায়া নিজেও লজ্জা পেলো।আমাকে আমতা আমতা করে বললো, “মেহেদী দেয়া হাত অনেক পছন্দ?”
আমি ভ্যবলা টাইপ মাথা নাড়িয়ে বড় বড় চোখ করে বলি, “সুন্দর হতে হবে এমন।কি সুন্দর নকশা করছে।কে আকছে রে এত সুন্দর করে মেহেদী?”
মায়া আমাকে কথাটার উত্তর দিলোনা।মাঝে মাঝে ও এমন করে।আমার সাথে তার চার বছর ধরে বন্ধুত্ব, কিন্তু আজও তাকে বুঝতে পারিনা।আমি অবশ্য খুব যে তাকে বোঝার চেষ্টা করেছি কখনো তাও কিন্তু না। কেন যেন তার সাথে আমার একটা অন্তহীন দূরত্ব থেকে যায়।মায়া আমার দিকে তাকিয়ে আবার হাসি দেয়।আমাকে চোখ বড় বড় করে বলে, এ”ত মুগ্ধ হয়ে আমার দিকে কেউ কখনো তাকায়নি! নিজেকে তো হিরোইন লাগতেছে!!”
আমি নাক কুচকে ওকে বলি, “তোর দিকে তাকাবো কেন?তুই আমার ইয়ে নাকি।আমি তোর হাতের দিকে তাকিয়ে আছি।এত সুন্দর করে নকশা করলো কি করে?”
মায়া পার্কের বেঞ্চ থেকে উঠে বসে।আমাকে বলে, “বাসায় যেতে হবে।আমাকে নামায় দিবি একটু?”
আমি মাথা নাড়ি।মায়াকে বাসায় যে নামায় দেয়ার কোন দরকার আছে তা না।এখন মাত্র বিকাল ৪টা বাজে।ওর বাসা এখান থেকে রিকশা করে যেতে বড়জোর ১৫ মিনিট লাগবে।কিন্তু এটা এখন একটা অভ্যাস হয়ে গেছে।আমি ভার্সিটি ছুটি হলে প্রতিদিন এমন করে ওকে নামিয়ে দেই।কোনদিন যদি এমনটা না হয় তবে আমার খুব মন খারাপ থাকে।কেন থাকে তা জানিনা। আমি ওকে হয়তো ওমন করে চাই।এই কথাটা আলসেমী করে ওকে বলাও যাচ্ছেনা।পাঠককে বলি, আমার কোন ভয় নেই এই কথাটা তাকে বলার জন্য।আমি শুধু একটু সময় নিচ্ছি।নিজেকে আরেকটু বুঝতে চাই।
ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যখন ফিরে আসছি তখন ওর একটা মেসেজ পেলাম মোবাইলে।এটা আমাদের আরেকটা খেলা।দিনের শেষে আমি আর ও দুইজন হালকা পাতলা মেসেজ আদান প্রদান করি।মেসেজে সেই কথাগুলো হয় যেগুলো আমি কখনো তাকে হয়তো সামনে বলতে পারবোনা।
আজকে সে মেসেজে লিখেছেঃ “আজকে রাতে বৃষ্টি হবে দেখিস।ঝুম ঝুম বৃষ্টি হবে।আমি খুব অদ্ভুত একজন।বৃষ্টি কেন যেন ভালো লাগেনা”।
আমি ওকে উত্তর দিলামঃ “বৃষ্টি ভালো লাগতেই হবে এমন কোন কথা নেই।তবে গভীর রাতের ঝিরঝিরি বৃষ্টির মধ্যে একটা পবিত্র ভাব আসে।আমার হুজুর বলতো ওটা জান্নাত থেকে আল্লাহ খুশি হয়ে আমাদের জন্য দেয়”।
রাত আটটা বেজে সাত মিনিট তখন।আমি হেনরী সাহেবের King Solomon’s Mine বইটা পড়ছিলাম।ঠিক তখন ব্যাপারটা হলো।আমার চারপাশ ভয়ংকর অন্ধকার হয়ে গেলো। অন্ধকার এতোটা ভয় জাগাতে পারে আমি কখনো বুঝিনি।কেন যেন টেবিল থেকেও উঠতে পারছিলাম না।অন্ধকার হওয়ার আগে যে প্রকান্ড শব্দটা হয়েছিলো তা আমার গলির মাথার ট্রান্সফর্মারের তা আমি ভালোই বুঝতে পারলাম।যতদূর মনে হয় আজকে আর বিদ্যুৎ বাবুর দেখা পাওয়া যাবেনা।একটা নিশ্চুপ সময় পার হলো, আমি মায়ার কথা অনেক ভাবলাম।আমার কেন যেন আজ মায়ার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছে।ঠিক এই সময়টা, এই মুহূর্তটা আমি তাকে দিতে চাই।তার সাথে কথা বলতে চাই।
পুরো আধঘন্টা আমি মায়াকে ফোনের পর ফোন দিতে থাকলাম।কিন্তু শুধুই ব্যস্ততার সংকেত, এতো কথা কার সাথে তার।আমি খুব বিরক্ত হলাম।ফোন ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিছানায় চুপ করে শুয়ে পড়লাম।হাতে একটা সাদা অফসেট কাগজ নিয়ে কবিতাকে ভাবতে থাকলাম।আমার কাছে কবিতা ব্যাপারটা ভয়ংকর ভালোবাসার।আমার বাবা যখন অনেক ছোটকালে চাকরী শেষে বাসায় ফিরে আসতেন আমরা ভাই বোনরা তখন গোল হয়ে বাবাকে ঘিরে বসতাম কবিতা শোনার জন্য।বাবা এত সুন্দর করে আবৃত্তি করতেন আমরা সব তব্দা খেয়ে যেতাম এক একটা কবিতা শেষে।বাবা চলে গেছেন আমাকে ছেড়ে, তার কবিতাগুলো , ভরাট গমগমে কন্ঠস্বরটা এখনো বুকে ঝনঝন করে বাজে।আমি ও আমার পরিবার একসময় দেশের একমাত্র পাহাড়ী দ্বীপ মহেশখালিতে থাকতাম।বাবা মাঝে মাঝে আমাদের ছোট্ট নদী কোহেলিয়ার পারে নিয়ে যেতেন।এই ছোট্ট নদীটা আমাদের কাছে সমুদ্রের মতই বড় ছিলো।আমরা তিন ভাইবোন হাত উচু করে ঝড়ো বাতায়ন স্পর্শ করার চেষ্টা করতাম।তা দেখেই একদিন বাবা একটা কবিতা লিখেছিলেনঃ
"একটা ঝড়ো বাতাস আজ তাদের ঘিরে আছে
তারা সেই ঝড়ো বাতাসকে ছুয়ে দিতে চায়
চায় তার বন্যতাকে অনুভব করতে
তারা ভুলে গেছে এর থেকে বড় টগবগে ঝড়
বাস করে ঠিক তাদের কোমল বুকে
সন্তানেরা বড় হোক, এই ঝড়টা নিয়ে বেচে থাকুক"
বাবাকে অনেকবার বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো, ৯১ এর ১৯ এপ্রিলের ঝড়ে যখন আম্মু আর আমার দু ভাই বোনকে নিয়ে বাবা হারিয়ে যান তখন থেকে এই ঝড়টা আমার বুকে প্রতিদিন ভয়ংকর গর্জন করে উঠে।এখনো মনে পড়ে টিনের চালে আমি যখন হাটুর মধ্যে মাথা গুজে বসে ছিলাম আমার দু ভাইবোনকে নিয়ে তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের কি কান্না।মা আর বাবা চালের সাথে ভর দেয়া একটা কাঠ জড়িয়ে ধরে মহাকাল অতিক্রম করছিলো।এক একটা জলোচ্ছাসের আছড়ে পড়া ঢেউ আমাদের ভিতরটা কাপিয়ে দিচ্ছিলো।সাড়ে চার বছরের আমি বুঝতে পারছিলাম একটা বিশাল ঢেউ যেকোন সময় আমার আদরের মা, ভালোবাসার বাবাকে কেড়ে নিতে পারে। বাবা আমাদের চিৎকার করে বলছিলেন, “আমার বাচ্চারা সাহস করি বসে থাক।কিচ্ছু হবেনা।ঝড় থেমে যাবে”।
ঝড় থামেনি।চারদিকের গহীন অন্ধকারের মাঝে একটা বিশাল বড় ঘূর্নি আমার বাবাকে আছড়ে নিয়ে যায়।আমার মা হঠাৎ যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলেন।আমাদের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “তোরা হারায় যাসনা।তোদের বাচতে হবে”।
আমরা তিন ভাইবোন তখন চিৎকার করে কাদছিলাম।আমাদের দমকে দমকে কান্নার আওয়াজ ঝড়ের মাঝে চাপা পড়ে যায়, কিন্তু আমরা থেমে থাকিনা।একটা সময় মাকে আরেকটা ঝড় যখন টেনে নিয়ে যায় তখন আমি ঠিক মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।মায়ের চোখে সেকী গভীর বিষাদ।আমাদের মাত্র একটা শেষ মুহূর্তের চাহনীতে আমি অনুভব করেছিলাম মায়ের মাঝে আমাদের হারিয়ে ফেলার বিশাল শূন্যতা।প্রিয় মা, আমাদের জন্য তোমার বুকে যে প্রবল ভালোবাসাটা ছিলো আমি সেটা খুব অনুভব করি আজো।সে ভয়ংকর রাতে সাগর ভাইয়া আর সুমি আপুও হারিয়ে গিয়েছিলো।আমাকে কেন আল্লাহ সারাটা ঝড়ে আগলে রেখেছিলো জানিনা।কেন আমি বেচে ছিলাম তা এখনো বুঝতে পারিনা।আমি যখন সৃষ্টি নামের এন.জি.ওতে আশ্রয় পেয়েছিলাম, আমাকে যখন সবাই না খেয়ে থাকার জন্য ধরে ধরে মারতো আমি তখন শুধু আমার মায়ের কথা ভেবে বাচতাম।যে প্রচন্ড ভালোবাসা সেদিন আমি তার চোখে দেখেছিলাম হাজার বছর এই ভালবাসাটা আমার বুকের মধ্যে জ্বলজ্বল করবে।এটা কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা।
পরদিন ঠিক বিকেলে আমি মায়ার পাশে বসে আছি গভীর মুগ্ধতা নিয়ে।মায়া আজ তার চোখে খুব সুন্দর করে কাজল দিয়েছে।আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখি এবং প্রতিবার ধরা খাই।মায়া মিষ্টি করে হেসে বলে, ভালো করে আমাকে দেখ।আমি আজকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর রমনী।আমার জন্য ফিদা হয়ে যা ছেলে।
অন্য সময় হলে আমি তাকে হয়তো অবজ্ঞার সুরে কিছু বলতাম।আজ বলা যাবেনা।কারণ তাকে একটা মুগ্ধতার গল্প শোনাতে হবে।আমার বয়স যখন সাত বছর তখন আমি যে এন.জি.ওতে বাস করছিলাম সেখানকার এক কেরানী আমাকে তার বাসায় নিয়ে আসেন।উনি আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন কারণ উনার কোন ছেলে মেয়ে ছিলোনা।আমার পালক বাবা এবং মা আমাকে যতটুকু প্রয়োজন তার থেকে বেশি ভালোবেসেছেন।তবে আমার পালক বাবা কবিতা লিখতে পারতেন না।তাই আমি যখন কবিতা লিখে তাকে শুনাতাম সে অদ্ভূত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন।কক্সবাজার সরকারী কলেজ থেকে পাশ করে আমি যখন ঢাকা শহরে আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে তিনি সেদিন আমাকে তার জীবনের প্রথম লেখা কবিতাটা শুনিয়েছিলেনঃ
“কলম হাতে আমার ছেলে দূরদেশে যায় কি যেন পড়তে
জানিনা আমি আর তার মা পারবো কেমনে তাকে ছাড়া থাকতে”
আমি বাবার কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে আমার সবচেয়ে সুন্দর কলমটা উপহার দিয়ে এসেছিলাম।আজ ভাবছি মায়াকে এই সব গল্পগুলো শোনাবো।আমার জীবনের এইসব গল্পগুলো তাকে প্রায়ই বলতে ইচ্ছা করেছে, কিন্তু বলতে পারিনি।মাঝে মাঝে কবিতা লিখে লিখে তাকে শুনাতাম, সেই কবিতায় আমার জীবনের কিছু অংশ থাকতো।মায়া আমার কিছু পছন্দ না করলেও আমার এই কবিতাগুলো খুব পছন্দ করতো।আমাকে কতবার আবেগী হয়ে বলেছে আমি নাকি অনেক বড় কবি হবো।আমি লজ্জা পেয়ে হাসতাম।ঠিক এই মুহূর্তে আমার সত্যি নিজেকে কবি কবি মনে হচ্ছিলো।কারণ তার জন্য আমি একটা কবিতা লিখে রেখেছিলাম।এই কবিতাটা যদি সে একটা মুহূর্তের জন্যও হৃদয়ে ধারণ করতে পারে তবে সে জানবে আমার তার প্রতি খুব খুব ভালো লাগার কথা।
মায়া আর আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলাম আমাদের প্রিয় পার্কের বেঞ্চিতে।মায়াই প্রথম কথা বললো।আমাকে একটা অদ্ভুত কথা শোনালো, “আচ্ছা তুই কখনো কারো জন্য পাগল পাগল বোধ করেছিস?”
আমি মাথা নাড়ি।এর অর্থ অবশ্যই।মায়া আবার বললো, “গুড।তাহলে তুই ব্যাপারটা বুঝবি।আমি না শাফকাত নামে একটা ছেলের জন্য আজকাল পাগল পাগল বোধ করি।কাল সারা সন্ধ্যা সারা রাত্রি তার সাথে কথা বলছি, কিন্তু পাগল পাগল ভাবটা যাচ্ছেনা।খুব তার পাশে বসে থাকতে ইচ্ছা করছে।শেষ শুক্রবারে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো।জানিস আমার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা চোখের পানি ফেলছিলো”।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”
মায়া হাসলো।আমাকে বললো, “আমিও অবাক হয়ে ভাবছিলাম কেন।সে নিজেই বললো আমাকে নাকি তার এত সুন্দর লাগে যে সহ্য হয়না।চোখ দিয়ে পানি পড়ে যায়।আমাকে মাত্র দু মাস হলো সে চিনেছে জেনেছে।কিভাবে তাকে আমার আর আমাকে তার এতো ভালো লাগে আমি বুঝতে পারছিনা।রাতে ঘুমাতে পারিনা জানিস অনেকদিন।ঘুমাতে গেলে তার কথা মনে পড়ে।তাকে খুব মিস করি”।
আমি মায়ার পাগল পাগল ভাব ধরা মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, “খুব ভালবাসিস তাই না”?
মায়া মাথা নাড়ে।আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলে, “আমাকে এমন করে চায় যেন আমি শুধু তার জন্য বেচে আছি।শোন, তুই কাউকে এই কথা বলবিনা।পরের সপ্তাহে ওর বাবা মা আমাদের বাসায় আসবে।সব কিছু ঠিকঠাক হোক তারপর জানাজানি হলে সমস্যা নাই”।
পরের সপ্তাহে মায়ার বিয়ে হয়ে যায় শাফকাত নামক দূরদেশের একটা চমৎকার ছেলের সাথে।শাফকাত ভাই বিয়ের দিন আমার কাধে হাত দিয়ে বলেছিলেন, “ভাইয়া তোমার দুই একটা কবিতা আমি পড়ছি।তুমি তো একটা বিশাল এপিক।তুমি ভুল করেও কখনো কবিতা লিখা ছাড়বানা”।
আমি বেশ লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বলেছিলাম, “আচ্ছা”।
মায়ার সাথে শেষ কথা হয়েছিলো ফোনে।বিয়ের এক সপ্তাহ পর ও গ্রীসে চলে যায়।ওখানের একটা ইউনিতে ও ভর্তি হবে বলে ঠিক করেছিলো।আমাকে ফোন করে সে বেশ লাজুক ভঙ্গীতে বলছিলো, "শোন ঠিকমত নিজের খেয়াল রাখবি।আমি কাউকে জানাইনি চলে যাওয়ার আগে।সবাইকে বলিস মাইন্ড না খাইতে।আমি নেক্সট ইয়ার ঈদে ইনশাল্লাহ আসব এবং সবার জন্য বিশাল বিশাল গিফট নিয়ে আসব"।
আমি তখন ভাত খাচ্ছিলাম।ওই অবস্থায় কোনরকমে ঢোক গিলতে গিলতে বললাম, তুই নিজেই একটা বিশাল গিফট।অন্য কিছু আনতে হবেনা।
মায়া হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেলো।আমাকে মিন মিন করে বললো, “বুঝলি আমাকে শাফকাত কি ভয়ংকর ভালোবাসে।আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাবো।এমন করে কেউ কাউকে কখনো চাইতে পারেনা”।
আমি কথাটা শুনে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।আমি এতদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।আজ এই কথাটা শোনার পর কে যেন মনে হলো আমার ভেতর গরম জল ঢেলে দিয়েছে।তপ্ত উত্তপ্ত সেই জলে আমার ভেতরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গলে যাচ্ছিলো।আমার ২২ বছরের জীবনে কখনো বাধ ভেঙ্গে কিছু করিনি।আজ করলাম।মায়াকে আস্তে আস্তে বললাম, “মায়া কথাটা ঠিক না,কে বলেছে এমন করে কেউ কাউকে চায়না”।
মায়া একটু রেগে বললো, “হ্যা চায়না।আমি জানি।আমার সাথে তর্ক করিসনা”।
আমি ওকে একটু ফোনটা ধরতে বলে কাল রাতে লেখা কবিতাটা নিয়ে আসলাম।ওকে বললাম, আমার শেষ কবিতাটা শোনঃ
“একটা জলোচ্ছ্বাস আমার মাঝে বেচে থাকতে চায়
সে আমার কবিতায় উঠে আসতে চায় সব তছনছ করে
আমি হাজার বছর তোমার জন্য সেই জলোচ্ছ্বাসটা লুকিয়ে রেখেছি
প্রিয় মায়া তোমার জন্য কবি হয়েছিলাম, আজ হবো নষ্ট”
আমার মোবাইলের সিমটা এরপর খুলে ফেলে দিয়েছিলাম।মায়াকে আমি কিছু বলার সুযোগ দেইনি।আমি বুঝতে পারছিলাম এই কাজটা হয়তো ঠিক হয়নি।কি দরকার ছিলো কাউকে কিছু বোঝানোর যে নিজে থেকে বুঝতে পারেনি।আমার মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিলো, কেউ মায়াকে অনেক বেশি চায়।আমি মানতে পারছিলাম না সেটা আমার শেষ চার বছরের থেকেও বেশি কিছু হতে পারে।আমার ভেতর জেদ কাজ করছিলো।মনে হচ্ছিলো আমার থেকে বেশি তাকে কেউ চায় এটা কেমন করে হয়।বাবার বলা সেই ঝড়টা আবার আরেকবার জেগে উঠলো।আমি আরেকটা কবিতা লিখতে বসলাম।
বছর দুই কেটে গেছে।মায়া আমার মাঝে আরো জেকে বসে গেছে।আমার এখন মায়ার কথা ভাবলে খুব যন্ত্রণা হয়।ভার্সিটি ছেড়েছি কয়েক মাস হলো।এখন একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করছি।আমার কাজ সম্পাদক সাহেবের লেখা পড়ে তার বানান ঠিক করা, অন্য সিনিয়র সাংবাদিক স্যারদের লেখাগুলো শুদ্ধ করে দেয়া।সারাদিন টাইপিং করতে হয় অনেক কিছু।মাঝে মাঝে আমার দু একটা কবিতা যায় সাহিত্য পাতায়।এই ব্যাপারটা আমার ভার্সিটির বন্ধু আরমানের অবদান।আমি নিজে থেকে কখনো কিছু ছাপতে দেই নাই।আরমান আমার কবিতা নিয়ে ছেপে দেয়।সম্পাদক তার আপন মামা, সেক্ষেত্রে তার বেশ প্রভাব কাজ করে অফিসে।আমার এই চাকরীটা ভালো লাগছেনা।কিন্তু বাচার জন্য, পেটটাকে শান্ত রাখার জন্য, রাতের বেলা একটা বালিশে মাথা দেয়ার অধিকার পেতে কিছু না কিছু তো করতেই হবে।
মজার ব্যাপার হলো, আমার কবিতাগুলো অনেকের ভালো লেগে গিয়েছিলো।প্রায়ই আমি অজানা অনেক ফোনকল পাই যারা আমার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতো।একটা বিশেষ ফোন পেয়েছিলাম একদিন।খুব মিষ্টি কন্ঠের একটা মেয়ে একদিন ফোন করে বললো, “আপনার কবিতা পড়লেই না একটা ঝড় ঝড় ভাব হয়।এই ঝড়টা কাউকে না পাওয়ার অথবা সবকিছু না পাওয়ার।আমার ভেতর এমন একটা ঝড় আছে জানেন?”
আমি চুপ করে শুনছিলাম।কথা বলতে ইচ্ছা করছিলোনা।কেউ আমার ভেতরটা অনুভব করুক এটা আমি মানতে পারছিলাম না।আমি তাকে একসময় কথা থামিয়ে বলেছিলাম, “এমন কোন ব্যাপার নেই।আপনার ভুল হয়েছে”।
মেয়েটা একটু দুঃখ পেয়ে বললো, “আছে।এমন কিছু একটা আছে।আমি বলি শুনুন।আপনার ভিতর একটা বিশাল ঝড় লুকিয়ে আছে।আপনি তাকে আটকে রাখতে পারবেন না।এটা বের হবে, পুরো পৃথিবী তছনছ করে দেবে।আপনার এই ঝড় সবার মাঝে আঘাত করবে।আমি বলছি এমন কিছু একটা হবে, দেখবেন এমন কিছু একটা হবেই”।
আমি ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম।তার সাথে আর কখনো কথা হয়নি।
হা আমার মায়ার সাথেও আর কখনো কথা হয়নি।মায়া আমাদের বন্ধুবান্ধবকে ফোন দিয়ে আমার কথা জানতে চায়নি তা না।আমি সবাইকে বলে দিয়েছিলাম যেন আমার কাছে কেউ মায়াকে নিয়ে কিছু না বলে।মায়াকেও যেন আমার ব্যাপারে কিছু না জানানো হয়।বন্ধুরা কথা রেখেছিলো।আমি এখনো অনুতপ্ত বোধ করি মায়াকে কবিতাটা শোনানোর জন্য।এমনটা না করলেও হতো।আজ হয়তো মায়া আমার জন্য করুণা বোধ করে, এমনটা কখনো কি ভেবেছিলাম?
এই বইমেলায় একটা খুব অদ্ভুত ব্যাপার হলো।আমার একটা কবিতার বই বের হলো।আমি নিজেও বের হওয়ার দুদিন আগে ব্যাপারটা জানতামনা।যখন জানলাম তখন একটু রাগ হয়েছিলো।আমার নিজের কবিটাগুলো খুব একান্ত ছিলো।আমি কখনো তা প্রকাশ করতে চাইনি।আমি রাতের পর রাত আমার উত্তর আধুনিক কবিতাগুলো লিখেছি।আমি কোন মিত্রাক্ষর মানিনি, ছন্দ প্রকরণ আমার হজম হয়না।স্বরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত অথবা অক্ষরবৃত্ত্ ব্যাপারটার প্রতি কোন তোয়াজ আমার ছিলোনা।আমি কখনো সনেট কখনো লিমেরিক লিখেছি।কখনোবা নিজের মত যা মনে চেয়েছে লিখার চেষ্টা করেছি।এই একান্ত কবিতাগুলো ছাপার কাজটা করেছে নাম না জানা আমার এক পাঠক।আমার যে কবিতাগুলো পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিলো সবগুলো সে একসাথে জড়ো করে বইটি প্রকাশ করলো।আমাকে একদিন ছুটির দিনের দুপুরে ফোন করে বললো দেখা করতে।আমার কবিতার বইটার একটা কপি সে আমাকে দেখা চায়।যদি পছন্দ হয় সবকিছু তাহলে সে প্রকাশ করবে।কেন যেন মনে হলো আমার কবিতার এই পাঠকটা সেই মেয়েটা যে আমার ঝড়কে অনুভব করেছিলো।আমার সাথে যখন তার দেখা হয়, ধারণাটা সত্য বলে প্রমাণিত হলো।আমার থেকে বছর দুয়েকের বড় একজন বেশ রুচিশীল মানুষ।আমাকে একটা কফি হাউসে নিয়ে বসে বলেছিলো, “প্রিয় কবি আপনি নিজেও জানেননা আপনি কতটা সুন্দর করে মানুষের ভেতরের সত্ত্বাটাকে প্রকাশ করতে পারেন।আমি জানি আপনি শুধু নিজের জন্য লিখেন।কিন্তু শুনুন, এই লেখাগুলো আপনার কলমের তুলিতে আপনার ভাবটা বোঝানোর জন্য হলেও তা আমার মত অনেকের হৃদয়ে দাগ কেটে যায় প্রবলভাবে।এই কবিতাগুলো মানুষের আত্নার প্রকাশ।এমন কিছু শুধু নিজের মাঝে না লুকিয়ে রেখে আমাদের একটু দান করুন।শুনেছি, যারা মহান কবি তারা পৃথিবীর জন্য অক্সিজেন।আপনি বিশ্বাস করেন, এই কথাটা আপনার জন্য বললে কোন ভাবেই অত্যুক্তি হবেনা।সুকান্ত বাবু আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে রবি ঠাকুরের কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন তিনি যে নতুন ছন্দধারা প্রকাশ করেছিলেন পয়ার ত্রিপদীর ভাবধারাকে হটিয়ে তা নতুন কবিত্বের জন্ম দেবে।আপনি আবার আরেকটা কবিত্বের সূচনা করবেন।আমাদেরকে তাতে শরীক করুন।আমরা আপনাকে এবং আপনার কবিতাকে প্রচন্ড ভালোবাসি।এমনকি কলকাতায় আমরা আমাদের ছোট্ট তরুণ কবি সংঘে আপনার কবিতাগুলোর অস্ত্রোপাচার করি।তার মাঝে যে সুরটা ঝড় তুলতে চায় তা নিয়ে আমরা ভাবি, ঝড়টার গতিপথ বুঝতে অশেষ বেগ পেতে হয় যদিও আমরা তবুও তাকে আকড়ে ধরে থাকি।হারাতে দেইনা।কবি আমাদের মাঝে একদিন নিমন্ত্রণ পেলে আসবেন কি?”
সুনীতি আমার সাথে এরপর রাতের পর রাত জেগে কবিতা শুনেছে।সে প্রায় সময় বাংলাদেশে এসে পড়তো শুধু আমার সামনে বসে আমার আবৃত্তি শোনার জন্য।আমি কখনো কোন প্রতিযোগীতা করিনি আবৃত্তির জন্য।আমার খুব কাছের মানুষ ছাড়া আমি কখনো কাউকে আবৃত্তি করে আমার কবিতাগুলো শোনাইনি।সুনীতি অনেকবার আমাকে জোরাজুরি করেছে তার দেশে যাওয়ার জন্য, আমি বারবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি।কোন একদিন আমার খুব কাছে বসে আমার মাথায় হাত দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “কবি আপনি একবার চলুন,আমার দেশটা আপনাকে দেখাই”।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে বলেছিলাম, “সুনীতি এই দেশের বাতাসটা আমার প্রাণ।আমি এর থেকে দূরে গেলে বেচে থাকবো কিন্তু ভেতরের আত্নাটা আর শ্বাস নিতে পারবেনা।আমার কবিত্ব শুধু এই দেশের এই নগরীর ইট পাথর জঞ্জাল, কখনোবা দুরন্ত বিশাল সমুদ্র, আবার কখনো কখনো কুয়াশায় ঘেরা সবুজ গ্রামগুলোর জন্য বেচে থাকে।এটা অন্য কোথাও প্রস্ফুটিত হবেনা।ক্ষমা চাচ্ছি”।
সুনীতি আমাকে অনেক সময় দিতো, আমাকে সে কবি বলে ডাকতো।আমার একটার পর একটা কবিতার বই সে বের করেছিলো।কেন জানি অনেকে এই কবিতাগুলো পছন্দ করেছিলো।আমার কাছে দিনে অসংখ্য ফোন আসতো।আমি এসব কিছু এড়িয়ে চলেছি দিনের পর দিন।অসংখ্য প্রকাশক আমার সাথে দেখা করতো, আমাকে বলতো আমার লেখা বইটা প্রকাশ করতে চায়।আমি তাদের সবাইকে মানা করে দিতাম।শুধু সুনীতিকে মানা করতাম না।ওদের ধর্মে মানুষ পুজো করা যায়।আর আমি ওর জন্য সবচেয়ে বড় দেবতা ছিলাম।২০০৪ এর শেষের দিকে আমি ওকে বিয়ে করছিলাম।ওর পরিবারের সবার সব মতবাদকে উপেক্ষা করে ও আমার জন্য সব ছেড়ে চলে এসেছিলো।বিয়ের রাতে সে ভয়ংকর কান্না করেছিলো।আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কাদছো কেন?এমনটাই তো চেয়েছিলে তাই না?”
সুনীতি আমাকে বললো, “আমি আমার কবিকে এখন থেকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখবো।এই অনুভূতিটা আপনি বুঝবেন কি না জানিনা।বুঝতে পারলে আমাকে একটা কবিতা লিখে দেবেন অনুরোধ রাখছি”।
সুনীতি একজন আদর্শ স্ত্রী ছিলো আর আমি একজন জঘন্য স্বামী।আমি শুধু তার ভয়ংকর আগ্রহের জন্য তাকে বিয়ে করেছিলাম, ভালোবাসতে পারিনি।তাকে জ্ঞাতে অজ্ঞাতে অনেক অবজ্ঞা করেছি, কিন্তু সে কখনো কোন অভিযোগ করেনি।আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন সবকিছু সে মেনে নিয়েছে?
সুনীতি বলেছিলো, “কবিকে ভালোবাসি তাই”।
আমি কখনো তাকে মায়ার কথা বলিনি।সে অনেকবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, আমার না পাওয়ার কথাটা বলার জন্য।আমি তাকে বলার আগ্রহ পাইনি।
এভাবেই সাতটা বছর পার হয়ে গিয়েছিলো।একদিন আমার পত্রিকা অফিসে গিয়ে দেখলাম, আমার টেবিলে DHL এর কুরিয়ারে আসা একটা নিমন্ত্রণ পত্র।নিমন্ত্রণ পত্রটি এসেছিলো, British Poetic Society থেকে।তারা এবছর এথেন্সে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কবিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে।এই বিশাল কবি সংঘে বাংলাদেশ থেকে দুজন কবি আমন্ত্রন পেয়েছেন যার মধ্যে একজন আমি।এথেন্স আর গ্রীস শব্দটা শুনে আমি দুবার ঢোক গিললাম।আমার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হলো, “মায়া”।
বাসায় যেয়ে সুনীতিকে বললাম, আমি সেখানে যাবো।সুনীতি খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো।আমাকে বললো, “তুমি তো কখনো এমন কোথাও যাওনা।এত দূরে আজ যেতে চাচ্ছো কি করে?”
আমার মধ্যে সুনীতির জন্য কখনো কোন প্রগলভতা কাজ করেনি।আমি তাকে মিথ্যা বলতে পারিনি।তাকে বললাম, “আমি একজনকে প্রতিদিন মনে করি।সে ওই দেশে থাকে।তাকে দেখার লোভ হচ্ছে জানো।তাকে কিছু কথা বলার দরকার।আমাকে যেতেই হবে”।
সুনীতি আমাকে বাধা দেয়নি।আমি জানতাম সে দেবেনা।মায়ার বর্তমান ঠিকানা আমাকে অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করতে হয়েছিলো।আমাদের যেই শহরে সম্মেলন হবে তার থেকে তার ছোট্ট শহরটা খুব বেশি দূরে নয়।এক ঘন্টার ড্রাইভ।
বাংলাদেশ থেকে যে আরেকজন কবিতা অন্তপ্রান মানুষ আমার সাথে গিয়েছিলেন তাকে দেখে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলাম।নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়েছিলো।বিশেষ কারণে তার নামটা উল্লেখ করতে পারছি না।তার পা ছুয়ে আমি যখন সালাম করি, তিনি আমাকে ঠিক সেভাবেই সালাম করতে গিয়েছিলেন।আমি ভয় পেয়ে সরে যাই।তিনি আমাকে বলেছিলেন, “কবি জাতির মধ্যে কোন বড় ছোট নেই।আপনি আমাকে সম্মান দেখালেন মিতা, আমাকেও একটু দেখাতে দিন”।
ভয়ংকর শীতে আমি একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে যখন মায়ার শহরের দিকে রওনা হই তখন অনেক রাত।আমার এছাড়া উপায় নেই।কারণ কাল দুপুর থেকে সম্মেলন শুরু হবে।এরপর রাত ১০টায় আমার ফ্লাইট।আমি নিজেই এতো তাড়াহুড়ো করে দেশে ফেরার টিকেট করেছি।ঠান্ডার দেশ আমার ভালো লাগেনা।প্যারিস্টোরিয়নের সবুজ রাস্তা ধরে আমি যখন ড্রাইভ করে আস্তে আস্তে এগোচ্ছিলাম তখন হালকা তুষার ছিলো চারদিকে।মায়ার সাদা বাড়িটা সেই সবুজ রাস্তার একটা ধারে।আমি ঘড়ি দেখলাম।ভোর চারটা বাজে তখন।ইতস্তত ভাব নিয়ে যখন ওর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ডোরবেলটা চাপ দিয়ে ধরলাম আমার ভেতরের হৃৎপিন্ডটা তখন ঢিপ ঢিপ করছে।আমি আমার সবগুলো কবিতা যে মানুষটার জন্য লিখেছিলাম আজ তাকে এতগুলো বছর পরে আবার দেখবো।তার মুখের বলীরেখা হটিয়ে আমি কি সেই মায়াকে দেখতে পাবো যার চোখে আমি কবিতা খুজতাম।তাকে জানানো যাবে কি আজ, যে তার সাথে কাটানো প্রতিটা শব্দ ভরপুর বিকেলের শেষে একটা করে কবিতা রচনা করতো।সেগুলো কখনো কেউ দেখেনি, কেউ জানেনি।আমি আজ এসেছি তাকে উৎসর্গ করে লেখা কবিতার বইটা উপহার দিতে।আমার কখনো এতো দূর দেশে আসার সামর্থ্য হতোনা।আজ এই অভাবনীয় সুযোগটা না পেলে কোনদিন হয়তো আসতেও পারতাম না।
দরজাটা খুলে দিয়েছিলো একজন মুটিয়ে যাওয়া শাফকাত।আমাকে সে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও চিনতে পারলোনা।মায়ার কথা জিজ্ঞেস করলে উনি একটু অপেক্ষা করতে বললেন।জানলাম মায়া একটু অসুস্থ।আমাকে উনি মায়ার রুমের কাছে নিয়ে গেলেন।আমি যখন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকি তখন মায়া ঘুমাচ্ছে।আমি পাশে বসে শাফকাত সাহেবকে বলি, “আমি ওর পাশে বসে থাকি নাহয়।ওর ঘুম ভাঙ্গার জন্যে একটু অপেক্ষা করতে কোন সমস্যা নেই”।
শাফকাত সাহেব হালকা হাসি দিয়ে বললেন, “আপনি সেই অর্ক যার কথা প্রায় দিন আমাকে ও বলে।ও আমাকে বলেছিলো আপনি আসবেন”।
মায়া যখন ঘুম থেকে উঠে আমাকে দেখলো তখন মনে হয় ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।বুঝে উঠার সাথে সাথে চিৎকার করতে লাগলো।আমাকে বললো, “এতদিন পর তুই কোথা থেকে এসেছিস?”
আমি ওর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললাম, “আমাকে এখুনি চলে যেতে হবে।তোকে আমার একটা কবিতার বই দিতে এসেছিলাম।এই বইটা আমি তোকে উৎসর্গ করেছিলাম”।
মায়াকে বইটা দেয়ার পর ও আমার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো।
আমি যখন উঠে যাচ্ছিলাম তখন ও আমার হাত ধরে টেনে বসালো।আমাকে বললো, আমি তোকে অনেক খুজেছিলাম পরে।জানিস প্রতিবছর ভাবতাম দেশে যেয়ে তোকে খুজবো।সত্য বললে তোর সাথে দেখা করবার বা কথা বলার সাহসটা আমার কখনো হয়নি।তুই আমাকে অনেক ভালোবাসছিলি তাই না?”
আমি মায়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।তাকে বললাম, “আমরা মানুষ তো তাই না।ভালোবাসতেই পারি একজন আরেকজনকে।আমার এর জন্য কোন অপরাধবোধ হয় না।এত বছর পর এগুলো নিয়ে কথা তুলতেও চাইনা”।
মায়া আমার হাত ছাড়েনা।আমার দিকে একটা গভীর বিষাদ নিয়ে তাকিয়ে বলে, “আমি তোর সবগুলো কবিতা পড়তাম।তোর সবগুলো বই আমার কাছে আছে।এই যে এই বইটা নিয়ে আসছিস এটাও আমার আছে।পিছনে তাকিয়ে দেখ একটা বুকশেলফ আছে।তোর সবগুলো বই ওখানে”।
আমি অবাক হয়ে মায়ার দিকে তাকাই।তাকে সাহস করে বলি, “সেদিন তুই আমাকে যখন বললি কেউ কাউকে ওভাবে চাইতে পারেনা আমার ভেতরটা তখন জ্বলে গিয়েছিলো”।
মায়া আমার কথা শেষ করতে দেয় না।আমাকে বললো, “তুই আমাকে আসলে বইটা দিতে আসিসনি।তুই আসছিস একসময় আমাকে যে প্রচন্ড ভালোবাসতি এই কথাটা বলতে তাই না?অর্ক তোর এটা বলা লাগবেনা”।
হঠাৎ করে মায়া খুব কাদতে থাকে।আমাকে আবারো বলে, “তুই চলে যা।আমার সাথে কখনো দেখা করতে আসবিনা।তুই এখন আমাকে এটা বুঝাতে আসছিস।যখন আমাকে বলার দরকার ছিলো তখন কেন আসিস নাই?আমি তোর প্রত্যেকটা কবিতা পড়ি আর অপরাধবোধে ভুগি”।
আমি উঠে দাড়াই।আমার চলে যেতে হবে।চলে যাবার আগে মায়াকে বলি, “আর আসবোনা। অনেক ভালো থাকিস।তোর কাছে আমি আসলে অনেক কৃতজ্ঞ।আমাকে তুই কবি বানিয়েছিস। বিশুদ্ধ হতে পারিনি এখনো, অপেক্ষায় আছি তা হওয়ার”।
মায়া আমার দিকে খুব ভালোবাসা নিয়ে তাকায়।খুব হালকা স্বরে বলে, “আমাকে একবার সেই সময়ে ভালোবাসাটা জানাতে পারতানা? আমি অনেক অপেক্ষা করেছিলাম তোমার জন্য।অনেক দিন ভেবেছিলাম তুমি কিছু একটা বলবে।একসময় ক্লান্ত হয়েছি,মনে হয়েছে তুমি আমাকে কখনো চাইবেনা।আমি শুধুই তোমার একজন কথা বলার সঙ্গী।যখন তোমার থেকে দূরে চলে গেলাম ঠিক তখন তুমি তোমার কবিতাগুলো আমার জন্য লিখলে।তুমি আজকের এই সময়টার জন্য দায়ী।আমি না।যাও আমার সামনে থেকে, আর আসবেনা।কোনদিন না”।
ভোরের আলো ত্খন ময়ুরের মত পেখম মেলে আমার সামনে তার সোনালী সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়েছে।আমি তাতে স্নান করি সকল জড়তাকে মুছে ফেলে।আমার ভেতরে দমকে দমকে কান্না আসতে চায়।এই কান্নাকে একটায় কবিতায় লিখি না কেনঃ
“আমি তোমাকে দেখার জন্য কতখানি পথ পেরিয়েছি
তোমার বহু বছরের অপ্রাপ্তির ভাঙ্গা গালে সেই সময়টাকে খুজেছি
সময়ে মরচে ধরেছে, আখিতে জেগেছে নিশা
শুধু বেচে আছে অমলিন অক্ষত তোমার আমার চাওয়া পাওয়া
আর একটুকরো আমাদের পবিত্র ভালোবাসা”
নিজ হোটেলে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম বহু বছরের জীর্ণ শরীরটা নিয়ে। ঠিক তখন সুনীতির ফোন পেলাম।আমি ফোন ধরলে রুগ্ন কন্ঠের তার ডাক শুনলাম।আমাকে সে বললো, “নিজের খেয়াল রাখছো কবি?”
আমি জানিনা হঠাৎ কি হলো।সুনীতিকে এত আপন কখনো লাগেনি।
আমার দুইচোখে তখন প্রচন্ড আবেগের জল।মুখে বললাম, “তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।ভালোবাসতে ইচ্ছা করছে।এতোগুলো বছর তোমাকে অনেক অবহেলা করলাম, তারপরো তোমার আমার জন্য সেই প্রথম দিনের আকর্ষণটা এভাবে কেমন করে বেচে আছে?”
সুনীতি ফোনটা রেখে দিলো।তারপর পাচ মিনিট পর আবার ফোন করলো।কান্নাভেজা কন্ঠে বললো, “আমার তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।আমাদের ছোট্ট দুই রুমের বাসাটা তোমার অভাবে জ্বরাক্রান্ত।আমার ভেতরটা তোমার কন্ঠে কবিতা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে”।
আমি হাসলাম। তাকে বললাম,
“কবি তোমাকে আর কবিতা শোনাবেনা
কবিতার ব্যঞ্জনা তোমার কাছে হার মেনেছে
আজ তুমি সবচেয়ে বড় কাব্য
হাজার বছর যাকে অন্তরে ধারণ করে
কবি হয়ে ওঠে একজন মানুষ”
মায়াকে আমি অনেক চেয়েছি, নিজের সবকিছু উজাড় করে চেয়েছি।এই চাওয়াটায় কোন পাপ ছিলোনা, কোন চাহিদা ছিলোনা।তাকে হারানোর পর সে আমার ভেতরে আরো জায়গা নিয়েছিলো।আজ তাকে যখন এই চাওয়া পাওয়ার সম্যক রূপটা জানাতে গিয়েছিলাম তখন একটা ব্যাপার খুব অনুভব করি।আমি বুঝতে পারলাম, মায়া আমার কবিতার শ্বাস ছিলো।আমার ভেতরে বাস করা কবির জন্মদাত্রী ছিলো।আজ যখন মায়া তার ভালোবাসার রূপটা আমাকে দেখালো, আমার ভেতরের মানুষটা একটা অদ্ভুত শান্তি পেয়েছিলো।কবিকে পাশ কাটিয়ে এই মানুষটার বের হওয়া আমার জন্য একটা অভাবনীয় আবিষ্কার ছিলো।সে অনেকদিন হারিয়ে ছিলো।যখন তার পুনরায় জন্ম হলো, তখন একজন সুনীতি উপলুব্ধ হয়।কবিকে আমি মায়ার বুকশেলফে রেখে এসেছি, এখন একজন মানুষ হবার আকাংক্ষা।প্রিয় সুনীতি তোমাকে ধন্যবাদ।তুমি আমার-তোমার অজ্ঞাতে, আমার ভেতরের কবি ও তার মনুষত্ব্যকে ভালোবাসা দিয়ে বাচিয়ে রেখেছিলে।তাই আজ বাকী জীবনের সব কবিতা তোমাকে উৎসর্গ করলাম।
***********************************************************
একজন কবিকে নিয়ে লেখার জন্য অনেক অনেক দিন অপেক্ষা করেছি।আমার মত সস্তা লেখালিখি করা মানুষদের জন্য একজন কবিকে নিয়ে লেখা বিশাল পাপ হয়তো, তবুও এই পাপটা নির্দ্বিধায় ও স্ব-ইচ্ছায় করতে চেয়েছি।ক্ষমা চাচ্ছি, এই ছোট্ট গল্পে আমি কবিকে ঠিকমত প্রকাশ করতে পারিনি।আরো প্রকাশের দরকার ছিলো।খুব ইচ্ছা আছে, কখনো যদি কবিকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখার যোগ্যতা অর্জন করি তবে কবির আত্না ও তার পারিপার্শ্বিকতার উপর একটা বিরাট অস্ত্রোপাচার চালাবো।সেই দিনের জন্য কাক প্রতীক্ষায় আছি।