চতুর্থ হিজরি শতাব্দী!যে সময়ে মুসলিম বিশ্বের উপর চেপে বসেছিল এক মহাফিৎনা, এক বিরাট পরীক্ষা। এ ফিৎনা গোটা মুসলিমজাহানকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, চালিয়েছিল হত্যাযজ্ঞ। যে দেশ বা এলাকাই তাদের সামনে পড়ত, তা ধ্বংশস্তুপে পরিণত হতো।হয়ে যেতো বিরাণভূমি। এই মহাফিৎনা ছিল তাতারীদের ফিৎনা।
অনেক মুসলিম রাজা বাদশা ও রাষ্ট্র থাকা সত্ত্বেও সুদূর বিস্তৃত মুসলিম-জগতে এমন কেউ ছিল না, যিনি এ মহাফিৎনার মোকাবেলা করতে পারেন। মানুষের নিরাশা ছেয়ে গিয়েছিল, আশাহত হয়ে গিয়েছিল সবাই। এমনকি মানুষের মাঝে একথা প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল যে-" তোমাকে যদি এ কথা বলা হয় তাতারীরা পরাজিত হয়েছে, তা তুমি বিশ্বাস করোনা।"
তাদের সামনে যা পড়তো প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড়ের ন্যায় তছনছ করে ফেলতো।এ ভয়ানক বন্য বাহিনীর ধ্বংসলীলা বোঝার জন্য জৈনিক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকের উক্তিই যথেষ্ট। তিনি তাতার বাহিনীর নেতা চেঙ্গিস খান সম্পর্কে বলেছেন-" এই চেঙ্গিস খানের পথে যে শহর বা নগরই পড়তো ভূপৃষ্ঠ হতে সে সব মিটিয়ে দিত। দিনের ধারা সে পাল্টে দিয়েছিল ।তার আক্রমণের আতংকে শরণার্থী মানুষের ঢল নেমেছিল। মৃত্যু পথযাত্রী মানুষে ভরে গিয়েছিল দুনিয়া।
যেসব এলাকায় যুগযুগ ধরে মানুষ বসবাস করছিলো,তার ধ্বংসাত্মক আক্রমণের পর সেখানে ভূতুড়ে অবস্থা বিরাজ করতো। মনে হতো , সেখানে কোনদিন কোনও মানুষের আবাদ ছিল না। চারদিকে শোনা যেত কুকুর, বাঘ, চিল, শুঁকুনের উল্লাস চিৎকার ।"
নির্ধিদ্বায় যে কোনও ব্যপারে মানুষ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতো, পারতো সব বিষয়ে অনুমান করতে। কিন্তু এটি অবিশ্বাস্য ছিলো- এই তাতারীরা কোনদিন মুসলমান হবে।বিজিত মুসলমানদের ধর্মের উপর ঈমান আনবে। যে মুসলমানদের চেয়ে তাদের চোখে
লাঞ্ছিত ও নিকৃষ্ট আর কোন মানুষ ছিল না বৈচিত্র্যে ভরা এ পৃথিবীতে! জাতি তো বটেই। কিন্তু অবশেষে সেই অসম্ভব অবিশ্বাস্য ব্যাপারটিই ঘটে গেলো, আরশের মহান অধিপতির মহান কৃপায়। কাশগড়ের বাদশাহর ছেলে তুঘলক তায়মুর খান ছিলেন তৎকালীন যুবরাজ। তখনও তিনি রাজ্যের দায়িত্বভার নিয়ে রাজমুকুট পরেননি। যুবরাজের একটি সংরক্ষিত এলাকা ছিলো;যেখানে তিনি শিকার করতেন। সেখানে তার শিকারের কাজে সহযোগী অনুচর,পাচক, পরিচারকরা ছাড়া অন্যকারও প্রবেশের অনুমতি ছিল না। আর অন্য কেউ এই এলাকায় প্রবেশ করার মত দুঃসাহস দেখাতো না,কারণ এর জন্য নির্ধারিত ছিল কঠিন শাস্তি।
কিন্তু আল্লাহ তা'লার তরফ থেকে অদৃশ্যভাবে এমন এক ঘটনা ঘটানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল, যা উল্টে দেবে পৃথিবীর চলমান ইতিহাস, বদলে দেবে তুর্কিস্তানের তৎকালীন রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ।পাল্টে দেবে তাদেরও অনুগামী-যারা ছিল বিধ্বংসী বাহিনীর অনুচর।
যে ঘটনা তাদেরকে শিকারের নির্দিষ্ট এলাকা পাহারার দায়িত্ব থেকে তুলে দেবে চিরন্তন সৌভাগ্য রক্ষার পথে। ইসলাম ও মুসলমানদের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বে এবং বিস্তৃত রাষ্ট্র গড়ার কারিগরে। যার মানুষ হবে ইসলামের অনুগত। যেখানে উড্ডীন হবে ইসলামি পতাকা। যেখানে ধ্বনিত হবে বেলালের আজানের ধ্বনি।
একদিন শায়খ জামালুদ্দিন নামক বুজুর্গ বুখরা থেকে বের হয়ে তার সঙ্গী-সাথিগণ নিয়ে সফর করছিলেন।এমতাবস্থায় অজ্ঞাতসারে তারা তুঘলকের মৃগয়া শিকার ক্ষত্রে ঢুকে পড়েন।মুহূর্তেই রাজকীয় প্রহরীদের কানে সংবাদ পৌঁছে যায়।এই অপরাধে তাদের
সবাইকে দড়ি দিয়ে বেঁধে যুবরাজের সামনে হাজির করা হয়।এমনিতেই তাতারীরা পারস্যবাসীদের ঘৃণার চোখে দেখত। দরবারে হাজির করার পর যুবরাজ ও শায়খ জামাল উদ্দিন এর মধ্যে কথোপকথন হয়-
ক্রুদ্ধ যুবরাজ -তোমরা এ এলাকায় ঢোকার সাহস কোত্থেকে পেলে?
শায়খ -আমারা মুসাফির মানুষ ।না জেনে এখানে ঢুকে পড়েছি। আমরা যে একটি নিষিদ্ধ এলাকার উপর হাঁটছিলাম, তা জানতাম না।
যুবরাজ- তোমরা কোন জাতি?
শায়খ- আমরা পারস্য জাতি।
যুবরাজ- নিশ্চয় ইরানীদের চেয়ে কুকুরও অনেক ভালো।
এ মুহূর্তে আল্লাহ শায়খের অন্তরে সেই উত্তরটা জানিয়ে দিয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি অদৃশ্য ফয়সালা করে রেখেছেন। এই অর্থবহ উত্তরটাই অপরাজেয়দের জয় করে নেবে ,নত করবে পরাক্রমশালী বিজয়ীদেরকে। সেই উত্তর এই দ্বীনের প্রতি ঈমান আনার জন্য যুবরাজের অন্তর খুলে দেবে।
শায়খ - হ্যাঁ, যদি আমরা সত্যধর্মালম্বী না হতাম ,তাহলে আসলেই আমরা কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট ছিলাম।
শায়খের জবাব শুনে যুবরাজ হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন এবং নির্দেশ দেন,"আমরা যখন শিকার শেষে ফিরে আসব তখন এই ইরানীদের যেন আমার সামনে হাজির করা হয়।"
অনন্তর শায়খকে যুবরাজের সামনে উপস্থিত করা হলে যুবরাজ শায়খ জামালুদ্দিনকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলেন- তুমি সে সময় যা বলেছিলে, আমাকে তা এবার বুঝিয়ে বল। সত্য-সঠিক ধর্ম বলতে তুমি কি বুঝাতে চাও?
এতদশ্রবণে শায়খ ইসলামের বিধিবিধান এমন আবেগময় ভাষায় তুলে ধরেন যে, তুগলক তায়মূরের পাষাণ অন্তরও মোমের মত গলে যায়।শায়খ কুফরী অবস্থার এমন ভয়াবহ ও ভীতিপ্রদ ছবি যুবরাজের সামনে অংকন করেন যে, যুবরাজ এতদিন যে অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন তা পরিষ্কার হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হন।
কিন্তু এতদস্তত্বেও তিনি বলেন- আমি যদি এখন ইসলাম গ্রহণ করি তাহলে প্রজাদের সঠিক পথে আনতে পারবো না। তাই আমাকে কিছু দিন সুযোগ দাও। যখন আমার বাপ-দাদার রাজত্ব আমার দায়িত্বে আসবে, তখন তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে।
শায়খ জামাল উদ্দিন নিজ দেশে ফিরে কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন। মৃত্যুর সময় নিজ ছেলে রশিদ উদ্দিনকে ডেকে বললেন- অচিরেই একদিন না একদিন তুঘলক তায়মুর বাদশাহ হবেন। তখন তুমি তার কাছে যেতে ভুলবে না। গিয়ে আমার পক্ষ থেকে সালাম
দেবে এবং নির্ভয়ে তাকে সেই অঙ্গীকারটা সম্বরণ করিয়ে দিবে যা তিনি আমার সাথে করেছিলেন।
কয়েক বছর পর তায়মুর(১৩৪৭-১৩৬৩) পিতৃ-সিংহাসনে আরোহণ করলেন। এসময় একদিন রশিদ উদ্দিন সেনা ছাউনিতে গিয়ে উপস্থিত হন।পিতার অন্তিম নির্দেশ পালনই ছিল তার উদ্দেশ্য।কিন্তু বহু চেষ্টা-তদবির সত্ত্বেও তিনি বাদশাহর দরবারে হাজিরা দিতে
এবং সাক্ষাৎ লাভে ব্যর্থ হন।শেষে তিনি এক কৌশল অবলম্বন করেন। একদিন ভোরবেলা তিনি তুগলকের তাঁবুর কাছাকাছি গিয়ে সজোরে আজান দিতে শুরু করেন। এতে বাদশাহর ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং তিনি ক্রোধান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন- কে এই উচ্চকণ্ঠ
দুঃসাহসী। যে আমার বিশ্রামের পরোয়া পর্যন্ত করে না!
বাদশাহকে অবহিত করা হলো-পারস্যবাসী এক মুসাফির। তিনি তার ধর্মমতে উচ্চ আওয়াজে আজান দিচ্ছেন, নামাজ পড়ার জন্য। বাদশাহ আদেশ দিলেন লোকটিকে তার সামনে হাজির করতে। এবার সুযোগ বুঝে রশিদ উদ্দিন তার পিতার পয়গাম পৌঁছে
দিলেন। সাথে সাথে তুঘলক তায়মুরেরও শায়খ জামাল উদ্দিন এর সঙ্গে তার কৃত ওয়াদার কথা সম্বরণ হলো। তিনি বললেন,সত্যি! আমি বাপ-দাদার এই মসনদে যখন অধিষ্ঠিত হয়েছি, তখন থেকেই সেই অঙ্গিকার আমার মনে আছে। কিন্তু কি ব্যাপার! শায়খ নিজে আসেননি কেন? রশিদ উদ্দিন জানালেন, তিনি তো এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে পরকালের বাসিন্দা হয়ে গেছেন।
এ খবর শুনে একদিকে বাদশাহ যেমন মর্মাহত হন; অন্যদিকে ইসলামগ্রহণ ও ইসলামের সেবা করার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত হন। সাথে সাথে বাদশাহ ইসলাম গ্রহণ করেন। একের পর এক আমীরদের সামনে ইসলাম পেশ করেন এবং তাদেরকেও আহ্বান
জানান। তারও সবাই ইসলাম কবুল করেন। এভাবেই চারদিকে ইসলামের সূর্য চমকে উঠল। তার উজ্জ্বল আভায় ধীরে ধীরে কেটে গেল আঁধার। লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে লাগলো।
এভাবে আল্লাহওয়ালা আলেমগণের প্রভাব বিস্তারকারী উপদেশের বদৌলতে তাতারীদের মাঝে রাজ্য শাসনকারী রাজপরিবারসমূহে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। জৈনিক ইংরেজ ইতিহাসবিদের ভাষায়-"অবিবেচনায় ভারাক্রান্ত ইসলামের প্রথম শ্রেষ্ঠ সনাতন মর্যাদা
আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।মুসলিম দাঈ(প্রচারক) এর মাধ্যমে ঐসব অপরাজেয় বিজয়ীকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। যারা মুসলিম নির্যাতনে নিজেদের সমস্ত চেষ্টা ব্যয় করেছিল। ইসলামের প্রচারকগণ মুসলিমবিদ্বেষী লোকদেরকে পর্যন্ত
ইসলাম গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন।"
তুঘলক তাইমুরের প্রশ্নের জবাবে শায়খ জামাল উদ্দিন মুখ দিয়ে আল্লাহপ্রদত্ত যে উত্তর বের হয়েছিল বন্য তাতারীদের পরবর্তী বংশধরদের একটি বিরাট শাখায় ইসলাম প্রসারে সে উত্তরের বড় অবদান ছিল। এরকম ইখলাস ও ঈমানপ্রসূত কিছু কিছু বাক্যের সঙ্গে যদি আল্লাহর তৌফিক থাকে,তাহলে তা ক্রিয়ার দিক থেকে অনেক বড় সেনাবাহিনী, অজস্র অস্ত্র-সম্ভার ও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের চেয়েও প্রভাবশালী হয়।
তথ্যসূত্রঃ
১)The preaching of Islam: a history of the propagation of the Muslim faith By Sir Thomas Walker Arnold
২)তারীখে দাওয়াত ওয়াল আজীমত- মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী(রহ)
৩)চেঙ্গীয খান- হ্যারলড ল্যাম্ব
৪)আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া
৫)wikipedia