চট্টগ্রামে জঙ্গি দমনে বিশেষ ভূমিকা রাখা চৌকস পুলিশ কর্মকর্তাদের একজন এসপি বাবুল আক্তার। অপরাধ দমনে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক, আইজিপি ব্যাজ, বাংলাদেশ পুলিশ মেডেলসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মর্যাদাকর পদক। কিন্তু ওসব পদক যে রাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রতারণা মাত্র, তার প্রমান মিললো সন্ত্রাসী হামলায় নিজ স্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর।
খুনের পর স্ত্রীর লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দেখতে এলে সেখানে উপস্থিত পাঁচলাইশ থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে বাবুল আকতার বলেন, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম তারা (জঙ্গিরা) আমার ও আমার পরিবারের পিছু ছাড়বে না। বলার পরও কেন আমার পরিবারকে দেখে রাখা হয়নি।’ হ্যাঁ, জনাব বাবুল আকতার, আপনি এখানেই আপনার সহকর্মী এমনকি আপনার বাহিনীকে চিনতে ভুল করেছেন। কোথায় এত সময় তাদের? আপনার পরিবার দেখে রাখলে তো আর তাদের পকেট উঁচু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে মনগড়া গ্রেফতার ও বিশেষ এজেন্ডা মাথায় রেখে মামলা সাজাতে দক্ষ হয়ে উঠেছে আপনার বাহিনী। অবশ্য আপনিও এর থেকে মুক্ত ছিলেন বলে মনে করিনা। দেশটা আজ গুম-খুনের যে স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে তাতে আপনার বাহিনীর বিশেষ অবদান রয়েছে। অপরাধের ধরণ, উপলক্ষ্য ও পদ্ধতি দেখে সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করার প্র্যাকটিস আপনার বাহিনীতে নেই বললেই চলে। যাকে তাকে ধরে এনে মামলার আসামী সাজিয়ে একটা প্রেসব্রিফিং করতে পারলেই যেন কেচ্ছা খতম। বিশেষ রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠিকে ঘায়েল করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন। তাই বিচারের বাণী আজ নিভৃতে কাঁদে।
কথায় বলে –‘স্বর্ণকার নিজের মায়ের গহনা থেকেও স্বর্ণ চুরি করে’। আপনার বাহিনীর অবস্থা হয়েছে তাই। নয়তো আপনার ও আপনার স্ত্রীর অপরাধটা কোথায়? জঙ্গী দমনে সফল নেতৃত্ব দেয়াই কি এদেশে অপরাধ? খুব সম্ভবত তাই। কর্ণেল গুলজার তো নিজের জীবন দিয়ে তা অনেক আগেই প্রমাণ করে গেছে। সাধারণ মানুষের বেলায় ধরে নিলাম আলাদা কথা। যেন তেন করে একটা তদন্ত করে দু’-পাঁচ জন বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী কিংবা সাধারণ যে কাউকে গ্রেফতার করে ফাঁসিয়ে দিলেই যথেষ্ট। পরেরটা আদালত বুঝবে। কিন্তু তাই বলে নিজের বেলাতেও!?
কাকের মাংস নাকি কাক খায়না। কিন্তু পুলিশ এক আজব প্রাণী। যে নিজের ভাইয়ের গোশত খেতেও দ্বিধান্বিত হয়না। বাবুল আকতারের নিষ্পাপ দুটি সন্তান রয়েছে। তারা অকালে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তাদের মা হারিয়েছে। এবং এতে তাদের কোন দোষ ছিল না। বাবুল আকতারের নিহত স্ত্রী মিতুর বাবাও একজন সাবেক পুলিশ পরিদর্শক। একজন পুলিশ কর্মকর্তার কন্যা ও উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী হওয়ার পরেও তিনি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনই নিরাপত্তা পেলেননা। পাশাপাশি তার এই মৃত্যুকে ঘিরে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে অদৃশ্য ইশারায় উঠে পড়ে লেগেছে খোদ পুলিশ বাহিনী! অন্যান্য মামলায় পুলিশ গতানুগতিক যে দায়সারা গোছের কাজ করে থাকে, বাবুল আকতারের ব্যাপারেও এর ব্যতিক্রম কিছুই ঘটলো না!
দীর্ঘদিন যাবত হাটহাজারী উপজেলার নাজিরহাট এলাকার কাছাকাছি ফরহাদাবাদ ইউনিয়নে অবস্থিত ‘মূসাবিয়ার মাজার’এর পীরের দুই কন্যার মধ্যে দ্বন্দ চলছিল। গত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ এই মূসাবীয়া দরবার শরীফের মালিকানা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় নগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইমতিয়াজ বাবলাসহ ৩২ জনকে আটক করে পুলিশ। এসময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ লাঠি, লোহার রড ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। আটক ব্যক্তিদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির গ্রুপের বলে জানা যায়।
আবু নসর গুন্নু। যাকে মিতু হত্যার আসামী হিসেবে গ্রেফতার দেখিয়েছে চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন। অথচ প্রতিপক্ষের নিকট থেকে ৩০ লক্ষ টাকা ঘুষের বিনিময়ে গুন্নুকে মুসাবিয়ার মাজারের দ্বন্দের জেরে গ্রেফতার করা হয়। এর পেছনে এক প্রভাবশালী মহিলা লীগ নেত্রীর হাত থাকার খবরও মিলছে। এ নিয়ে আরো চমকপ্রদ তথ্য আপনারা পড়ে দেখতে পারেন। এনিয়ে আমার কথা বলার রুচি নেই। শুধু এতটুকু বলতে পারি, রিপোর্ট দু’টি পড়লে ঘৃনায় পিত্তি জ্বলে যাবে।
শুধু এতটুকু বলা যায়, টাকার বিনিময়ে নিজের সহকর্মীর সাথে বেঈমানী আর মুক্তিযোদ্ধার ভাইকে জঙ্গি বলে চালিয়ে দিতেও আমাদের পুলিশ বাহিনী দ্বিধান্বিত হয় না। উল্টো মিতু হত্যার আসামী দেখিয়ে এই আবু নসর গুন্নুকে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদনও করেছে এই পুলিশ বেশধারী চোরেরা।
এখানে আরও লজ্জার খবর আছে। যে পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে হত্যার ক্লু নির্ধারণ করা সহজ হতো, সে পথ পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে পুলিশ। মিতু হত্যার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলামত তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেটি নাকি গচ্ছা গেছে! অথচ খুনীরা রহস্যজনক এসএমএস দিয়েছিল সেই মোবাইলে। মোবাইল তো তার ভ্যুানিটি ব্যাগে থাকার কথা। কিন্তু ভ্যানিটি/হাতব্যাগ পাওয়া গেলে মোবাইল গেল কোথায়? কেন কোটি টাকা ব্যায়ে পুলিশের সেট করা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাগুলো অচল ছিল? কেন ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী কালি মন্দিরের সিসি ক্যামেরার ধারণকৃত নির্দিষ্ট সময়ের ভিডিও নেই? কারা সে ভিডিও ডিলিট করেছে? এসব কোনকিছুর কুলকিনারা করতেই পুলিশ এগোয়নি।
বাবুল আকতারের সাহসিকতার উপাখ্যান লিখে তাই আর কোন লাভ আছে বলে মনে করি না। তাকে প্রদত্ব সাহসিকতার স্বীকৃতিগুলোকেও তাই রাষ্ট্রের প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছিনা। যে সাহসিকতা আর সততা দিয়ে তিনি নিজ বাহিনীর দুর্ণাম ঘুঁচাতে চেয়েছিলেন তা আবারও ব্যর্থ প্রমাণিত হলো। দুঃখিত, বাবুল আকতার। আমরা আপনার বাহিনীর জন্য লজ্জিত...