তুমি তো ব্যবসায়ী তাই না? পায়ের উপর পা তুলে গুনে যাচ্ছো ডলারের বান্ডিল। মাপামাপি করে চলেছ অর্থনৈতিক সূচকের ওঠানামা। চুলকাতে চুলকাতে চুলশূণ্য করে ফেলেছো মাথার তালু। কিন্তু একবারের জন্যও ভেবে দেখেছো তোমার ডলার আয়ের নেপথ্যের কারিগরদের নিয়ে?
আজ ২৪ এপ্রিল। বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা। ৩ বছর আগের এই দিনটিতে তোমারই জন্য ঘটে গেছে ইতিহাসের এই নির্মমতম ঘটনা। সেদিন শত শত মানুষের আর্তনাদ আর রক্তাক্ত আহত, নিহত দেহগুলো সারা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। কিন্তু তুমি ব্যবসায়ী, তাই একটুও হতবাক হওনি। বিবেকের কাঠগড়া থেকে একটুও তোমার মানবিক সত্ত্বাকে দোলা দেয়নি। কারণ অর্থের নেশায় তোমার বিবেক মরে গেছে। কেন এ কথা বলছি তা বুঝতে আরও একটু গভীরে যেতে হবে।
তোমরা মনে করো টাকা দিয়ে সবকিছু ঢেকে ফেলা যায়। কিনে নেয়া যায় সবকিছু। এমনটি ভাবার পেছনে কিছু কারণও নিহিত রয়েছে। টাকার কাছে তোমরা বিক্রি করে দিয়েছো তোমাদের বিবেক। যদি তাই না হবে তাহলে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাওতো। শত শত শ্রমিক হত্যার সাথে জড়িতদের শাস্তির দাবি কি তোমরা জানাতে পেরেছিলে? যদি না পারো তবে কেন পারনি? অপরাধীরা তোমাদের মতই ব্যবসায়ী বলে? তোমাদের ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সদস্য বলে? তোমরা তো সবাই এই ঘৃন্য অপরাধের জন্য দায়ী ছিলে না।
কাদেরকে বলছি? কি বলছি?? বিচারের দাবী তো দূরের কথা। ব্যবসায়ীর বেশে মানুষরূপী পশুদের এ ঘৃন্য কাজের জন্য একটা নিন্দাও তো তোমরা জানাতে পারনি। শ্রমিককে মানুষ মনে করো না বলেই ঝুকিপূর্ণ ভবনে শ্রমিকদের ঠেলে দিয়ে তোমরা আয়েশ করেছো কোন ভিআইপি কক্ষে। তাই ভাগ্যাহত শ্রমিক মরেছে। মরেনি তোমাদের মত পশুরা।
রানা প্লাজা ধসে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮ শতাংশ শ্রমিক এখনও বেকার। আহত শ্রমিকরা শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণে এখনও কাজে ফিরতে পারছেন না। আর এ দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া প্রায় ৫৯ ভাগ শ্রমিকই দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। জানিনা এদের ভাগ্যে কি আছে। যারা এখনও জীবনের ঝুকি নিয়ে বিভিন্ন বহুতল গার্মেন্টস এ কাজ করছে তাদের নিরাপত্তার কথাও কেউ ভাবছে কিনা জানিনা। হাল আমলের বাঁশ দিয়ে ভবন নির্মানের হিড়িক দেখে মনের মাঝে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
সহস্রাধিক শ্রমিক হত্যা ও পঙ্গু করার পেছনে দায়ী দোষীদের দ্রুত বিচারের দাবীতে আজ আহত শ্রমিকরা সমাবেশ করেছে। তাদের সে কান্না দেখলে সহ্য করা যায় না। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, জুরাইনে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সাংবাদিকদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হওয়া তিনটি মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার দাবি জানিয়েছে। সাংবাদিক বেচারা প্রশ্ন না করে বসলে হয়তো লোক দেখানো এ দাবিটুকুও আসতো না। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এফবিসিসিআই। এ ঘটনায় তাদের যেন কোনই দায় দায়িত্ব ও অপরাধবোধ নেই!
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) হিসাব মতে, এই পাঁচ কারখানায় শ্রমিক ছিল ৩৯৪১ জন। এর মধ্যে জীবিত ও আহত শ্রমিক উদ্ধার করা হয় ২৪৩৮ জনকে। নিহত হয় ১১৩৮ জন শ্রমিক। নিখোঁজ হয় ৩৬৫ জন। এর মধ্যে ডিএনএ টেস্ট করে ২৬৫ জনের পরিচয় নিশ্চিত করা গেলেও এখনো খোঁজ মেলেনি শতাধিক শ্রমিকের।
যে শতাধিক শ্রমিকের খোঁজ মেলেনি তারা যে অভিশপ্ত ওই বিল্ডিংয়ের ইট, বালু, সিমেন্ট আর মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ গত বছরেও ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে মিলেছে মৃত মানুষের হাড়গোড়। বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি ক্ষতিপূরণ মেটানোর ভয়ে তড়িঘড়ি করে শেষ করে উদ্ধার কাজ। ওই শতাধিক পরিবারের ভাগ্যে কি জুটেছে আল্লাহ ভালো জানেন।
ব্যবসায়ীরা দোষীদের বিচার চাইবেন কিনা জানি না। তবে সারা বাংলাদেশের মানুষ দল-মত নির্বিশেষে এই ঘটনার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। যাতে সমাজে রানার মত কুখ্যাত সন্ত্রাসীরা ব্যবসায়ী বনে না যেতে পারে। যাতে আর কোন প্রকৌশলী এমন ভবন নামক মৃত্যুফাঁদ তৈরী না করতে পারে। আর যাতে বেঘোরে জীবন দিতে না হয় কোন শ্রমিককে।