সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনভূমি। এই বনভূমি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুন্দরবন যে আসলে কতটা সুন্দর তা সুন্দরবনে না গেলে অজানাই থেকে যেত। পুরো পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ তিনটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের একটি হিসেবে গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান যথেস্ট জটিল। দুই প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ এবং ভারত জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের বৃহত্তর অংশটি (৬২%) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর; পূর্বে বালেশ্বর নদী।
হাজার বছর ধরে বঙ্গোপসাগর বরাবর আন্তঃস্রোতীয় প্রবাহের দরুন প্রাকৃতিকভাবে উপরিস্রোত থেকে পৃথক হওয়া পলি সঞ্চিত হয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। সুন্দরবনকে বলা হয় বাংলাদেশের ফুসফুস। উপকূলীয় বন হিসেবে এর গুরুত্ব লিখে শেষ করার মত নয়। শুধু এতটুকু বলা যায় বিধাতা করুণা করে সুন্দরবন না দিলে বঙ্গোপসাগরের সাইক্লোন জোন থেকে উৎপত্তি লাভ করা হাজার কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা সাইক্লোনে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকতো কিনা তার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে যে ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন-সহ দক্ষিণবঙ্গের প্রাকৃতিক প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বাঁচানোর যথেষ্ট উদ্যোগ না-থাকায় জাতীয় পরিবেশ আদালত ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সুন্দরবনের সংলগ্ন রামপালে কয়লা-ভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহন করেছে সরকার। তবে সিদ্ধান্তটি নিয়ে উদ্বেগ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সর্বমহলে। আর এ বিতর্কের কারণ সুন্দরবনের সৌন্দর্য ও অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। সরকার বারবার বোঝাতে চাচ্ছে যে, কয়লা বিদ্যুৎ হলে সুন্দরবনের কোন ক্ষতিই হবে না। কিন্তু দেশের শিক্ষিত মহল ও পরিবেশবাদীরা তা মানতে পুরোপুরি নারাজ। ইউনেসকোসহ দেশী-বিদেশী পরিবেশবাদীরাও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি ও উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার সরছে না। রামপালে বহুল সমালোচিত এই কয়লা-ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের নির্ধারিত জায়গায় ইতমধ্যেই মাটি ভরাটের কাজ শেষের দিকে।
কয়লা-ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট পরিচালনা, ঘরোয়া ব্যাবহার, পরিবেশগত ব্যাবস্থাপনা ইত্যাদি কাজে পশুর নদী থেকে ঘন্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার পানি সংগ্রহ করা হবে এবং পরিশোধন করার পর পানি পশুর নদীতে ঘন্টায় ৫১৫০ ঘনমিটার হারে নির্গমন করা হবে। ঘন্টায় ১০০ ঘনমিটার বা ৫১৫০ ঘনমিটার যাই হোক, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি নির্গমন করা হলে নির্গত পানির তাপমাত্রা, পানি নির্গমণের গতি, পানিতে দ্রবীভূত নানান উপাদান বিভিন্ন মাত্রায় পানি দূষণ ঘটাবে যা গোটা সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ ধ্বংস করবে।
বিদ্যুতের বিকল্প আছে। কিন্তু তামাম বিশ্বে সুন্দরবন একটাই। এর বিকল্প কিসে? সুন্দরবন ধ্বংস হলে দেশের সৌন্দর্যের আর অবশিষ্ট কি থাকে? নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশে অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তা সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলে নয়। সুন্দরবনকে সুরক্ষিত রেখে অন্যকোথাও বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে তাতে কেউই আপত্তি করবে বলে মনে করি। সুন্দরবনটা সুন্দরই থাকুক না! একটুখানি কষ্ট করে হলেও আগামীর প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ রেখে যেতে পারলে ক্ষতি কি!