somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শহীদুল জহিরকে নিয়ে অগোছালো অনুভূতি

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ভোর ৫:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শহীদুল জহির একুশে পদক (২০২৫) পেয়েছেন (মরণোত্তর)। একটা ভালো লাগা কাজ করছে। প্রিয় ঔপন্যাসিক, গল্পকারকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। তার আসল নাম শহীদুল হক।

তখন রাত্রি নিশীথে দূরের গাছের আড়ালে চাঁদের মৃদু আলোয় বসে কুহু কুহু রবে ডেকে যাচ্ছে কোন এক পাখি। দেখতে হয়ত কালো অথবা কালো নয়। রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে সেই ডাক কানের ভিতর দিয়ে উত্তরের শীতল হাওয়ার মত হুহু করে প্রবেশ করছে। ঘুম না আসায় মোবাইল হাতে নিয়ে পিডিএফ এর সাইটগুলোতে ঢু মারছিলাম। কোনটা ডাউনলোড করবো সেটা নিয়ে সংশয়ে থাকার সময়ে একটা বইয়ের নাম মনে ধরে। “আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু” বইটা পড়া শুরু করি। অর্ধেক শেষ হতে না হতেই ফজরের আজান দেয়। তখন করোনার সময়, প্রচুর অবসর তাই নিশ্চিন্ত মনে নামাজের পরে আবার শুরু করি পড়া। ঘোরের পরে ঘোর। বইটা শেষ করার পরে অদ্ভুত মোহের ভেতরে ডুবে যাই। কি পড়লাম! এত অদ্ভুত ভাষায় মানুষ কীভাবে লেখে! কে উনি? গুগল সার্চ করে জানতে পারি ওনার সম্পর্কে। তারপরে ইউটিউব থেকে দেখি তার সম্পর্কে মানুষের আলোচনা। এত বিখ্যাত একজন লেখক অথচ জানতামই না। একটা আফসোস জেগে ওঠে।


পাঠক সমাবেশে প্রথম যখন তার সংগ্রহ দেখি তখন নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। হাত বুলাই, দাম দেখে একটু হতাশ হই। তবে ভালো লাগে এত সুন্দর মলাটে তার রচনাবলি দেখে। পকেটের করুণ অবস্থা খেয়াল করে রেখে দেই। হঠাৎ দেখি চিকন একটা বই “অপ্রকাশিত অগ্রন্থিত শহীদুল জহির” দাম নাগালের মধ্যে থাকায় নিয়ে নেই। তারপরে বুঁদ হয়ে পড়ি। মালীটোলা পার্ক থেকে ভুতের গলি, নরিন্দার সবগুলো লেনে তার সাথে ঘুরি আর বান্দর দেখি। দেখি মানুষগুলোকে, যেমন, ফট করে জুতা ছিড়ে যাবার পরে আব্দুল মজিদ বিস্ময়ের সঙ্গে রিকশার উপরে মাইক্রোফোন হাতে আবুল খায়েরকে দেখে।


এরপরে প্রতি মাসের শেষে টিউশনের বেতন পাওয়ার পরে মাওলা ব্রাদার্সে এসে উঁকি দিতাম। একটা করে শহীদুল জহির নিয়ে নিতাম। কোন এক রাতে যখন আমি একা হয়ত একা না কিংবা হয়ত কেউ ছিল অথবা একাই ছিলাম; তখন আফসোসে কেঁদেই দিয়েছিলাম অথবা মন খারাপ করেছিলাম কিংবা মন খারাপ হয়ে চোখের পানি ছলছল করেছিল; তিনি কেন আরো বেশিদিন বাঁচলেন না, কেন আরো বেশি লিখলেন না। “মহল্লায় বান্দর ও আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা”,“আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস”, “ইন্দুর বিলাই খেলা” এইসব গল্পের সঙ্গে পুরাতন ঢাকার মানুষের জীবন যেভাবে ফুঁটে উঠেছে যেন নিখুঁত শিল্পীর আঁকা কোন প্রচ্ছদে দাঁড়িয়ে আছে এ প্রাচীন জনপদ।

শহীদুল জহির বাংলা সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার প্রলেপ এঁকে দিয়েছিলেন প্রথম। মার্কেসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তবে দু’জনের জাদুবাস্তবতার ধরণ ভিন্ন। জহিরের লেখায় দেখি, মামুন নামের চরিত্রটি হারিয়ে যাবার পরে যখন লোকেরা এসে নিখোঁজ সংবাদ দেয় তখন তার মা ঘরের মামুনের জন্মদাগ পরীক্ষা করেও কেমন সংশয়ে ঘোলাটে হয়ে যায়। ওদিকে হারানো মামুন আসমান তারা হুরে জান্নাতের খরকোশ হয়ে যায়। চাঁন মিঞার মা দেখে বান্দরের দল তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়। পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর গুলিতে মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর নিভে যায়। মহল্লায় বান্দরের দল অনেকদিন পরে ফিরে আসায় মানুষের বোধোদয় হয়। তরমুজ ব্যবসায়ীদের আড়ালে ফুঁটে ওঠে আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস।


পুরাতন ঢাকার একটা খ্রিষ্টান পরিবারও তার লেখায় উঠে আসে। কীভাবে জুলিফ্লোরেন্স তাদের বাসায় যাওয়া তরুণদের বন্ধু বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা চাঁন মিঞার প্রেমে পড়ে। কিংবা মামুন কীভাবে দুইজন হয়ে যায় এবং খরকোশে পরিণত হয়, ইন্দুর বিলাই খেলায় কেন সবসময় বিড়ালের মর্জির উপরেই নির্ভর করতে হয়। “আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস” গল্পে কেন কোন দাড়ি নেই, শুধু কমার উপরেই কীভাবে একটা গল্প হয়ে যায় অর্থবহ।


গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের প্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। কোন এক বর্ষণমুখর বসন্তের দিনে রাস্তার ওপারে হেমিংওয়েকে দেখতে পেয়ে সংশয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন নি। শুধু দূর থেকে মা-য়ে-স্ত্রো বলে একটা ডাক দিয়েছিলেন এর প্রতিউত্তরে হেমিংওয়ে ”আদিয়াস আমিগো” (বিদায় বন্ধু) বলে হাত নাড়ান। ওই ছিল একমাত্র সাক্ষাৎ হেমিংওয়ের সঙ্গে। তখন তার বয়স ছিল আটাশ এর ঠিক কুড়ি বছর পরে যখন মার্কেস একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক তখন তিনি একদিন ফিদেল ক্যস্ত্রোর গাড়িতে লালফ্রেমে মোড়া হেমিংওয়ের একটা বই দেখতে পান, এবং ক্যাস্ত্রো বলেন হেমিংওয়ে হলেন তার তার মাস্টার কারণ একদম সাধারণ জায়গায়ও তাকে পাওয়া যায় খ্যাতি তাকে কখনো বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। তাই বিশ বছর পরেও তিনি অমর হয়ে আছেন।

শহীদুল জহির বই ছাপিয়ে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলেন ভালো হয়নি বলে। কখনো সাহিত্য সম্মেলনে, আড্ডায় তাকে দেখা যেত না। বিয়ে করেন নি । অফিস শেষ করে রুমে এসে লেখায় মনোনিবেশ করতেন। তারপর একদিন মরে গেলেন, রেখে গেলেন অমূল্য সম্ভার। শহীদুল জহিরকে আমি খুঁজে পাই মালিটোলা পার্ক থেকে শুরু করে প্রতিটা লেনে লেনে। লাল-পাছার বানরগুলোকে দেখলেই মনে হয় কোন এক শীর্ণ জানালার গরাদ দিয়ে একমনে দেখে চলেছেন মানুষ ও বানরের এই পুরাতন নগরীকে। যেখানের লাল-দেয়ালের বুকে কিংবা গলির মুখের দিকে চেয়ে, একটা ল্যাম্পপোস্টের কথা মনে পড়ে করো অতীত ফিরে আসে। তখন মনে হয় মা-য়ে-স্ত্রো বলে একটা চিৎকার দেই।

ছবিঃ নিজের তোলা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ১:২৫
৫টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৭.৬২ MM গুলি উদ্ধার। ব্রিগ. সাখাওয়াত ঠিকই বলেছিলেন।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ ভোর ৪:৫৫


*২০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ*

রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ২০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে ডিএমপির উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ।

উত্তরা পশ্চিম থানা সূত্রে জানা যায়, আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কামাল আতাতুর্ক: ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও স্বকীয়তা ধ্বংসকারী এক বিতর্কিত শাসক

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১২:৪২

কামাল আতাতুর্ক: ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ও স্বকীয়তা ধ্বংসকারী এক বিতর্কিত শাসক

তুরষ্কের বিখ্যাত আয়া সোফিয়া মসজিদের ছবিটি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) তুরস্কের ইতিহাসে এক প্রভাবশালী ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=স্নিগ্ধ প্রহর আমার, আটকে থাকে স্মৃতিঘরে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ২:০০


কিছু স্নিগ্ধ প্রহর স্মৃতির ঝুলিতে বন্দি রাখি,
শহরের ক্লান্তি যখন ঝাপটে ধরে,
যখন বিষাদ ব্যথা আঁকড়ে ধরে আমায়,
স্বস্তি শান্তি দিয়ে যায় ফাঁকি
ঠিক তখনি উঁকি দেই স্মৃতিঘরে,
মুহুর্তেই সময় পরিণত হয় সুখ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নাজলী নামের মেয়েটি

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ২:০৫

"নাজলী এখন ভালো আছে"

নাজলীর অসুখ করেছে, আকাশ পাতাল ভাবনায়
ডুবে আছে মেয়েটি।
ঢাকা শহরের উদাস হাওয়া,এলোমেলো পাগলা মিছিলের
আওয়াজে প্রকম্পিত চারদিক, তবুও ভালো আছে নাজলী নামের
মেয়েটি।

গুমোট নগরে
দু:খবোধ জন্ম নেয়, জন্ম নেয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমা করো মা'মনি

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৩ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ২:২৩

এখন অনেক রাত। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আইপ্যাডে নিউজ পড়ছিলাম আর সেহরির অপেক্ষা করছি। মাগুরার ছোট্ট শিশুটির হাসপাতালে জীবন-মরন যুদ্ধের খবর বিভিন্ন পত্রিকায় দেখছিলাম। মন থেকে চাইছিলাম মেয়েটি সুস্থ হয়ে যাক।

আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×