তাঁর সাথে আমার পরিচয় আমার খুব প্রিয় একজন মানুষের(বাবা) হাত ধরেই। বইপাগল পরিবারের মেয়ে হওয়ার সুবাদে খুব পিচ্চিকালেই পরিচয় হয়েছিল এই মানুষটার সাথে। কমিকসের বই ফেলে কিশোর উপন্যাসে পদোন্নতি হয়েছিল তাঁর বই দিয়েই। সেই “বোতল ভূত” কতবার যে পড়েছিলাম তা হিসেব করা আজ বোকামী ছাড়া আর কিছুই না। বার বছর বয়সে জীবনের প্রথম উপন্যাস পড়লাম। সেটাও তাঁরই লেখা “নন্দিত নরকে। ঐ উপন্যাসের রাবেয়ার কথা মনে পড়লে আজও খারাপ লাগে। পলা নামের কুকুরটা আজও মনে গেঁথে আছে। সেই থেকে শুরু,আর থেমে থাকা হয়নি। বাবা কখনও তাঁর একটা ছোট গল্পের বই আনতেননা। আমার বুককেসে তাই ঠাঁই পেয়েছিল বিশাল বিশাল হুমায়ূন সমগ্র। একটু আগে বইগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। যিনি বইগুলো কিনে দিয়েছিলেন তিনি চলে গেছেন অনেক আগেই। যিনি বইগুলো লিখেছিলেন তিনিও চলে গেলেন। আমার ভেতরের বইপাগল সত্তাটাও ঝিমিয়ে পড়েছে। ভয় হয় মৃত্যু না হয়ে যায়!
দুপুরের ফাটা রোদে কলেজ বাস থেকে নেমে যখন রিকশার জন্যে দাঁড়াই তখন কোত্থেকে এক চিলতে বাতাস কয়েক সেকেন্ডের জন্যে পুরো শরীর-মন যেন এক পলকে ঠান্ডা করে দিয়ে যায়। তখন মনে হয় আহা! এই বুঝি “লিলুয়া বাতাস”! এত সুন্দর উপমা আর কে দেবে? প্রকৃতিকে এত সুন্দর করে ভালবাসতে আমাদের আর কে শেখাবে? চরম কাঠখোট্টা এই বাস্তবতায় নির্মল হাসি কে এনে দেবে? বর্ষাদিনের অতি সাধারণ কদমফুলকে অসাধারণের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন এই মানুষটিই। জ্যোৎস্নার পাগল করা মাতাল সৌন্দর্য আমরা আবিষ্কার করেছি তাঁর চোখ দিয়েই। কে জানত বাংলা ভাষায় জ্যোৎস্নাবিলাস,সমুদ্রবিলাস,দুঃখবিলাসের মত এত সুন্দর সুন্দর শব্দ আছে? জানলেও কয়টা মানুষ ব্যবহার করত? এই বিলাসগুলো আমাদের শিখিয়েছেন এই অসম্ভব কল্পনাবিলাসী মানুষটাই। তাঁর সবচে বড় সফলতা যে জায়গায় তা হল তিনি বাংলাদেশের অসংখ্য প্রচারমাধ্যমবিমুখ মানুষকে টিভির সামনে বসিয়েছিলেন। এর সবচে বড় উদাহরণ আমার মা। একজন হুমায়ূন আহমেদ না জন্মালে পরিবারের সবাই মিলে সিনেমা দেখার আনন্দ থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম। আমার মত সাধারণ একটা মেয়ে নিজের মধ্যে অরূ,মৃন্ময়ী,লীলাবতীর মত এত অসাধারণ সব মেয়েকে খুঁজে বেড়াতনা! দারুচিনি দ্বীপে হারানোর স্বপ্ন দেখতনা! বয়ঃসন্ধিতে আশেপাশের ছেলেগুলোর মধ্যে একজন শুভ্রকে খুঁজে বেড়াতনা!
আর দশটা ছেলেমেয়ের কথা জানিনা,বাবা আর বোনের পরে আমার বইপড়ায় অদৃশ্য এই মানুষটির প্রেরণা অনেক বেশি ছিল। একুশে বইমেলায় কখনও যাওয়া হয়নি। আর হয়তো যাওয়াও হবেনা প্রাণহীন কোন বইমেলায়! চলে গিয়েও তিনি জয়ী। চিরতরুণ থেকে গেলেন কোটি কোটি মানুষের কাছে। সেই কৈশোরের আমি আজ যৌবন পেরিয়ে কাল বার্ধক্যে উপনীত হব। তবু তিনি চিরতরুণ থেকে যাবেন আমার কাছে,আমার উত্তরসূরীদের কাছে। কিংবদন্তী বুঝি একেই বলে! আজ রাতেও হয়তো বৃষ্টি হবে,অন্যান্য রাতের মতই এই গানটি শুনব,
“যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো,
চলে এসো এক বরষায়”
কিন্তু তিনি আর আসবেননা,তিনি আর নেই!
দূরে তাকিয়ে থাকি...কোথাও কেউ নেই!!!