প্রথম পর্ব - ১
যাই হোক সেদিন ভাবলাম পরিচয় পর্ব মনে হয় শেষ, আর ভয় নাই। কিসের কি সন্ধ্যায় এক ক্লাসমেট ফোন দিয়ে বলল," দোস্ত, অমুক ভাই তমুক মোড়ে ফার্স্ট ইয়ার সবাইকে থাকতে বলছে সন্ধ্যায়। মনে হয় কোন কথা বলবে"।
আগে থেকে বলে রাখি, ছোটবেলাতে কুয়েট এর অমর একুশে হলে আমার একটু যাতায়াত ছিল দুইজন পরিচিত ভাই সেখানে পড়ার সুবাদে। সেই ২০১১-১২ এর দিকের কথা, প্রায়ই যেতাম গেম আর মুভি আনতে। গেলে দেখতাম তারা তাদের সিনিওর জুনিওর সাথে প্রায়ই হাসি-ঠাট্টা করছে। শুনতাম সিনিওর জুনিওর অনেক সুন্দর একটা সম্পর্ক হয়, তখন থেকে একটা ইচ্ছা ছিল যে আমি ভার্সিটিতে উঠলে সেরকম সিনিওর পাওয়ার।
যখন শুনলাম ডাকছে তখন ভাবলাম এইবার মনে হয় মিল-মিশ হয়ে যাবে, যাই হোক গেলাম। সিনিওর আসিলেন, চা অর্ডার দিলেন, বিড়ি থুক্কু সিগারেট সাধলেন এবং অমূল্য জ্ঞান দেওয়া শুরু করলেন। প্রথমেই আমাদের অপরাধ বর্ণনা করলেন, কেন দুই সপ্তাহের মধ্যে কোন সিনিওর এর সাথে দেখা করি নাই। কি আর বলব, তখন তো বুঝি নাই যে তারাই সকল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাদের পরশ না পেলে জীবন হবে নষ্ট। তারপর তিনি সময় বেধে দিলেন যে এই সময়ের মধ্যে সবার সাথে যেন দেখা করে ফেলি, যথা সময়ে সফল না হতে পারলে 'কপালে দুঃখ আছে' সেটাও জানিয়ে দিলেন, তখনও বুঝি নাই কোন অধিকারে কিভাবে কপালে কষ্ট দিবেন। আমি আবার মানুষ হিসেবে একটু অবুঝ প্রকৃতির তো, বুঝতে সময় লাগে। বুঝেছিলামও, কিছুদিন পরে।
দেবদূত, থুক্কু সিনিওর প্রস্থানের পর কিছু সহপাঠী তাদের মেসের দিকে যাত্রা শুরু করল, আমি আর আমার মেসের একই ডিপার্টমেন্টের এক সহপাঠী, আমাদের মোটা মাথা থেকে একটা চমৎকার বুদ্ধি বের করলাম। ঠিক করলাম এখুনি দেখা করা শুরু করব দেবদূতদের সাথে। যেই কথা সেই কাজ, মেসমেট আমার কিছুদিন আগেই মেসে উঠেছে, বলল পাসের বিল্ডিঙে ইমিডিয়েট সিনিওর থাকে। চল দেখা করে আসি। গেলাম সরাসরি তার রুমে, আবিষ্কার করলাম আরেক সিনিওর সেখানে উপস্থিত। এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পেরে আমিতো খুশি, নিজের ভাগ্য দেখে আমি রীতিমত ঈর্ষান্বিত। যার রুম তাকে সিনিওর ক আর অন্যজনকে সিনিওর খ বলি। ঢুকেই ক আর খ ভাইকে সালাম দিলাম। জানতাম নিজে থেকে দেখা করতে গেলে তারা খুশি হয়, কিন্তু তাদের ভাবসাব দেখে মনে হল দেখা করতে এসে ভুলই করে ফেলছি। যাই হোক, তাদের চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম কোথাও ভুল করে ফেলেছি। একে একে খ ভাই আমাদের যে 'বেয়াদবি' গুলো বর্ণনা করিলেন সেগুলি হল প্রথমত, ফোন না দিয়ে আসা কারন সিনিওররা খুবই ব্যস্ত প্রজাতি, সচিব থেকে প্রধানমন্ত্রী মনে হয় পদে পদে তাদের পরামর্শ নেন যে কারনে তারা খুবই ব্যস্ত সময় কাটান। দ্বিতীয়ত, প্রায় দুই সপ্তাহ হল ক্যাম্পাসে আসছি কিন্তু দেখা করি নাই এতেও তারা মর্মাহত হয়েছেন। তৃতীয়ত, কেন তাকে ক্যাম্পাসে চিনে সালাম দিতে পারি নাই এছাড়াও আর অন্যান্য। আমরা কি করব তাদের মারমুখি ভঙ্গি দেখে আগেই অপরাধ স্বীকার করে বসে আছি। তখন খ ভাই বলিলেন তোরা আমার সাথে আয়, ভাবিলাম এবার মনে হয় মিলমিশ হবে। কিসের কি , আমাদের তার মেসে নিয়ে যাওয়া হল।
গেলাম তার মেসে, তিনি যে একজন ছোটখাটো দয়ার সাগর সেটা বুঝতে পারলাম যখন তিনি আমাদের একখানা করে পাপোষ দিলেন দাঁড়ানোর জন্য, শীতকাল ছিল তো। তারপর আবার ঝাড়ি শুরু, এবার শুধু ঝাড়ি না গায়ে হাত তোলার থ্রেট দেওয়া হইল, আমি ভয়ের ভান করিলাম, ভাবিলাম একটা দেশের ভার্সিটির স্টুডেন্ট আর যাই করুক পশুপাখির মত ভায়োলেন্সের হেল্প নিবে না। এক ঘণ্টার মত ঝাড়ার পর আমার সহপাঠী কাণ্ড ঘটাইল। "ভাই আর দাড়াতে পারছি না" বলেই ফ্লোরে শুয়ে পরল। এতে কাজ হল, তারা তার সেবায় ব্যস্ত হয়ে পরল। আমার নির্দেশ দেওয়া হল সহপাঠিকে রুমে পৌঁছে দিয়ে আমরা যেন আবার খ ভাইয়ের রুমে চলে আসি। বলা বাহুল্য, পরের বছর সহপাঠী জানিয়েছিল সেটা তার নিপুণ অভিনয় দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ছিল মাত্র।
যা হোক সেবা করে তাকে তার রুমে পাঠান হলেও আমরা ছাড়া পাইনি তখন। আবার খ ভাইয়ের রুমে আমাদের আসা লাগল। কিন্তু আসর আর জমতেছিল না। তারাও ঝাড়াঝাড়ি বাদ দিয়ে নরমালি কথা বলতেছে দেখে আমিও ভাবলাম র্যাগ মনে হয় শেষ, আমরা এখন সুন্দর একটা সিনিওর জুনিওর সম্পর্কের অধিকারি। সেই অধিকারে ভার্সিটি লাইফের প্রথম ভুলটা করে বসলাম। কথায় কথায় বলে বসলাম, "ভাই বিবর্তনবাদ আমার কাছে যুক্তিযুক্ত লাগে"। আর কই যাব, এই জন্যই পরে কয়েকবার জাকির নায়েকের কঠিন ভক্ত, থিওরি কোনটা আর হাইপথিসিস কোনটা পার্থক্য না জানা খ ভাইয়ের রুমে যেতে হইছিল মেন্টালি টর্চারড হতে। যা হোক সে অন্য কাহিনি।
সেদিনের তারপর খালি আমাদের নাম পরিচয় জেনে একটা আপেল আর বিস্কুট হাতে ধরায় দিবায় করে দেওয়া হল। যেন তাদের করা অপমান আর মানসিক অত্যাচারের মূল্য ছিল একটা আপেল আর এক প্যাকেট এনার্জি বিস্কুট।
চলবে......
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৪০