বলা হয়, হিরোইন যদি রেগুলার ২০ দিন ব্যবহার করা হয় তাহলে ২১ তম দিনে সে রীতিমত আসক্ত হয়ে যাবে। কারণ ততদিনে তার দেহে হিরোইন হুক তৈরি করে ফেলেছে। সুস্থ স্বাভাবিক অনুভূতি পাওয়ার জন্যই তখন হিরোইন হয়ে যাবে তার নিত্যপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। সহজভাবে এটাই হল অ্যাডিকশন।
অনেক হাসপাতালে রোগীর কষ্ট কমাতে নিয়মিত ডায়ামরফিন ব্যবহার করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে হাড় ভাঙলে ব্যথা কমাতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্তও ডায়ামরফিন দেওয়া হয়। এই ডায়ামরফিন কিন্তু আসলে হিরোইন। এটি রাস্তার যেকোনো ডিলারের কাছ থেকে কেনা হিরোইনের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, কারণ এতে কোন দ্রাবক যেমন পানি বা অন্য কোন তরল মিশ্রিত থাকে না যা ঘনত্ব কমিয়ে দিতে পারে।তাহলে এই রোগীরা কেন আসক্ত হয়ে যায় না ?
আসলে অ্যাডিকশন সম্পর্কে আমরা যা জানি তার বেশিরভাগই পাওয়া গেছে বিংশ শতাব্ধির শুরুর দিকে করা পরীক্ষার মাধ্যমে। সহজ বাংলায় পরীক্ষা গুলি ছিল এরকম, 'একটা ইঁদুর নিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হত খাঁচায়। খাঁচায় দুটি নল দিয়ে পানি সরবরাহ করা হত। একটাতে থাকত সাধারণ পানি অন্যটিতে কোকেন বা হিরোইন মিশ্রিত পানি।সব সময় দেখা যেত ইঁদুরটি মাদক মিশ্রিত পানি পানি পান করে ওভারডোজে মারা যেত।' সব পরীক্ষাই কমবেশি একইভাবে করা হত। কিন্তু ১৯৭০ সালে ব্রুস অ্যালেক্সান্ডার নামের এক সাইকোলজিস্ট এতে খুঁত খুঁজে পান। তিনি লক্ষ্য করেন যে সব ক্ষেত্রেই একটা ইঁদুরকে আইসোলেট করে পরীক্ষাগুলি এমনভাবে করা হচ্ছে যে খাঁচায় ইঁদুরটির ড্রাগ নেওয়া ছাড়া করার আর কিছুই নেই। তাই তিনি ভিন্নভাবে একটি এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করেন। তিনি কয়েকটি ইঁদুরকে একসাথে এমন একটি খাঁচায় রাখলেন যাকে ইঁদুরের বিনোদনকেন্দ্র বলাই ভাল । কালার বল, কাটার জন্য কাগজ, খেলার জন্য স্কাম্পার আর আরো অনেক ইঁদুর,আর ড্রাগড পানি আর সাধারণ পানিত আছেই।
এবারের পরীক্ষায় দেখা গেল ইঁদুরগুলি ভিন্ন আচরণ করছে। খুব কম সময়ই তারা ড্রাগড পানি পান করেছে, মাঝে মধ্যে ড্রাগড পানি পান করলেও কেউই রেগুলার ব্যবহার করেনি অথবা ওভারডোজে মারা যায়নি।
বিজ্ঞানীরা যখন ইঁদুর নিয়ে ব্যস্ত তখন সবার অজান্তে মানুষের মধ্যেই এই পরীক্ষাটি শুরু হয়ে গেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রিপোর্ট বলছিল ২০% সৈন্য নিয়মিত হিরোইন সেবন করতো। এই নিয়ে আমেরিকায় তোলপাড় শুরু হয়ে গেছিল। সবাই ভেবেছিল যুদ্ধ শেষ হলে হয়ত দেশ ভরে যাবে ড্রাগ অ্যাডিক্টে,কিন্তু আসলে তেমন কিছুই হয় নি। একটি স্টাডিতে দেখা জায় তাদের ৯৫%-ই বাড়ি ফিরে হিরোইন নেওয়া বন্ধ করে দেয়।
ড্রাগ অ্যাডিকশনের পুরনো মতবাদের সাথে এর কোন মিল পাওয়া যায় না , কিন্তু প্রফেসর আলেক্সান্দেরের মতবাদের সাথে একেবারে খাপে খাপ মিলে যায়। একজনকে যখন ভিন্ন দেশে জঙ্গলে পাঠানো হয় মরতে অথবা মারতে তখন হিরোইন ঠিকই সময় কাটানোর ভাল মাধ্যম হয়ে ওঠে , কিন্তু নিজের প্রিয়জন, পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে হিরোইনের আসলে তেমন প্রয়োজন পরে না।ব্যাপারটি প্রথম পরীক্ষার ইঁদুরকে ইঁদুর বিনোদনকেন্দ্রে ছেড়ে দেওয়ার মত, শুধুমাত্র এক্ষেত্রে ইঁদুরের পরিবর্তে থাকে মানুষ। নেশায় আসক্ত হওয়ার ব্যাপারটি আসলে ড্রাগের নয় , আশেপাশের পরিবেশের।
সমীক্ষায় দেখা গেছে 90s পর থেকে আমেরিকানদের গড়ে ফ্রেন্ড কমে গেছে।আমাদের দেশেও হয়ত কম বেশি একইরকম অবস্থা দেখা যাবে। ড্রাগ অ্যাডিকশন আসলে মানবিক কানেকশন না থাকার অনেকগুলি আউটকামের একটি। এখন আমরা ফ্রেন্ডদের সংখ্যা থেকে বাসার ফ্লোর স্পেস বাড়ানোতেই বেশি মনোযোগ দেই। সম্পর্ক তৈরি করার থেকে কিছু কিনতে পারাকেই আমরা বেশি শান্তির মনে করি।
সব কিছুকে লাভ ক্ষতির খাতায় ফেলে আমাদের সমাজ আজ মানবিকতা একেবারেই ঝেড়ে ফেলছে।শুধু তাই নয়, ড্রাগ অ্যাডিক্টদের যখন মানবিক সহায়তা সবচেয়ে বেশি দরকার তখন তাদের পেলেই আমরা জেলে ছুড়ে মারি যেইটা আক্ষরিক অর্থেই ইঁদুরের খাঁচা। যাদের অবস্থা ভাল না তাদের পেলেও সমাজ দুটি কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না , যখন তাদেরই সহায়তার দরকার সবচেয়ে বেশি। এখনো কি সময় আসেনি কি পুরো বিষয়টিকে আবার ভেবে দেখার?
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:৪৪