বাংলাদেশে শিশু-কিশোর মেয়েদের যৌন অপরাধের শিকার হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। অপরাধের শিকার মেয়েশিশুদের ছবি মুঠোফোনে ধারণ করে সিডি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েশিশুরা শিকার হচ্ছে যৌন নির্যাতন ও পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে যৌন অপরাধের।
পারস্পরিক সম্মতিতে যৌন সম্পর্কের জের ধরেও শিশুরা যৌন অপরাধের শিকার হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, যারা এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, তাদের একটি বড় অংশও শিশু।
র্যাবের মিডিয়া ও আইন শাখার পরিচালক এম সোহায়েল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক অভিভাবক এখন প্রায়ই অভিযোগ নিয়ে আসছেন। কোনো বিশেষ আর্থসামাজিক অবস্থা, অঞ্চল বা স্কুলের শিশুরা যে আক্রান্ত হচ্ছে তা নয়, ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র সব পরিবারের শিশুরাই ঝুঁকিতে আছে। অপরাধের শিকারও শিশু, অপরাধও করছে শিশুরাই।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, প্রধানত ১৩-১৮ বছর বয়সী শিশুরা পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে যৌন অপরাধের শিকার হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবার এ বিষয়টি নিয়ে মামলা করতে চায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা হলেও তা বেশি দূর এগোয় না। অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে কিশোরী মেয়ের বিয়ের ঘটনাও ঘটেছে। র্যাব বলছে, বছর তিনেক ধরে তারা গড়ে ৩০টির মতো অভিযোগ পাচ্ছে। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে গত তিন বছরে মাত্র ২০টি অভিযোগ এসেছে। কিন্তু মামলা হয়েছে মাত্র চারটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহবুবা নাসরীন তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, বেশির ভাগ সময় যৌন অপরাধের শিকার মেয়ে ও তার পরিবার নানাভাবে সামাজিক চাপের সম্মুখীন হয়।
দুটি প্রবণতা: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, সাধারণত আবেগের বশবর্তী হয়ে শিশুরা শারীরিক সম্পর্কে জড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের সম্পর্ক মুঠোফোনে ধারণ করা হয়। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর ধারণকৃত ফুটেজ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কখনো কখনো ধর্ষণের চিত্র ধারণ করে চাঁদাবাজি করছে অপরাধীরা।
র্যাব সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকার এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ১৩ বছর বয়সী মেয়ে যৌন অপরাধের শিকার হয়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব অভিযুক্ত ছেলেটিকে (১৬) আটক করে। ছেলেটি জানায়, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে সে মেয়েটির ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়েছে।
যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘের সাবেক সভাপতি হাজেরা বলেন, অনেক সময় খদ্দের এবং দালালেরা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের যৌনকর্মের ছবি ধারণ করে ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে।
কয়েকটি উদাহরণ: গোপালগঞ্জে এক স্কুলছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয় গত বছরের শুরুর দিকে। আসামিরা ধর্ষণের চিত্র ধারণ করে এবং দ্রুত মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়েটির বাবাকে চাপ দিতে থাকে, নইলে মেয়েটির মুখ এসিডে ঝলসে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয়। দরিদ্র বাবা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বাবার কাছে চাঁদা চাইতে শুরু করে। একপর্যায়ে চাঁদা না পেয়ে তারা মেয়েটির স্বামীকে ভিডিওচিত্রটি দেখায়।
কুমিল্লার দাউদকান্দিতে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে তার স্কুলের এক শিক্ষকের ছেলে ও তার বন্ধু ধর্ষণ করে। মুঠোফোনে সে দৃশ্য ধারণ করে অপর দুই বন্ধু। স্থানীয় সাংসদ বিষয়টির মীমাংসা করবেন, এ আশ্বাস পেয়ে তিনি আর মামলা করেননি। এ বছরের শুরুর দিকে বাগেরহাটে যৌন অপরাধের শিকার হয়ে এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করে।
সম্প্রতি ঢাকার এক স্কুলশিক্ষকের বাসায় যৌন নির্যাতন ও ইন্টারনেটে ছবি প্রকাশের পর ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েটি এক দিনও স্কুলে যায়নি বলে জানায় মেয়েটির পরিবার। বাড়িতে একজন নারী শিক্ষক এসে মেয়েটিকে প্রতিদিন পড়ান। ঘটনার পর থেকে মেয়েটির বাবা শারীরিকভাবে অসুস্থ। মেয়েটি আর কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয় না, বাড়ির বাইরেও যায় না।
অভিযোগ আসছে, মামলা কম: পুলিশ জানায়, ঢাকার একটি থানায় দেড় বছর আগে এক নারী মামলা করেন। পুলিশকে তিনি বলেন, তাঁর ছোট ভাইয়ের তিন বন্ধু দিনের পর দিন তাঁকে ধর্ষণ করার পরও মানসম্মান ও কলেজপড়ুয়া মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি মামলা করেননি। এজাহারে তিনি জানান, অভিযুক্তরা কলেজপড়ুয়া মেয়েকে ডেকে নিয়ে তার মায়ের ভিডিও ফুটেজ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় ও মেয়েকে শারীরিক মিলনে বাধ্য করে। মা তাঁর একমাত্র মেয়ের কথা জানতে পেরে শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাহায্য চান।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ একেবারে নিরুপায় হলে আমাদের কাছে আসছে। গত তিন বছরে অভিযোগ এসেছে ২০-২৫টির মতো। কিন্তু মামলা হয়েছে মাত্র চারটি। পরিবারগুলো সমাধান চাইছে, কিন্তু আইন-আদালতের মাধ্যমে নয়।’ কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার ওসি রতনকৃষ্ণ বলেন, তাঁদের এলাকায় কয়েকজন স্কুলছাত্র একটি মেয়েকে ধর্ষণের পর সেই দৃশ্য সিডি ও ডিভিডিতে ছড়িয়ে দেয়। অভিযুক্তদের শনাক্ত করা গেছে, কিন্তু একটি সিডিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্কুলপড়ুয়া ছাত্রীর ধর্ষণ ও পরবর্তী সময়ে তা সিডি করে ও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে নির্যাতিতের মা গত বছরের ১৯ জুলাই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করেন। থানার ওসি গিয়াসউদ্দিন ৩০ আগস্ট অভিযোগপত্রও দাখিল করেন। ঘটনার পর অভিযুক্ত ব্যক্তি গা ঢাকা দিলেও গত সেপ্টেম্বরে উভয় পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়।
নজরদারির অভাব: পুলিশ বলছে, ইন্টারনেটে কে কী আপলোড করছে, তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (বিটিআরসি)। বিটিআরসি তার দায়িত্ব পালন করছে না বলে অভিযোগ।
বিটিআরসির এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আইসিটি পলিসিতে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে বলা আছে।’ এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।
বিশ্বব্যাপী ক্রেডিট কার্ড চুরি, কম্পিউটার নেটওয়ার্কে হামলা থেকে শুরু করে কম্পিউটার ভাইরাস, ছবি, ভিডিও ছড়ানো—নানা ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (সার্ট) আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সারা বিশ্বে যখনই ইন্টারনেটে বা যেকোনো নেটওয়ার্কে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা ঘটে, তখন যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানায়। বাংলাদেশেও একটি সার্ট কাজ করছে। কিন্তু সরকার এখনো সেটিকে অনুমোদন দেয়নি।
বিডি-সার্টের চেয়ারম্যান সুমন আহমেদ বলেন, ‘পুলিশ বা র্যাব চাইলেই আমরা এ ধরনের সহযোগিতা দিতে পারি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (সংশোধিত-২০০৯)-এর ৫৭ ধারায় ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পর্নোগ্রাফি দেখানো হলে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ কোটি টাকা জরিমানার বিধান আছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এ আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি। সম্প্রতি পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন জারি হয়েছে। এর মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে নতুন নতুন যে অনুষঙ্গ (মুঠোফোন, ইন্টারনেট) যুক্ত হয়েছে, সেগুলোর অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
তবে পুলিশ জানিয়েছে, এখনো পর্যন্ত নতুন আইনে কোনো মামলা হয়নি। আগের মতোই এখনো মামলা হচ্ছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে।
সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে পুলিশের যথেষ্ট দক্ষতার অভাব ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আরও যে সমস্যা রয়েছে তা হলো, যেখানে অপরাধের শিকার ও অভিযুক্ত দুই পক্ষই শিশু, সেখানে বিচার-প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে যায়। শিশু আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী, ১৬ বছরের নিচে কোনো শিশু অপরাধে জড়িয়ে পড়লে বিচার হবে কিশোর আদালতে এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে তাকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে সংশোধনের জন্য।
যোগাযোগ করা হলে আইনজীবী তানজীব-উল আলম বলেন, এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসায় যেতে হবে। বাংলাদেশের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোয় এখনো এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সুব্রত সাহা, গোপালগঞ্জ ও আব্দুর রহমান, দাউদকান্দি (কুমিল্লা)]
শেষ কিস্তি: অপরাধীর শাস্তি না হওয়াই যৌন অপরাধ বাড়ার কারণView this link