আগের পর্বের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্পিচ থেরাপি নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হল অটিস্টিক শিশুদের বৈশিষ্ট্য ও চিকিৎসা নিয়ে আরও আলোচনার অবকাশ রয়ে গেছে। সেজন্যে এই পর্ব।
চার থেকে ছয় বছর বয়সী অটিস্টিক শিশুদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য
স্বাভাবিক বা মূলধারার শিশুরা সাধারণত চার বছর বয়সের মধ্যেই অন্যদের-- বিশেষ করে সমবয়সীদের-- চিন্তাধারা, কথাবার্তা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এসব সম্পর্কে ধারণা করতে শেখে। স্কুলে বা ঘরোয়া খেলার আসরে অন্যকে দেখে সে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করে একটা বিশেষ খেলায় অংশগ্রহণের জন্য তার ঠিক কী করতে হবে। সে অনুযায়ী দৌড়াদৌড়ি, লাফঝাঁপ, হৈহল্লায় সে নিজেকে নিয়োজিত করে ফেলে। এই প্রক্রিয়াটি এত স্বত:স্ফূর্তভাবে ঘটে যে কীভাবে ঘটল তা আমাদের নজরে আসেনা। কিন্তু অটিস্টিক শিশুরা এ বয়স থেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে যায়। অন্যরা কি করছে- বা ভাবছে এ সংক্রান্ত চিন্তা করার মতো অবস্থা তাদের থাকেনা।
আমাদের দেশে একসময় শিশুরা পাঁচ বা ছ'বছর বয়সের আগে স্কুলে যেতনা। কিন্তু এখন তিন-চারের মধ্যেই প্লে-গ্রুপ বা কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া খুব সাধারণ ঘটনা। অটিজম সম্পর্কে বাবা-মায়ের সম্যক জ্ঞানের অভাবে অনেকসময় শিশুর অস্বাভাবিকতা পরিবারে তেমন আমলে আনা হয়না। কিন্তু স্কুলে অভিজ্ঞ ও যত্নশীল শিক্ষকের পক্ষে এধরণের বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা তুলনামূলকভাবে সহজ। প্রথমত শিশুর আচরণ লক্ষ্য করে, দ্বিতীয়ত সমবয়সী অন্য শিশুদের সঙ্গে আচরণের তুলনা করে, তৃতীয়ত গ্রুপ ওয়ার্ক বা দলগত কাজে শিশুর বিসদৃশ পারফর্ম্যান্স দেখে। প্রথম দুটি সহজেই অনুমেয়; শিশুর অন্যমনস্কতা, একটা বিশেষ কাজ বারবার করতে চাওয়া, পাঠক্রমে বা ক্লাসরুমের পরিবেশ সম্পর্কিত কোন রদবদলে তীব্র অস্বস্তি বা প্রতিক্রিয়া, বন্ধুত্ব স্থাপন বা কথাবার্তায় অনীহা বা অক্ষমতা, প্রচন্ড ভীতি-লজ্জা, অন্যকে বা নিজেকে আঘাত করা-- এসব বিষয় শিক্ষকের দৃষ্টি এড়ানোর কথা না। গ্রুপ ওয়ার্ক বিষয়ক তৃতীয় ব্যাপারটি একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
ধরুন পাঁচজন শিশুকে একটা টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসিয়ে শিক্ষক কোন কাজ করাবেন, যাতে turn-taking, sharing, group performance ইত্যাদি বিষয় জড়িত। হয়তো পাঁচজনের হাতে পাঁচটা রং পেন্সিল ধরিয়ে দিয়ে শিক্ষক কাগজে পাঁচ পাপড়ির একটা ফুল আঁকলেন। তারপর প্রথম শিশুটিকে দিলেন। নির্দেশনা অনুযায়ী সে হাতের রং-পেন্সিল দিয়ে একটা পাপড়ি রং করে কাগজটা এগিয়ে দিল পাশের জনকে। এভাবে শেষ জনকে দিয়ে পুরো ফুলটি রং করার কাজ সম্পন্ন হবার কথা। প্রথম বা দ্বিতীয় শিশুটির পরে আর নির্দেশনার প্রয়োজন হবার কথা না। কারণ স্বাভাবিক আগ্রহ থেকেই অন্য শিশুরা দেখবে কী করতে বলা হচ্ছে, তার "part" এখানে ঠিক কতটুকু। আগের জনের কাছ থেকে কাগজটা নিতে হবে, তারপর নিজের কাজটুকু করে পরের জনের কাছে হাতবদল করতে হবে। কিন্তু এদের মধ্যে যদি একজন অটিস্টিক শিশু থাকে, তবে সেক্ষেত্রে এই ঘটনাগুলো ঘটতে পারে--
১. শিক্ষক যখন কাজটি শুরু করছেন, তখন আই কন্ট্যাক্টের অভাবে বা অন্যমনস্কতার কারণে সেটা সে খেয়াল করবেনা।
২. একই ভাবে তার পূর্ববর্তী শিশুরা কী করছে, কেন করছে-- সেদিকেও তার নজর থাকবেনা। বা তাকিয়ে থাকলেও "সিকোয়েন্স"-এর ব্যাপারটা সে ধরতে পারবেনা।
৩. তাকে যখন কাগজটা এগিয়ে দেয়া হবে, তখন সে বুঝতেই পারবেনা কেন এটা তাকে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোন প্রশ্ন করে সেটা জানতে চাইবে না। তার তখন চেষ্টা থাকবে এই বিষয়টা থেকে চোখ সরিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু দেখার, করার বা বলার; অথবা অসংলগ্ন আচরণ করার।
৪. শিক্ষক তার কাছে গিয়ে বারবার বুঝিয়ে হাতে ধরে সাহায্য করলেও সে শুধু রং ঘষে তার "part" শেষ করবে। পরবর্তীজনের কাছে pass করার কাজটি সে করবেনা। কারো দিকে তাকাবেই না।
এখানে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো, তাকে একা যদি একটা ছবি আর ক্রেয়ন দিয়ে বসিয়ে দেয়া হতো, সে হয়তো ঠিকই পুরো ছবিটা রং করে ফেলত। কিন্তু গ্রুপে করতে দেয়ায় তার সীমাবদ্ধতা বা অক্ষমতাগুলো প্রকটভাবে ধরা পড়বে। আমাদের দেশে ক্লাসরুমে শিশুদের গ্রুপ-ওয়ার্কের সুযোগ মেলে কম। কিংবা আদৌ মেলেনা। তাই অটিজম বা অ্যাসপারগার সিনড্রোম আক্রান্ত শিশুদের অস্বাভাবিকতা সেভাবে ধরা পড়ে না। তারা বরং অমনোযোগী, অমিশুক প্রকৃতির, মেধাহীন বা স্বল্প বুদ্ধির ব্যাকবেঞ্চার হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে পড়ে।
এ বয়সী অটিস্টিক শিশুদের আরও কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের কথা বলা যেতে পারে, যেগুলো অনেকের মধ্যেই দেখা যায়।
* হাত নেড়ে টা-টা দেয়ার সময় অনেকে হাতের তালু নিজের দিকে মুখ করিয়ে রাখে। কারণ অন্যদের টাটা দেখার সময় সে দেখে যে হাতের তালুটা তার দিকে মুখ করা।
*কিছু দেখার সময় হঠাৎ হঠাৎ বস্তুটি চোখের একেবারে কাছে এনে দেখে যা দেখে মনে হতে পারে তার দৃষ্টিশক্তিতে কোন সমস্যা আছে অথবা সে খুব ক্ষুদ্র কিছু নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করার চেষ্টা করছে।
* অন্য কাউকে ছবি, বই, বা কার্ডজাতীয় কিছু দেখাতে হলে সে ছবিটা তার নিজের দিকে ফিরিয়ে রাখবে, আর উল্টো পিঠটা দেখাবে।
* কারো সঙ্গে দেখা হলো বা বাড়ীতে কেউ এলো, শিশুকে তখন কিছু সাধারণ সহবত শেখানো হয়, যেমন সালাম/আদাব দেয়া বা উইশ করা। অটিস্টিক শিশুর জন্য এই সামান্য কাজটিই অত্যন্ত কঠিন। কারণটি বিস্তৃত করা যাক। এক্ষেত্রে ১.মানুষটিকে চেনা, ২.নাম/পরিচিতিসূত্র মনে করা, ৩.মুখ খুলে কথা বলা আর ৪.পূর্বোক্ত তিনটি কাজ করার সময় মানুষটির সঙ্গে আই-কন্ট্যাক্ট বজায় রাখা-- এই চারটি কাজ একসঙ্গে করার মতো চাপ তার নার্ভ নিতে পারেনা। তাই দেখা যায়, পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলেও সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে বা মুখ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। বারবার বলার পর বা জোর করা হলে হয়তো কোনমতে এক ঝলক আই-কন্ট্যাক্ট করেছে তো কথা জড়িয়ে ফেলেছে।
* তাকে বিশেষ কোন জায়গায়, যেমন মার্কেটে বা স্কুলে নিয়ে যাওয়া হবে, সেটা সে জানে। রেডি হয়ে দরজা খুলে দেখা গেল একটা পাখী বসে আছে বা খবরের কাগজ এসেছে। বাবা বা মা হয়তো সেটা নিয়ে কোন কথা বললেন। দেখা যাবে, পরবর্তীতে যখনই স্কুলে বা মার্কেটে যাবার কথা আসবে বা তাকে সেখানে যাবার জন্য রেডি করানো হবে, সে বলে উঠবে "পাখী এসেছে" বা "পেপার দিয়েছে" যদিও তার কোনটিই ঘটেনি। আগেরবারের ঘটনাটি তার মাথায় গেঁথে গেছে; সে যেটার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। এই ব্যাপারটা একই সময়ে ঘটে যাওয়া যে কোন ধরণের একাধিক কাজ/ঘটনার ক্ষেত্রে ঘটতে পারে।
এমন অবস্থা কতদিন চলবে?
অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে যাদের ইনটেলেকচুয়াল ডিজেবিলিটি নেই, অর্থাৎ অ্যাসপারগার সিনড্রোমে ভুগছে এমন শিশুদের অনেকে নিবিড় যত্ন ও পরিচর্যায় চার থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে তাদের সীমাবদ্ধতাগুলো একটু একটু করে কমিয়ে আনতে পারে, এবং কিছু অসুবিধা সত্ত্বেও একসময় সাধারণ স্কুলে স্বাভাবিক শিশুদের সাথে পড়ালেখা করতে পারে। আরো ১০-২০% শিশু স্বাভাবিক শিশুদের সাথে পড়তে পারে না, তারা বাসায় থাকে বা তাদের জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষায়িত স্কুল ও বিশেষ প্রশিক্ষণের। বিশেষায়িত স্কুলে পড়ে, ভাষা সহ বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ গ্রহন করে তাদের পক্ষে সমাজে মোটামুটি স্বনির্ভর একটা স্থান করে নেয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু বাদবাকি প্রায় ৬০% অটিস্টিক শিশু, সব ধরণের সহায়তা পাওয়ার পরও স্বাধীন, স্বনির্ভর ও এককভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে না। তাদের নিয়তি বা বাস্তবতা হলো দীর্ঘ দিনের-- এমনকি সারা জীবনের জন্য অন্যের উপর নির্ভরতা। পরিবারে অথবা বিশেষ আবাসনে, বিশেষ পরিচর্যা কেন্দ্রের প্রয়োজন হয় তাদের।
অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসা
এই চিকিৎসা সাধারণত তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে দেয়া হয়।
১. অস্বাভাবিক আচরণ পরিবর্তনের জন্য শিশুর বাবা মা এবং/অথবা অনুরূপ অভিভাবককে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান। সময় ও যত্নসাপেক্ষ চর্চায় তারা বাড়িতে শিশুর আচরণগত পরিবর্তন আনতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। এই কাজটি সফলভাবে করা সম্ভব হলে পরিবার ও সমাজে ভবিষ্যতে শিশুটি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, স্পিচ থেরাপিস্ট ও মনোবিদের পরামর্শ জরুরী। (এই ব্যাপারটিতে কিছু সহযোগিতার চেষ্টা আগামী পর্বগুলো থেকে থাকবে।)
২. বিশেষায়িত স্কুলের মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুকে একদিকে যেমন প্রথাগত শিক্ষা প্রদান এবং ভবিষ্যতে তার জন্য উপযোগী কোনো পেশাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৩. প্রয়োজন ও রোগলক্ষণ অনুযায়ী কিছু ঔষধ ও সাইকোথেরাপি। অবশ্যই সেটা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।
পর্ব-১
পর্ব-২
পর্ব-৩
পর্ব-৪
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০০৯ সকাল ১১:১৮