somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তরের এদিনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির মূলমন্ত্র ঘোষণা দেন

০৭ ই মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় একটি দিন। অগ্নিঝরা মার্চের এদিনে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির মূলমন্ত্র ঘোষণা দেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ শেখ মুজিবের সাত মার্চের ভাষণকে বলেছেন একটি মহাকাব্য। আর সেই মহাকাব্যের মহাকবি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবি গুণের কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে কবি অভিহিত করার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার মতো কাগজে। কাগজটি শেখ মুজিবকে নাম দিয়েছিল 'এ পোয়েট অব পলিটিক্স' ।

চলুন ফিরে যাই একাত্তরে-

৬ মার্চ লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে অপসারণ করে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এই উত্তপ্ত সময়ে নৃশংস বলে কুখ্যাত টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণের উদ্দেশ্য যে মিলিটারির বুটের নিচে পূর্ব পাকিস্তানের গণ আন্দোলনকে দাবিয়ে দেয়া । এটা উপলব্ধি করতে পেরে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জনাব বি এ সিদ্দিকী টিক্কা খানের শপথনামা পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন। ফলে সৃষ্টি হয় এক অচলাবস্থার। এদিকে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন ‘নিউক্লিয়াস’ শেখ মুজিবের ওপর ক্রমবর্ধমান হারে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে যাতে তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার জন্য শেখ মুজিবের ওপর চাপ তুঙ্গে উঠে এবং সেদিনই তার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দীর্ঘ আলাপ হয়। প্রেসিডেন্ট তাকে অনুরোধ করেন, যেন তিনি এমন কোনো পদক্ষেপ না নেন যাতে আর প্রত্যাবর্তনের কোনো পথ না থাকে। একই দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন যে, আগামী ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। কিন্তু ভাষণে প্রেসিডেন্ট যে প্রচ্ছন্ন হুমকি দেন, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের রেডিক্যাল অংশ শেখ মুজিবের ওপর আরো চাপ প্রয়োগ করতে থাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার জন্য। পরদিন ৭ মার্চ জনসভাকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির বাড়িতে চলতে থাকে প্রস্তুতি। এদিকে পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন এবং হুমকি দেন মার্কিন সরকার পাকিস্তান ভাঙ্গা সহ্য করবে না’। রাতে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক বসে এবং সিদ্ধান্ত ছাড়াই গভীর রাতে মূলতবী হয়ে যায়।

এই ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ৭ মার্চ বেলা ২.৩০ মিনিটে রেসকোর্সের জনসমুদ্রের সামনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের অপশাসন ও নিষ্পেষণ থেকে বাঙালির মুক্তির মূলমন্ত্র ঘোষণা দিতে দাঁড়ালেন।

ভাইয়েরা আমার,

আজ-দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্রগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী,রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তাঁর অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পুর্ণভাবে আমাকে-আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।

১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খাঁন মার্শাল'ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ৬-দফা আন্দোলনের ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯সালের আন্দোলনে আয়ুব খাঁনের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খাঁন সাহেব সরকার নিলেন- তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন-গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।

তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম- ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেননা, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহের হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে আমরা এসেমব্লিতে বসবো। আমি বললাম, এসেমব্লির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশী হলেও একজন যদিও সে হয় তাঁর ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।

জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাঁদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন-বসুন আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেমব্লি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ এসেমব্লিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেমব্লি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেমব্লি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেমব্লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন তিনি যাবেননা। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম , শান্তিপুর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো, তারা শান্তিপুর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কি পেলাম আমরা, জামার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের মধ্যে- তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু-আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি- তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

তার সাথে আমার দেখা হয়, তাকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খাঁন সাহেব আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে।

আমিতো অনেক আগেই বলেছি কিসের আরটিসি, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাঁদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।

ভাইয়েরা আমার,
২৫তারিখ এসেমব্লি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০তারিখে এসে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেমব্লি কল করেছে, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখবো আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেমব্লিতে বসতে আমরা পারি না।

আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিস্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্টকাচারী, আদালত-ফইজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্টান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিস গুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবেনা- রিকসা-ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জর্জকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবেনা। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।

এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমারা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই , তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবেনা। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবাইয়া রাখতে পারবানা। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের ডুবাতে পারবে না।

আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাঁদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই ৭ দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাঁদের বেতন পৌঁছাইয়া দেবেন। সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয় , খাজনা - ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। শুনেন , মনে রাখবেন, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্বকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই , তাঁদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও -টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাঁদের মাইনা পত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন-টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেস্টা করা হয়- বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুল। এবং তোমাদের যা কিছু তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।

মনে রাখবা, ''রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ''।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম''।

জয় বাংলা [১]

উল্লেখ্য,বঙ্গবন্ধরু বক্তৃতাকালে জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল স্লোগান, "জাগো জাগো- বাঙালি জাগো", "পাঞ্জাব না বাংলা- বাংলা বাংলা", "তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা", "তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব", "বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো।" ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে না করার প্রতিবাদে বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মচারীরা কাজ বর্জন করেন এবং বিকেল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সকল অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রিলে করা হবে- এ ঘোষণার পর সারা বাংলায় শ্রোতারা অধীর আগ্রহে রেডিও সেট নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। শেষ মুহূর্তে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেযার প্রতিবাদে বেতার কেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ে
। তখন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্র পুরনায চালু হয। [ ২ ]

এই ভাষণটির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা। ৭ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের শাসন কার্যত বিলুপ্তই হয়ে যায়। সবকিছুই পরিচালিত হতে থাকে শেখ মুজিবের নির্দেশক্রমে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সেনানিবাসেও স্বাধীনতার অনুকুল প্রতিক্রিয়া হয় । তৎকালিন মেজর (পরে জেনারেল , রাস্ট্রপতি ) জিয়া বলেন -"৭ ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলো আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ দিলাম " । [৩] তৎকালীন মেজর শাফায়াত জামিলের স্মর্তিচারণ -“বঙ্গবন্ধুর আহবান, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু , আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি , তোমরা বন্ধ করে দেবে , এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-আমাদের মধ্যে আবার দ্রুত উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনল । পরে ভেবে দেখেছিলাম , তাৎক্ষণিক উদ্যোগের কথা না থাকলেও বঙ্গবন্ধুর এই ভাষনে যুদ্ধের ইঙ্গিত ও দিক নির্দেশনা তো ছিল ।" [৪]

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যথার্থই ছিল গ্রীন সিগনাল কিন্তু সরাসরি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা নয় । উত্তাল মার্চে অনেক রাম শ্যাম যদু মদু স্বাধীনতা ঘোষণা ও নানারকম হঠকারী বক্তব্য দিলেও একমাত্র বঙ্গবন্ধু সেই চোরাবালীতে পা রাখেননি । মুজিবের রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বিচক্ষনতার প্রকাশ হয়েছিল ৭ মার্চে । যারা বলেন (আম্বালীগের কট্রর সমর্থক ) বঙ্গবন্ধু ৭ ই মার্চই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তারা যেমন ইতিহাসবিকৃতিকারী তেমনি যারা বলেন তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি এবং কামটা ভালু হয়নাই এসব তেনা প্যাচানী ও লাদানি করেন তারা ছাগু ।

৭ তারিখে কোন্ পটভূমি ও পরিস্থিতে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন এটা শুরুতেই বলা হলেও আবারও সেদিকে নজর দেয়া দরকার । “মার্চের প্রথম পাঁচ দিনে পূর্ববাংলার স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের তীব্রতা দেখে ইয়াহিয়া অপ্রত্যাশিতভাবেই আবার ঘোষণা করেন, ২৫ মার্চ থেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। এটা তাচ্ছিল্য করার বিষয় ছিল না। কাজেই ৭ মার্চের জনসভায় শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার শর্ত হিসেবে তিনটি দাবি তোলেন-কারফিউ তুলে নিতে হবে, মার্শাল ল প্রত্যাহার করতে হবে এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যা ও নির্যাতনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তিনি এ-ও জানতেন, এ দেশের অনেক মানুষ স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে জনসভায় এসেছে। কিন্তু পরিস্থিতি সেই ঘোষণার অনুকূলে ছিল না। পর্যাপ্ত সামরিক প্রস্তুতি না নিয়ে এ ধরনের ঘোষণা বিরাট বিপদ ডেকে আনতে পারত। এই নাজুক অবস্থায় মানুষকে সংগ্রামমুখী করে রাখার উদ্দেশে এবারের সংগ্রামের চরিত্র উদ্দীপ্তভাবেই তিনি তুলে ধরেন। সেই ঘোষণাকে সে সময় যেভাবেই গ্রহণ করা হয়ে থাকুক, মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা শুরু হওয়ার পর মানুষ এই আলোচনার ফলাফলের দিকেই আগ্রহী হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পরে-শেখ মুজিবের কণ্ঠে স্পেসিফিকভাবে কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা না থাকায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ৭ মার্চের ঘোষণাকে প্রত্যহ কয়েকবার করে বাজানো হয়েছে। তারও অনেক বছর পরে উত্তরসূরিদের রাজনীতি আবার সেই কথা দুটি সামনে এনে তা স্বাধীনতা ঘোষণার সমার্থক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যে পটভূমিতে, যে বাস্তবতা বোধ থেকে এবং যেভাবে ওই বক্তৃতা দেওয়া হয়েছিল, তার যথার্থতা ভাবাবেগবর্জিতভাবে এ দেশে কমই আলোচিত হয়েছে। ওটা তাঁর অনুসারীরাও করেননি, বিরুদ্ধবাদীরাও না।" [৫]

দোহাই:
১। http://www.nybangla.com/Bijoy/Documents/7th March Address.pdf
২। Click This Link
৩। ১৯৭২ সালে রচিত এবং পাক্ষিক বিচিত্রার ২৬ মার্চ ১৯৭৪ সংখ্যা প্রকাশিত জিয়ার নিবন্ধ 'একটি জাতির জন্ম'
৪। কর্নেল শাফায়াত জামিল , একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর , সাহিত্যপ্রকাশ , ঢাকা ২০০০ , পৃ ১৫ ]
৫। মঈদুল হাসান, ফিরে দেখা ১৯৭১
(পূর্ব প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৫:০১
৪৫৬ বার পঠিত
২২টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চাঁদ গাজীর ব্যান তুলে নিন/ ব্লগ কর্তৃপক্ষ ‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩




আমি যদি গাজী’ ভাইয়ের যায়গায় হতাম জিবনেও সামু’তে লেখার জন্য ফিরে আসতাম না।
হয় বিকল্প কোন প্লাটফর্ম করে নিতাম নিজের জন্য। অথবা বাঁশের কেল্লার মত কোথাও লিখতাম।
নিচে ব্লগার মিররডডল-এর করা পুরো... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের মতো প্রতিষ্ঠানের উচিত তাদের অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করা এবং বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া।

লিখেছেন জ্যাকেল , ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৫

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ভূমিকা বরাবরই সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমের কাজ হলো সত্য প্রকাশ, জনমতের প্রতিনিধিত্ব এবং গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়া। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ উঠেছে যে, বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার সাজিদ কমেন্ট অফ রাখায় এখানে লিখছি (সাময়িক)

লিখেছেন মিরোরডডল , ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:০৫


সাজিদের বিদায় পোষ্ট দেখলাম, কমেন্ট সেকশন বন্ধ রাখায় ভাবলাম এখানেই লিখে যাই।

জানিনা কি বলবো, হয়তো এটাই দেখা বাকি ছিলো।
চলে যাবার কারণ জানিনা কিন্তু অনুমান করতে পারছি।
Man! you shouldn't leave.

ব্লগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনা রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হতে যাচ্ছেন?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫৭


আজকাল মানুষ চেনা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে। কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে তা বুঝা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতে এই কথা আরো বেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কখনো বিদায় বলতে নাই

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ২৩ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



ব্লগে কিছুদিন ধরে অনিয়মিত হওয়ায় কখন কি ঘটে জানি না।
কিছুক্ষণ আগে মিররডলের একটা পোস্টে জানতে পারলাম , ব্লগার আমি সাজিদ ঘোষণা দিয়ে ব্লগ ছেড়েছেন । তার সাথে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×