somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একদিন জাপানি আইনুদের গ্রামে (৩য় পর্ব)- নুরুন নাহার লিলিয়ান

২৭ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১১:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি বিস্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে আইনু নারীদের নাচ দেখছিলাম । সেই সাথে হাতের গাইড বুক পড়ে তাদের আচার অনুষ্ঠান গুলো বুঝার চেষ্টা করছিলাম । একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম নৃত্যরত নারীরা একটু বয়স্ক । সবাই চল্লিশ বছর বয়সের উপরে । সাজ সজ্জার কারনে তাদের বয়স বুঝা কঠিন ।এখানে তরুন বয়সের কাউকে দেখা যাচ্ছে না । নারীদের পোশাক গুলো জাপানি কিমোনো স্টাইলে হলেও একদম আলাদা ।আইনু নারীরা নিজেদের সৌন্দর্য এবং ঋতুমতি হওয়ার চিহ্ন বুঝাতে ঠোঁটের চারপাশে গভীর সীমানা চিহ্নিত উল্কি একে রাখে । এছাড়া ও বাহুতেও উল্কি আঁকা আইনু মেয়েদের সাধারন বৈশিষ্ট্য ।



মেয়ে বেলা থেকেই তারা ঠোঁটে আর বাহুতে উল্কি আকে । খুব ছোট বয়সে তাদের বিয়ে হয়ে যেতো । ছেলেদের ও মাত্র ১৬ বছরেই প্রাপ্ত বয়স্ক মনে করা হতো । ছেলে মেয়ে দুজনেই কানের দুল পরতো । শুধু তা নয় আইনু ছেলে মেয়েরা নিজেদের মতো সাজাতে ভালোবাসে । আইনু মেয়েরা সাধারনত যা করে তার মধ্যে রান্না করা , সেলাই করা বা কাপড় বোনা , মাঠে কাজ করা , বাচ্চা লালন পালন করা এবং তাদের পড়াশুনা শেখানো । জাপানি ভাষায় অনেক শব্দ আছে যা আইনু ভাষা থেকে এসেছে । আইনুদের নিজস্ব ভাষা এবং বর্ণমালা ও আছে । তবে আইনু মেয়েরা সেই সময়ে যুদ্ধে অংশ নিতে পারতো । এবং আইনুদের গ্রাম্য সালিশে মেয়েদের মতামত নেওয়া বা দেওয়ার প্রথা ছিল । মেয়েরা বাচ্চাদের কোলে নেয়না । পিঠের ঝুলিতে বেধে রাখে । এমন কি বাচ্চা কখন ও ব্যথা পেলে কিংবা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলে বাচ্চাদের নিজেদের উঠে দাঁড়ানো শেখায় ।





কখন ও তাঁরা বাচ্চা কে তুলে কোলে নেয় না । আর এই প্রথা এখন ও জাপানিদের মধ্যে আছে । খুব ছোট বয়সেই বাচ্চাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সামাজিক জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার কলা কৌশল শেখানো হয় । আধুনিক জাপানি মায়েরা ও বাচ্চা নিচে পড়ে গিয়ে কান্না করলে ও তাদের বাংলাদেশি মায়েদের মতো কোলে নেয় না ।এমনকি তাকায় ও না ।তবে কখন ও বাচ্চাদের নিজেদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে । আইনু মায়েরা বাচ্চাদের কোঠর শাসনে রাখে ।
আমি আর ও একটু সচেতনতার সাথে স্টেজে আইনুদের পর্যায়ক্রমে আচার অনুষ্ঠান গুলো দেখছিলাম । একটা বিষয় দেখলাম বাঙালি গ্রামের মায়েদের মতো কাপড় দিয়ে দোলনা বানিয়ে তারা সেখানে বাচ্চাদের শুয়ে রেখে ঘুমপাড়ানি গান শোনায় । দুই তিনটা মহিলা সেই বিষয়টা গান ,নাচ আর অভিনয়ের মাধ্যমে দেখাল । মেয়েরা কিভাবে মাঠে কাজ করে , কাপড় বোনে কিংবা শিকারও করে ।





মেইজি সরকার আসার পর সেই সময়ে ব্যাপক সংস্কার এবং পরিবর্তন হয় । দীর্ঘ সময় ধরে আইনুদের নিয়ম কানুন নানা রকম প্রথা বন্ধ বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ।আইনুদের শুধু উৎপাদন হয় না এমন সব জমি দেওয়া হয় । জোর করে তাদের কৃষি কাজের দিকে ঢেলে দেয় । আইনুরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মূলধারার জাপানিদের সাথে মিশে যায় । স্কুলে স্কুলে আইনু ভাষা বাদ দেওয়া হয় । জাপানি ভাষা চালু করা হয় ।
ইতিহাসের পটপরিবর্তনে আইনুদের জীবনে ও নানা পরিবর্তন এসেছে। আইনু নেতারা চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের ঐতিহ্য কে ধরে রাখতে ।
আইনু শাসনামলের সময় আইনু গ্রাম গুলোতে প্রধানতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল শামান বা আইনু ওঝা । আইনু শামানদের প্রধান কাজ ছিল গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে তার অসুখ সারানো । তাদের নিজস্ব ঐশ্বরিক শক্তি কিংবা আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অসুস্থদের সুস্থ করে তুলতেন । শুধু তা নয় পশুর আত্মারা ও নাকি আইনুদের সাহায্য করে যে কোন রোগ সারাতে । আইনু শামান কে সবাই মেনে চলতো ।কেউ অসুস্থ হলে গ্রামের মানুষ শামান কে জানাতো । আইনু শামান কে জানালে সে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করতো ।তারপর রোগীর কাছে গিয়ে ঢোল ,ড্রাম পেটায় , জাদুর কাঠি নাড়ায় এবং পশুদের আত্মাদের ডাকা হয় নাচ গানের মাধ্যমে ।
এক সময়ে ধারনা করা হতো যে আইনুরা ইউরোপ থেকে উদ্ভুত এক জাতি । অবশ্য এর পেছনে অনেক কারন ও ছিল । আইনু পুরুষদের ইউরোপিয়ানদের মতো ঢেউ খেলানো চুল, পেশীবহুল শরীর , আর মুখ ভরা দাঁড়ি ছিল । তবে গবেষণায় দেখা যায় আইনুরা প্রাচীন " জুমন" জাতির সরাসরি বংশধর । জুমনরা উত্তর এশিয়ায় বসবাসরত প্রাচীন আদিবাসী জাতি ।





তবে এটা ও ঠিক যে আইনুদের মুখে মুখে প্রচলিত কথা বা ইতিহাস থেকে জানা যায় আলাস্কার উপকূলে বসবাসরত টলিনজিৎ জাতির সাথে একটা সম্পর্ক আছে । তবে আইনু ভাষা অন্য ভাষার সাথে কোন সম্পর্ক নেই । তবে কিছু সচেতন আইনু নেতা আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ।
বিগ হাউজে আইনুদের পরিবেশিত গান ,নাচ আর অভিনিত নানা রকম আচার অনুষ্ঠান দেখার পর কিছুটা সময় পুরো ঘরটা ঘুরে দেখলাম । মিসেস সাইতো কয়েকজন আইনু মহিলার সাথে জাপানিতে কথা বলল । ঘরের উপরের দিকে অনেক অনেক শ্যামন মাছ ঝুলানো । মাছ গুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যায় আইনুরা অনেক অনেক শ্যামন মাছ শিকার করে ।মাছই তাদের প্রধান খাদ্য দ্রব্য । সেই সাথে হেরিং মাছ ও ধরে । শুধু তা নয় তারা স্বল্প মাত্রার কৃষিকাজ ও করে । বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করে । নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারা বুনো নানারকম উদ্ভিদ চাষবাস করতো । উৎপন্ন কৃষির মধ্যে গম , শিম ,বজরা কিংবা মিলেট ।আইনু মেয়েরা আটুশ আঁশের কাপড় ও বুনতো । এলম এক ধরনের গাছ আছে । সেই গাছের তন্তু থেকেই আটুশ আঁশ তৈরি হতো । আইনু মেয়েরা ভীষণ ভাল নিয়ম মাফিক কাপড় বোনে ।
এরপর আমরা বাইরে বের হয়ে এলাম । আমার চোখে দেখা আইনু গ্রামটা একদম ভিন্ন দুনিয়া মনে হল । অন্য এক পৃথিবীর মানুষ মনে হতে লাগল ।

কিছুটা সময় আশে পাশের পরিবেশ উপভোগ করলাম । নিস্তব্ধ আইনু পরিবেশটা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম ।আইনুদের অন্যান্য ঘর গুলো অবলোকন করলাম । খুব সাধারনত আইনুদের ঘর হয় আয়তকার । দেয়াল গুলো হয় নলঘাগড়া কিংবা দূর্বা ঘাস দিয়ে । এই ঘর গুলো বাইরের দিক থেকে শিল্পিত মনে হলেও বসবাসের জন্য খুব একটা সুখকর জায়গা নয় ।
জাপানের হোক্কাইডো আইল্যান্ডের আইনু গ্রামের অঞ্চলটা বছরের বেশির ভাগ সময়ে শীত থাকে আর তুষারপাত হয় নিয়মিত । আবার অন্যদিকে বর্ষার সময়ে অনেক বৃষ্টিপাত হয় । বলা যায় প্রতিনিয়ত আইনুদের কঠিন প্রকৃতির প্রতিকুল পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলতে হয় । আইনুদের জীবন এক কঠিন সংগ্রামের নাম ।
ঘরের মেঝেতে গর্ত করে আগুন জ্বালিয়ে রাখে । তার উপরে গ্রিল বা জালি দিয়ে রাখা হয় । সেখানে মাছ মাংস পুড়িয়ে খায় । ঘরের দরজার সামনেই এক বালতিতে পানি রাখা হয় । প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য । জানালা দুটি থাকলে একটি পবিত্র হিসেবে ধরা হয় । তাই সেটি আর খোলা হয়না । ঘরে খাবার পুড়িয়ে গ্রিল করা হয় বলে অনেক ধোঁয়া থাকে সব সময় । একটা মিশ্র গন্ধ ও থাকে । আর ঘরের ছাউনিতে ফুটো কম থাকায় ধোঁয়া কিংবা গন্ধ সহজে বের হতে পারে না ।
আর বছর জুড়ে শীত এবং তুষারপাত হওয়ায় নিজেদের সারাদিনের পরিহিত কাপড় পড়েই তারা ঘুমায় ।ঘরের মধ্যে অনেক ধোঁয়া থাকায় সেখানে সময় কাটানো সাধারন মানুষদের জন্য খুব একটা আরামপ্রদ না । তবে আইনুদের ঘর গুলো ভেতরে যাইহোক বাইরে থেকে বেশ সুন্দর ।
মিসেস চিয়ো সাইতো ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুললেন । ঘর সম্পর্কে খুঁটিনাটি আমাদের বুঝিয়ে দিলেন । যদি ও গাইড বুকে খুব সুন্দর করে সব কিছুর বর্ণনা আছে । মিসেস সাইতো বর্ণনায় আর ও স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে । এরপর আমরা হাটতে হাটতে আইনু মিউজিয়ামে ঢুকলাম । এখানে এসে চোখ কপালে উঠে গেল ।

চলবে ..।।

আগের পর্ব নিচের লিঙ্কে
একদিন জাপানি আইনুদের গ্রামে পর্ব ২
http://www.somewhereinblog.net/blog/nurunnaharlilian/30232987
http://www.somewhereinblog.net/blog/nurunnaharlilian/30232987
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১১:৪৭
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×