আমি বিস্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে আইনু নারীদের নাচ দেখছিলাম । সেই সাথে হাতের গাইড বুক পড়ে তাদের আচার অনুষ্ঠান গুলো বুঝার চেষ্টা করছিলাম । একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম নৃত্যরত নারীরা একটু বয়স্ক । সবাই চল্লিশ বছর বয়সের উপরে । সাজ সজ্জার কারনে তাদের বয়স বুঝা কঠিন ।এখানে তরুন বয়সের কাউকে দেখা যাচ্ছে না । নারীদের পোশাক গুলো জাপানি কিমোনো স্টাইলে হলেও একদম আলাদা ।আইনু নারীরা নিজেদের সৌন্দর্য এবং ঋতুমতি হওয়ার চিহ্ন বুঝাতে ঠোঁটের চারপাশে গভীর সীমানা চিহ্নিত উল্কি একে রাখে । এছাড়া ও বাহুতেও উল্কি আঁকা আইনু মেয়েদের সাধারন বৈশিষ্ট্য ।
মেয়ে বেলা থেকেই তারা ঠোঁটে আর বাহুতে উল্কি আকে । খুব ছোট বয়সে তাদের বিয়ে হয়ে যেতো । ছেলেদের ও মাত্র ১৬ বছরেই প্রাপ্ত বয়স্ক মনে করা হতো । ছেলে মেয়ে দুজনেই কানের দুল পরতো । শুধু তা নয় আইনু ছেলে মেয়েরা নিজেদের মতো সাজাতে ভালোবাসে । আইনু মেয়েরা সাধারনত যা করে তার মধ্যে রান্না করা , সেলাই করা বা কাপড় বোনা , মাঠে কাজ করা , বাচ্চা লালন পালন করা এবং তাদের পড়াশুনা শেখানো । জাপানি ভাষায় অনেক শব্দ আছে যা আইনু ভাষা থেকে এসেছে । আইনুদের নিজস্ব ভাষা এবং বর্ণমালা ও আছে । তবে আইনু মেয়েরা সেই সময়ে যুদ্ধে অংশ নিতে পারতো । এবং আইনুদের গ্রাম্য সালিশে মেয়েদের মতামত নেওয়া বা দেওয়ার প্রথা ছিল । মেয়েরা বাচ্চাদের কোলে নেয়না । পিঠের ঝুলিতে বেধে রাখে । এমন কি বাচ্চা কখন ও ব্যথা পেলে কিংবা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলে বাচ্চাদের নিজেদের উঠে দাঁড়ানো শেখায় ।
কখন ও তাঁরা বাচ্চা কে তুলে কোলে নেয় না । আর এই প্রথা এখন ও জাপানিদের মধ্যে আছে । খুব ছোট বয়সেই বাচ্চাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সামাজিক জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার কলা কৌশল শেখানো হয় । আধুনিক জাপানি মায়েরা ও বাচ্চা নিচে পড়ে গিয়ে কান্না করলে ও তাদের বাংলাদেশি মায়েদের মতো কোলে নেয় না ।এমনকি তাকায় ও না ।তবে কখন ও বাচ্চাদের নিজেদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে । আইনু মায়েরা বাচ্চাদের কোঠর শাসনে রাখে ।
আমি আর ও একটু সচেতনতার সাথে স্টেজে আইনুদের পর্যায়ক্রমে আচার অনুষ্ঠান গুলো দেখছিলাম । একটা বিষয় দেখলাম বাঙালি গ্রামের মায়েদের মতো কাপড় দিয়ে দোলনা বানিয়ে তারা সেখানে বাচ্চাদের শুয়ে রেখে ঘুমপাড়ানি গান শোনায় । দুই তিনটা মহিলা সেই বিষয়টা গান ,নাচ আর অভিনয়ের মাধ্যমে দেখাল । মেয়েরা কিভাবে মাঠে কাজ করে , কাপড় বোনে কিংবা শিকারও করে ।
মেইজি সরকার আসার পর সেই সময়ে ব্যাপক সংস্কার এবং পরিবর্তন হয় । দীর্ঘ সময় ধরে আইনুদের নিয়ম কানুন নানা রকম প্রথা বন্ধ বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ।আইনুদের শুধু উৎপাদন হয় না এমন সব জমি দেওয়া হয় । জোর করে তাদের কৃষি কাজের দিকে ঢেলে দেয় । আইনুরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মূলধারার জাপানিদের সাথে মিশে যায় । স্কুলে স্কুলে আইনু ভাষা বাদ দেওয়া হয় । জাপানি ভাষা চালু করা হয় ।
ইতিহাসের পটপরিবর্তনে আইনুদের জীবনে ও নানা পরিবর্তন এসেছে। আইনু নেতারা চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের ঐতিহ্য কে ধরে রাখতে ।
আইনু শাসনামলের সময় আইনু গ্রাম গুলোতে প্রধানতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল শামান বা আইনু ওঝা । আইনু শামানদের প্রধান কাজ ছিল গ্রামের কেউ অসুস্থ হলে তার অসুখ সারানো । তাদের নিজস্ব ঐশ্বরিক শক্তি কিংবা আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অসুস্থদের সুস্থ করে তুলতেন । শুধু তা নয় পশুর আত্মারা ও নাকি আইনুদের সাহায্য করে যে কোন রোগ সারাতে । আইনু শামান কে সবাই মেনে চলতো ।কেউ অসুস্থ হলে গ্রামের মানুষ শামান কে জানাতো । আইনু শামান কে জানালে সে সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করতো ।তারপর রোগীর কাছে গিয়ে ঢোল ,ড্রাম পেটায় , জাদুর কাঠি নাড়ায় এবং পশুদের আত্মাদের ডাকা হয় নাচ গানের মাধ্যমে ।
এক সময়ে ধারনা করা হতো যে আইনুরা ইউরোপ থেকে উদ্ভুত এক জাতি । অবশ্য এর পেছনে অনেক কারন ও ছিল । আইনু পুরুষদের ইউরোপিয়ানদের মতো ঢেউ খেলানো চুল, পেশীবহুল শরীর , আর মুখ ভরা দাঁড়ি ছিল । তবে গবেষণায় দেখা যায় আইনুরা প্রাচীন " জুমন" জাতির সরাসরি বংশধর । জুমনরা উত্তর এশিয়ায় বসবাসরত প্রাচীন আদিবাসী জাতি ।
তবে এটা ও ঠিক যে আইনুদের মুখে মুখে প্রচলিত কথা বা ইতিহাস থেকে জানা যায় আলাস্কার উপকূলে বসবাসরত টলিনজিৎ জাতির সাথে একটা সম্পর্ক আছে । তবে আইনু ভাষা অন্য ভাষার সাথে কোন সম্পর্ক নেই । তবে কিছু সচেতন আইনু নেতা আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ।
বিগ হাউজে আইনুদের পরিবেশিত গান ,নাচ আর অভিনিত নানা রকম আচার অনুষ্ঠান দেখার পর কিছুটা সময় পুরো ঘরটা ঘুরে দেখলাম । মিসেস সাইতো কয়েকজন আইনু মহিলার সাথে জাপানিতে কথা বলল । ঘরের উপরের দিকে অনেক অনেক শ্যামন মাছ ঝুলানো । মাছ গুলোর দিকে তাকালেই বুঝা যায় আইনুরা অনেক অনেক শ্যামন মাছ শিকার করে ।মাছই তাদের প্রধান খাদ্য দ্রব্য । সেই সাথে হেরিং মাছ ও ধরে । শুধু তা নয় তারা স্বল্প মাত্রার কৃষিকাজ ও করে । বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করে । নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারা বুনো নানারকম উদ্ভিদ চাষবাস করতো । উৎপন্ন কৃষির মধ্যে গম , শিম ,বজরা কিংবা মিলেট ।আইনু মেয়েরা আটুশ আঁশের কাপড় ও বুনতো । এলম এক ধরনের গাছ আছে । সেই গাছের তন্তু থেকেই আটুশ আঁশ তৈরি হতো । আইনু মেয়েরা ভীষণ ভাল নিয়ম মাফিক কাপড় বোনে ।
এরপর আমরা বাইরে বের হয়ে এলাম । আমার চোখে দেখা আইনু গ্রামটা একদম ভিন্ন দুনিয়া মনে হল । অন্য এক পৃথিবীর মানুষ মনে হতে লাগল ।
কিছুটা সময় আশে পাশের পরিবেশ উপভোগ করলাম । নিস্তব্ধ আইনু পরিবেশটা অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম ।আইনুদের অন্যান্য ঘর গুলো অবলোকন করলাম । খুব সাধারনত আইনুদের ঘর হয় আয়তকার । দেয়াল গুলো হয় নলঘাগড়া কিংবা দূর্বা ঘাস দিয়ে । এই ঘর গুলো বাইরের দিক থেকে শিল্পিত মনে হলেও বসবাসের জন্য খুব একটা সুখকর জায়গা নয় ।
জাপানের হোক্কাইডো আইল্যান্ডের আইনু গ্রামের অঞ্চলটা বছরের বেশির ভাগ সময়ে শীত থাকে আর তুষারপাত হয় নিয়মিত । আবার অন্যদিকে বর্ষার সময়ে অনেক বৃষ্টিপাত হয় । বলা যায় প্রতিনিয়ত আইনুদের কঠিন প্রকৃতির প্রতিকুল পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলতে হয় । আইনুদের জীবন এক কঠিন সংগ্রামের নাম ।
ঘরের মেঝেতে গর্ত করে আগুন জ্বালিয়ে রাখে । তার উপরে গ্রিল বা জালি দিয়ে রাখা হয় । সেখানে মাছ মাংস পুড়িয়ে খায় । ঘরের দরজার সামনেই এক বালতিতে পানি রাখা হয় । প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য । জানালা দুটি থাকলে একটি পবিত্র হিসেবে ধরা হয় । তাই সেটি আর খোলা হয়না । ঘরে খাবার পুড়িয়ে গ্রিল করা হয় বলে অনেক ধোঁয়া থাকে সব সময় । একটা মিশ্র গন্ধ ও থাকে । আর ঘরের ছাউনিতে ফুটো কম থাকায় ধোঁয়া কিংবা গন্ধ সহজে বের হতে পারে না ।
আর বছর জুড়ে শীত এবং তুষারপাত হওয়ায় নিজেদের সারাদিনের পরিহিত কাপড় পড়েই তারা ঘুমায় ।ঘরের মধ্যে অনেক ধোঁয়া থাকায় সেখানে সময় কাটানো সাধারন মানুষদের জন্য খুব একটা আরামপ্রদ না । তবে আইনুদের ঘর গুলো ভেতরে যাইহোক বাইরে থেকে বেশ সুন্দর ।
মিসেস চিয়ো সাইতো ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুললেন । ঘর সম্পর্কে খুঁটিনাটি আমাদের বুঝিয়ে দিলেন । যদি ও গাইড বুকে খুব সুন্দর করে সব কিছুর বর্ণনা আছে । মিসেস সাইতো বর্ণনায় আর ও স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে । এরপর আমরা হাটতে হাটতে আইনু মিউজিয়ামে ঢুকলাম । এখানে এসে চোখ কপালে উঠে গেল ।
চলবে ..।।
আগের পর্ব নিচের লিঙ্কে
একদিন জাপানি আইনুদের গ্রামে পর্ব ২
http://www.somewhereinblog.net/blog/nurunnaharlilian/30232987
http://www.somewhereinblog.net/blog/nurunnaharlilian/30232987
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১১:৪৭