তারা সবাই তখন চেতন অবচেতনের মাঝামাঝি। তাদের একজন পরেশ দত্ত, কারো কাছে শুনেছে যে মস্তিস্কের বিশেষ এই স্তরটির নাম গামা স্তর। স্তরের নাম ভুলও হতে পারে। তবে সেটা চেতন অবস্থার উপরে বা নিচে হবে এটা নিশ্চিত। রুকু তাই ক্ষেপে ওঠে- প্যাঁচাল বাদ দ্যান। যেটা ঠিকমত জানেন না, সেটা নিয়া এত বকেন ক্যান?
পরেশের ক্ষেপে ওঠার কথা। কিন্তু সে একেবারে চুপ মেরে গেল। এর রহস্য অবশ্য রেজাসহ মজলিসের আর সবারই জানার কথা। কিন্তু আর সবাই না হাসলেও রেজার ঠোটের কোণে একচিলতে হাসি উঁকি দেয়। তাতে হালকা শব্দ যোগ হলে পরেশ আপত্তি তোলে - " আরে ভাই হাসেন ক্যান, আমি যতটুকু জানি, আপনি তো সেটাও জানেন না।"
রেজা তার হাসি মুখটাকে স্বাভাবিক করে নেয়, কোন প্রকার প্রতু্ত্তর ছাড়াই। এটাই তার স্বভাব। একেবারে দেয়ালে পিঠ না ঠেকে গেলে বুক উঁচিয়ে দাড়ানো হয় না তার। কথার পৃষ্ঠে কথা বলা তার ভালো লাগে না একদমই। এতে কথা বাড়ে, কিন্তু ফল আসে না, অহেতুক। রেজা তাই সবুজ বোতলটির দিকে তাকায়। একেবারে তলানিতে এসে পড়েছে। আর বড়জোর এক পেগ হবে। আরও এক পেগ! কথাটা ভাবতেই রেজার চোখ উপরে ওঠে। উপরে খোলা আকাশ না, বদ্ধ ছাদ। চোখগুলো তাই বেশিদূর উপরে উঠতে পারে না। একটু ঘুরে আবার আগের অবস্থানেই ফিরে আসে। আজ যে করেই হোক ছয় পেগ মারতেই হবে, পাঁচটা তো পেরেছি, ওটাও পারব। ওরা যদি পারে আমিও পারব। একটু অন্যরকম লাগছে, তা লাগুক। পারবই -- রেজার এমন দৃঢ় প্রত্যয়ী হবার শপথগ্রহণের অন্তিমে আজিজের ভারি কন্ঠস্বর শোনা যায়।
-- লেডিস এন্ড জেন্টেলমেন, ওহ স্যরি, এখানে তোi কোন লেডিস নেই। বাক্য আবার শুরু করছি। হ্যাল্লো জেন্টেলমেন, নাউ আই মিস্টার আজিজ মিয়া উইল রেনডার এ্যা সং বিফোর ইউ। প্লিজ, ডোন্ট মেক অ্যানি নয়েজ হোয়াইল সিংগিং।
আর সবার মত রেজার মনোযোগও আজিজের কন্ঠ থেকে কি বের হবে সেদিকটায় নিবদ্ধ হয়। আজিজ হাতের গিটারের টিউন করা শুরু করলে রিপনের হাতের আঙ্গুলগুলি খালি কোকের বোতলটায় বাড়ি দিতে শুরু করে। ঢোল বা খোলজাতীয় কিছু হলে ভালো হত। তাল দেবার কাজ ভালোভাবে করা যেত। তবে আজিজ তালের গান গাইবে কিনা সন্দেহ। বা তাল থাকলেও কতটুকু তালে গা্ওয়া হবে সেও বড় প্রশ্ন। রিপন তাই কোকের বোতলেই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করে।
আজিজ গান শুরু করে। গলায় সুর তত মিস্টি না হলেও স্বরে অন্যরকম আবেদন আছে। আবেদনটা কি- গান শুনতে শুনতে কার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করে অমুল্য রায়, পাশে বসা শহীদের ভাষায় জাত মালাউন, নেড়ি হিন্দু। দত্ত না পারলেও রায় নিজেকে গোমাংস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পেরেছে। এজন্য খোটা্ও শুনতে হয়েছে প্রচুর, এখনও শুনতে হয়। রায় গান শুনতে থাকে মনোযোগ দিয়ে আর খুঁজতে থাকে আজিজের স্বরের বিশেষ আবেদনটি কী।
আজিজ যখন গা্ওয়া আর রায় যখন খোঁজায় ব্যস্ত, তখন শহীদের পেচ্ছাবের চাপ চরমে ওঠে । অনেকক্ষন থেকেই চাপ ছিল। শহীদ উঠে পড়ে। ফ্লোর করা বিছানার অপর পাশে থাকা রেজা আর রিপনের মনোযোগ কিছু সময়ের জন্য হলেও শহীদের ভাগে চলে যায়। চেয়ারে বসে থাকা গায়ক আজিজের নজরেও বিষয়টি এড়িয়ে যায় না। মজমার আর একটু পরে হলে অবশ্য আজিজ টের পেত না। কেননা প্রথম গান শেষ হবার পর দ্বিতীয় গান থেকে তার তার আবেগের জোর আরও বেশি হয়। আবেগে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। রিয়েলিটি শোর বিচারক থাকলে একে নির্ঘাত দরদ বলে প্রসংসা করত। তাছাড়া, বাস্তবিকই এটা দরদ।
শহীদ ফিরে আসে গানের একেবারে শেষের দিকে। "নীরব সবি, ক্লান্ত সবি, তবু ভাবি তোমার ছবি" - গান শেষ হলে সবাইকে সত্যিই ক্লান্ত দেখায় এক আজিজ ছাড়া।
--শহীদ ভাই, আপনের গান ভালো লাগে না বললেই পারেন। একটা মানুষের সবকিছু ভালো লাগতে হবে এমন তো না। শেয়ার করেন ভালো না লাগার বিষয়টা। কিন্তু গানের মাঝখানে বিরক্তি দেখিয়ে বাইরে গিয়ে অন্যকে হিউমিলিয়েট করা নিশ্চয় ভালো কোন বিষয় নয় -- অাজিজের কন্ঠ থেকে রাগ ক্ষোভের স্ফুরন চোখে পড়ে রায়ের । আগের সেই আবেদন নাই হয়ে গেছে।
-- শোনেন জ্ঞান দেবেন না। আর রাগও দেখাবেন না । আমি আপনার খাই না পড়ি। আমার স্বাধীনতা নিয়া আমি চলতে পারবো না, নাকি!?
শহীদের গলায় মজলিসের প্রথম প্রতুত্তর উচ্চারিত হয়। ব্যাকরণবিদের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, যেমন বাঘা তেতুল তেমন বুনো ওল। একটু ভুল হলো নাকি? সে যাই হোক, এরকম কিছু একটা হবেই-- রেজার ঠোটে আবার হাসির রেখা ফুটে ওঠে। তবে, এবারে শব্দ ছাড়া।
-- হ্যা, আপনার স্বাধীনতা আরেকজনকে কষ্ট দেবে , সেইটা কী? আজিজ গিটার হাত থেকে নামিয়ে টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে রেখে চেয়ার থেকে নেমে ফ্লোরে বসে পড়ে।
-- আমি কাউকে কষ্ট দেই নি, দেবার প্রশ্ন্ও আসে না। শহীদের উত্তর শোনা যায়।
সিগারেটের প্যাকেটটা? আজিজের প্রশ্ন ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে বোঝা না গেলেও লাল ডিম লাইটের আলো আধারিতে সবাই নড়েচড়ে আশেপাশে তাকায়। নাহ। সিগারেটের প্যাকেট হা্ওয়া হয়ে যায় নি। রুকুর পেছনে অবহেলায় পড়ে থাকা প্যাকেটের অস্তিত্ব সাত জোড়া চোখের কোন এক জোড়ায় পড়তে বাধ্য। সৌভাগ্যক্রমে সেই চোখ জোড়া চোখের মালিক অমুল্য রায়। রায় নিজে একটা সিগারেট হাতে নিয়ে আজিজের দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দেয়।
-- কাউকে কষ্ট দিচ্ছেন কি না তাতো বোঝার ক্ষমতা এখন আপনার নেই । এখন তো শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতার কথাই বোঝেন-- আজিজ সিগারেটে প্রথম টান দিয়েই পূর্বের বচসায় আবারও ফিরে যায় রিপনের ভাবনাকে ভুল প্রমানিত করে। যাক ঝড় থামলো তবে- এমনটায় ভেবেছিলো রিপন এবং খালি কোকের বোতলে তাল দেবার জন্য হাতের আঙ্গুলগুলোও খেলাতে শুরু করেছিলো।
-- কেন, আপনি ব্যক্তি স্বাধীনতার চর্চা করেন না? তাহলে আমার দোষ কোথায়?
-- হ্যাঁ, তাতো করিই। তবে আপনার মতো হঠাৎ না।সারাজীবন যৌথতার কথা বললেন আর এখন পুরাই ভোল পাল্টে ফেলেছেন। আজিজ মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে বলতে থাকে। শহীদের কপালে ভাঁজ পড়ে। রাগে না দুঃখে, বোঝা যায় না ঠিকমত।
-- ভদ্রভাবে কথা বলবেন । অাপনার সাথে ঝগড়া করতে এখানে আসিনি। আপনি নিজেকে ভাবেনটা কী। খালি সবাইকে খোঁচাতে চান।
নিজের কথা একবার ভাবেন। কোনখানে ঠাঁই করতে না পেরে এখনতো স্ট্রিট সিংগার। দশ-পাঁচ টাকার অনুষ্ঠানেও তো ডাক পড়ে না ।
আজিজ বিব্রত বোধ করে বেশ। সবাই কিভাবে তাকাচ্ছে বুঝতে পারলে ভালো হত। কিন্তু , এখন তা সম্ভব নয়। তাই থামলে চলবে না।
-- আর আপনি তো মাছি মারা কেরানি। দুই টাকার ঘুষও ছাড়েন না। আজিজ গলা কাঁপতে থাকে।
-- আপনি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন কিন্তু। আর একটা্ও কথা বলবেন না বলে দিলাম। শহীদের গলায় যেন হারমোনিয়ামের তারার রিডগুলো বাজতে শুরু করে।
--কী করবেন? আজিজও তারায় কথা বলতে থাকে। সাথে তর্জনির ব্যবহার শুরু হতে থাকে।
-- আঙ্গুল নামান। শহীদ প্রায় চিৎকার করে ওঠে। চিৎকারের শব্দে মাঝরাতের নিস্তব্দতায় প্রতিধ্বনির সৃষ্টি হয় আর তাতে সবাই যেন সচকিত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি হয় রুকু। তার পেছনে কারণও বিদ্যমান। দু-রুমের এই ফ্লাটের মালিক সেই। অফিসপাড়া হলেও তিনতলা এই বিল্ডিংটায় আরো কয়ঘর মালিক বা ভাড়াটিয়া থাকে। মাঝরাতের এই চিৎকার নিশ্চয় তাদের আরামের ঘুম হারাম করবে। এর ফল পা্ওয়া যাবে কালকেই। এমনকি এখনও যে কেউ চলে আসতে পারে, বলতে পারে-- এত রাতে এইসব কি শুরু করলেন, ঘুমাতে দেবেন না, নাকি। যত্তসব।
-- থামবেন আপনারা। মাল খেয়ে এভাবে কান্ডজ্ঞান হারাবেন জানলে সত্যিই কাউকে আসতে বলতাম না। রুকুুর শান্ত থমথমে গলার আ্ওয়াজে সিন যেন মুহুতেই খতম হয়ে যায়। দুজনই মিইয়ে যায় লেবুর চেপ্টা কোয়ার মত।
হঠাতই সব নিশ্চুপ হয়ে গেল। এই লাইনে এরা কেউ নতুন নয়। কথাটা তাই সবার লাগে, লাগে একেবারে ইগো নামীয় বস্তু বা স্থানটিতে। ভীষণ প্রতিক্রিয়া হবার কথা। কিন্তু প্রচন্ড চাপের কারণে পাত্রের ভিতরে বাষ্প জমতে থাকে, বের হয়ে আসতে পারে না। তবে বাইরে থেকে চাপটা ভালোই বোঝা যায়। এই যেমন বুঝতে পারছে রেজা, যার ইগো নামের বস্তুটা প্রায়ই নেই। নেই বলেই এই মুহুর্তে সবাইকে পর্যবেক্ষনের মত গুুুুরুগম্ভীর কাজে তার তেমন সমস্যা হচ্ছে না। উল্টো মজাই লাগছে। হুদায় চারদিকে বরফ হয়ে গেল সবকিছু, বোগাস! ঠান্ডায় সবাই কাঁপছে, এক সে ছাড়া। হাসিও পাচ্ছে। কিন্তু এখন হাসলে বা হাসার মত ভাব করলে বিপদ- এইটুকু বোঝার মত আক্কেল তার সব সময়ই থাকে। মানুষ চড়ে খায়তো, না বুঝলে তাই চলে না। ইন্সুরেন্স এর চাকরী। কতজনের কত কথাই না শুনতে হয়।- আরে ভাই, ঝামেলা কইরেন না, আমার দরকার নাই; কোম্পানির ঠিক নাই, ভুয়া সব; আপনার নামে আজে বাজে কথা শোনা যায়, মানুষকে নাকি ঠকান--আরও কত কি! সব হাসিমুখে মানতে হয়। রাগলেন তো হারলেন- বাক্যটা্ই এখন জীবনের বড় সত্য। লেনিন বা চে' নয়, তার সামনে ভগবান বুদ্ধ বা বাপুজীই আদর্শ। অহিংসা পরম ধর্ম। সর্বেং সুকিতা ভবন্তু। তোমাকে কেউ অপমান করলো, কিছু বলার দরকার নাই,ওর অপমান ওর কাছেই ফিরে যাবে। অপমান হলো পুরস্কার বা উপহারস্বরূপ। না নিলে মালিকের কাছেই থাকে-- ।আহা! এর থেকে দামী কথা আর দুনিয়াতে নেই।
রেজার এটাই বিশ্বাস। আর বিশ্বাস একদিনে আসে নি। পথের প্রত্যেক বাধাতে হোচট খেয়ে তারপর তা ডিঙ্গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছার প্রক্রিয়ায় তার মনে এটাই গেথে আছে শাল কাঠে গাথা পেরেক হিসাবে। এই মজলিসে আর সকলের চেয়ে তার টাকার পরিমাণ বেশি, আর সুখশান্তিও বেশি। তবে ছোট একটা ঝামেলা আছে, মাঝে মাঝে ভোগায় অার কি। বুকের ভিতর একটা দানোর মত কেউ খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তখন বুক ব্যাথা করে।
পাঁচ মিনিট, সাত মিনিট, দশ মিনিট। বরফ গলে না। মাঝে আজিজ আর একটি সিগারেট ধরিয়ে শেষ করে ফেলে। আসর আজ এখানেই শেষ-- দত্তের বোঝা শেষ। বাসায় ফিরতে হবে। বউ যে কি বলবে, ভগবান মালুম।জীবনে এই একটাই ভুল তার, বিয়ে করা। বন্ধুদের সাথে মেলামেশা একদম সহ্য করতে পারে না। দেখতে শান্ত সুন্দর, ভেতরে গনগনে আগুন। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবাকে সহ্য করতে পারে না তার বউ। বাবার জন্য খারাপ লাগে। মা মরে গিয়ে বেঁচে গেচে এবং বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। মা থাকলে দুঃখ আরও বাড়ত। কারবারটাও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। কি যে হবে। দূর ছাই! এখানে থাকার কোন মানে আর হয় না। পরেশ মজলিস থেকে উঠে পড়ে আচমকাই- - আমি যাচ্ছি।
রেজাও যেন সম্ভিত ফিরে পায়। দাদা থামেন, আমিও যাবো। শহীদ ভাই যাবেন না?
শহীদ কোন কথা না বলে উঠে দাঁড়ায়। ওদের একইদিক যেতে হবে এই পাড়া পেরিয়ে শহরের গোরস্তান গেট পর্যন্ত। তারপর ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্য। শহীদের গায়ের রাগ এখন্ও কমেনি। শরীর ভিতরে ভিতরে ভয়ানক কাঁপছে।
একটু আগে রেজা আর পরেশ বিদায় নিলে শহীদ একা হাটতে থাকে। সামনেই গোরস্তান গেট পার হলেই তার বাসা।
রাত কয়টা এখন, একটা না দুইটা, না তিনটা? হাতে ঘড়ি নেই, ফোনে্ও চার্জ নেই।ধুত্তেরি, একটা নেড়ি কুত্তা্ও জেগে নেই।ভিতরের রাগ পাদুটোর সাথে সাথে ক্লান্ত, অবসন্ন।ও ভাই শোনেন - পেছন থেকে কেউ একজন ডাকলে শহীদের পাদুটো থামে, চোখদুটো মাথাসমেত মাত্রামত পিছন ফিরে তাকায়।
-- ভাই, একটু সাহায্য করা লাগবে। একটা লাশ গোরস্তানে নিয়ে যেতে হবে। একজনের অভাব। আমরা তিনজন, আপনি আসলেই চারজন হবে। আসেন রে ভাই, দয়া করে একটু আসেন।
অচেনা কন্ঠের আকুতিতে শহীদের দিল মুহুর্তেই নরম হলে পেছনে হাঁটা শুরু করে। রাতের কোন ভৌতিক কান্ড এটি অবশ্যই নয়। ভুতে বিশ্বাস তার কোনকালেই ছিল না, এখনও নাই।
'' লাশের মুখ দেখবেন- আপনার চেনা লোক" , কেউ একজন বলে সম্মতির অপেক্ষা না করেই মুখটা খোলে। চেনা চেনা লাগছে। কোথায় যেন দেখেছে, শহীদের মনে হলো। ঠিক খেয়াল হচ্ছে না। ও মনে পড়েছে- লোকটার সাথে তো আজকেই দেখা হয়েছে, অফিসে। একটা ফাইল আটকে আছে, হাজার তিনেক হলেই পাস হয়ে যাবে। লোকটা গরীব বলে বড় সাহেবকে কমেই রাজি করিয়ে নিয়েছিল সে। নাহলে এরকম কেসে দশের কমে হয় না। ফাইল পাস হলেই নগদে দুই লক্ষ টাকা পেত। বেচারি!
-- ভাই, লোকটা মারা গেল কিভাবে? শহীদ জানতে চায়।
-- ফাঁস দিয়ে। অনেক দেনা লোকটার। বউ বাচ্চা্ও অনেক আগে ছেড়ে চলে গেছে। মনেহয় দেনার কারণেই ফাঁস নিছে। লোক ভালোই ছিল, কিন্তু কপাল খারাপ হয়ে যা হয় আর কি।
খাটিয়ার এক প্রান্ত শহীদের কাঁধে। ভীষন ভারী। আগে কখন্ও লাশ কাধে নেবার অভিজ্ঞতা ছিল না। লাশ এত ভারী হয় জানলে রাজী হবার কোন কথাই আসত না। একেবারে জান বের হবার দশা। শ্বাস নেয়াও যাচ্ছে না। শালা রোগা পটকা একটা মানুষের এত ওজন হয় কি করে! ওহ, ভাবাই যাচেছ না। ইয়া আল্লাহ, বাঁচা্ও। এটা মানুষ না জীনভূত? দৌড় না দিলে নির্ঘাত মারা পড়তে হবে। শহীদ আর মুহুর্ত দেরি না করে খাটিয়া ফেলে দৌড় লাগায়। কিছুদূরের একটা পিলারে হোঁচট খায় সে। রক্ত বেরোল কি? থাক, এসব ভাবলে এখন চলবে না।
-- যাইয়েন না রে ভাই, লাশটার একটি সদগতি করেন। আল্লাহর দোহাই লাগে, একটু দাঁড়ান। একটা স্বরের অার্তি শোনা যায়।
আর্তস্বরটি ক্রমেই কাছে আসতে থাকে। শহীদ হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়, দূরত্ব বাড়াতে চায় তাড়াতাড়ি। আর্তকন্ঠের পায়ের গতি বাড়ে, সাথে কথার গতি -- ও ভাই যাইয়েন না, রসুলের দোহাই, থামেন রে ভাই।
না। এখন থামলে চলবে না। দৌড়াতে হবে। শালা লাশটার যা ওজন, আরেকবার কাধে নিলে স্রেফ মারা যেতে হবে। শহীদ দৌড় শুরু করে। দৌড়াতেই থাকে।
আর একটু দৌড়ালেই তার বাড়ি।
ফুলছড়িঘাট, গাইবান্ধা
২২.১২.১৬
বি.দ্র. ছবি নেট থেকে সংগৃহিত।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৫১