প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’ এই প্রতিপাদ্য এবং ‘ প্রকৃতি সংরক্ষণ করি, প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করি’ শ্লোগানে আজ ৫ই জুন পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস (World Environment Day/ WED)। প্রকৃতি আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হয়তো অনেকেই করোনা মহামারীর পর কিছুটা বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে বহু বছর ধরে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণ রোধ ও পরিবেশ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছরের মতো এবারও ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসাবে পালন করছে সারাবিশ্বের মানুষ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও দিবসটি পালন করছে। পৃথিবী ও প্রকৃতি রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে প্রতি বছর ৫ জুন ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্য নিয়ে এ দিবসটি পালিত হয়। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইকোসিস্টেম রেস্টোরেশন বা ‘প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার, হোক সবার অঙ্গীকার’। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ সকল জাগতিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত গাছপালা, পশুপাখি অতি আহরণের ফলে জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বর্তমানের উৎপাদন পদ্ধতি এবং ভোগবাদী জীবনযাপন অব্যাহত থাকলে ধরিত্রীর প্রতিবেশ ব্যবস্থা অচিরেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। আমাদের সকলকেই তাই প্রতিবেশ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা তৈরী করা, প্রকৃতিকে ভালোবাসা। যদিও প্রকৃতিকে প্রতিদিন ভালোবাসা উচিৎ তবু আজকের এই দিনে সারা বিশ্বের মানুষ আপন করে নেয় প্রকৃতিকে, পরিবেশকে। দিবসটি বিশ্বের বা একটি নির্দিষ্ট দেশের সম্মুখীন পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করতে পালন করা হয়। এটিই দিবসটির মূল তাৎপর্য। প্রতিবছর কোন একটি দেশ এবং একটি থিম নির্দিষ্ট করা হয় এই দিবসটি উদযাপনে। এই বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম 'বাস্তুতন্ত্রের পুনরুদ্ধার করা' (Ecosystem Restoration)। বর্তমান অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে অতীতকে ফেরানো সম্ভব নয় ঠিকই। কিন্তু আমরা গাছ লাগাতে পারি, আমাদের আশেপাশের শহরকে আরও সবুজ করতে পারি, বাড়ির বাগান পুনর্নির্মাণ করতে পারি, নিজেদের ডায়েট পরিবর্তন করতে পারি এবং নদী ও উপকূল পরিষ্কার রাখতে পারি। আমরা এমন একটি প্রজন্ম যারা এই সবের মাধ্যমে প্রকৃতির শান্তি বজায় রাখতে পারি। আর সেই জন্যেই এবছর এই থিমটি বেছে নেওয়া হয়েছে।
পরিবেশই প্রাণের ধারক, জীবনীশক্তির বাহক। সৃষ্টির শুরু থেকেই পরিবেশের সঙ্গে প্রাণীর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার ওপরেই তার অস্তিত্ব নির্ভর করে আসছে। পরিবেশ প্রতিকূল হলে জীবের ধ্বংস ও বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। পরিবেশের ওপর নির্ভর করে মানুষ, অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী-জীবনের বিকাশ ঘটে। তাই পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় যোগসূত্র। কিন্তু নানা কারণে পরিবেশদূষণ সমস্যা প্রকট হওয়ায় মানবসভ্যতা আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে চলছে নানা ধরনের গবেষণা। আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন পরিবেশ-প্রকৃতি। কিন্তু প্রতিনিয়ত এ পরিবেশকে আমরা নানাভাবে দূষিত করে আসছি। বিশ্বজুড়ে এখন পরিবেশদূষণের মাত্রা ভয়াবহ। পরিবেশদূষণের উল্লেখযোগ্য কারণের মধ্যে রয়েছে অত্যাধিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, দ্রুত শিল্পায়ন, সার ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য, গাড়ির বিষাক্ত ধোঁয়া, ওজোন স্তরের ক্ষয়, অ্যাসিড বৃষ্টি, অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ, দারিদ্র্য, প্রসাধনসামগ্রী, প্লাস্টিক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। ভয়াবহ পরিবেশদূষণের কবলে পড়ে আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। অপেক্ষা করছে এক মহাধ্বংস! আজ জলে বিষ। বাতাসে আতঙ্ক। মাটিতে মহাত্রাস। গত ৬০ বছরে ৮০টির বেশি প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কয়েক শ প্রজাতির গাছপালা বিলুপ্ত। বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণ নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ৫ জুনকে ঘোষণা করেছে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে প্রতিবছর ৫ই জুন সারা বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। তবে প্রথম পরিবেশ দিবস উদযাপিত হয় দুবছর পর ১৯৭৪ সালে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত কয়েকটি শহরের মধ্যে একদম প্রথম দিকে আছে আমাদের ঢাকা। ঘর থেকে বের হলেই মুখোমুখি হতে হয় দূষিত এবং স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর পরিবেশের সাথে। পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা, এর উন্নয়নের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি এখনই। কি্ন্তু পরিবেশ এমনই একটি বিষয় যার পরিবর্তন রাতারাতি আসে না, আনা সম্ভবও নয়।
স্বাধীনতার পর পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশজুড়ে বৃক্ষরোপণসহ বিভিন্নমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই ধারাবাহিকতায় সরকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পূর্বক বাসযোগ্য টেকসই পরিবেশ নিশ্চিতকরণে নিরলসভাবে কাজ করছে। দিবসটি উপলক্ষে আজ জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ২০২১ এর উদ্বোধন ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেলা ১টায় গণভবনে ‘সোনালু’ ,‘জাম’, ‘আমড়া’ ও ‘ডুমুর’ গাছের ৪টি চারা রোপণের মাধ্যমে এই অভিযানের উদ্বোধন করা হবে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় জানায়, ‘মুজিববর্ষে অঙ্গীকার করি, সোনার বাংলা সবুজ করি’ প্রতিপাদ্যে এবারের জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান-২০২১ উদযাপন করা হবে। এ শ্লোগান মুজিববর্ষে বৃক্ষরোপণের অঙ্গীকার বাংলাদেশকে সবুজে শ্যামলে ভরিয়ে দিতে সর্বস্তরের জনসাধারণকে উজ্জীবিত করবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসাবে দেশব্যাপী বিনামূল্যে এক কোটি বৃক্ষের চারা রোপণের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে যা পরিবেশ সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। তাই আমাদের উদ্যোগ নেবার সময় এখনই। প্রতিটি ছোট ছোট উদ্যোগ, পরিবর্তন বা আইডিয়া নিয়ে আসতে পারে বড় পরিবর্তন। বড় মাপের উদ্যোগ বা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছোট ছোট পরিবর্তন, উভয়ই দরকার একটি পজেটিভ উন্নয়নের জন্য। আজকে পরিবেশের জন্য নেয়া ভাল কোন উদ্যোগ আমাদের ভবিষ্যতকেই আরো সুরক্ষিত করবে। তবে গাছ শুধু রোপণ করলেই হবে না সেগুলো সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় রোপণ করা হচ্ছে কিনা তাও দেখা দরকার। রোপণের পরের পরিচর্যার কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তাও মনিটরিং জরুরি। এবারের পরিবেশ দিবসে অবশ্যই একটি গাছ লাগিয়ে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করুন। তবেই মানবজাতি হবে সুরক্ষিত।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
ব্রেকিং নিউজ২৪.কম ফেসবুক-১ ফেসবুক-২
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২১ রাত ২:০১