আজ ভয়াল ২৫শে মার্চ, মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। ১৯৭১ সালের এইদিনে বাঙালী জাতির জীবনে নেমে আসে এক বিভীষিকাময় রাত। এ রাতে বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’র নামে স্বাধীনতাকামী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে হিংস্রের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আর এদিন বাঙ্গালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল এক নৃশংস বর্বরতা। বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলন, এমনকি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে প্রাপ্ত আইনসঙ্গত অধিকারকেও রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী শুরু করেছিল সারাদেশে গণহত্যা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচালিত এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির মুক্তির আকাঙ্খাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করা। সেইরাতে হানাদাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, শিক্ষকদের বাসা, পিলখানার ইপিআর সদরদপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একযোগে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হত্যা করে অগণিত নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। এছাড়াও সেই রাতে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসকাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুঁড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মীকেও। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সর্ম্পকে লিখেছেন, সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট লুট । আর ধ্বংস সাধন তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। ঢাকার রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক- শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি“। ওই পাইকারি গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ব চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়: “১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশী মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।” অপারেশন সার্চলাইটকে নিছক বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের একটি সামরিক চেষ্টা মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল এক ভয়াল গণহত্যার নীলনকশা, গোপনে গোপনে যার প্রস্তুতি চলছিল অনেক আগে থেকেই। পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের মনে বাঙালিরা সব সময়ই ছিল নীচু শ্রেণির, যাঁদের ভাষা-সংস্কৃতি থেকে জীবনাচরণ-সবই ছিল ‘অপাকিস্তানি’। অখণ্ড পাকিস্তানের নামে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী সেই অপাকিস্তানিদের ‘শুদ্ধ’ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট শুরু করেছিল। যার ফলে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হয় বাংলাদেশে। কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও মেলেনি গণহত্যার স্বীকৃতি। এর কারণ মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের জাতীয় সংসদে গৃহীত সিদ্বান্ত বাস্তবায়নে চোখে পড়ার মতে তেমন কোন কূটনৈতিক তৎপরতা নাই। আশার কথা স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর গত বছর ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে সর্বসম্মত প্রস্তাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ এক ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছর থেকে আমরা আজকের দিনটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করছি। বিশ্ববাসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ নানা নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে জ্ঞাত রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল সেই খবর এখনও বিশ্বের অনেকের কাছে অজানা। মাত্র নয় মাসে এবং যে দ্রুততায় বাংলাদেশে মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দৈনিক গড়ে ৬০০০ মানুষ খুন করা হয়েছে মাত্র ২৬০ দিনে। কম্বোডিয়ায় এই হার ছিল ১২০০। আমরা চাই, আমাদের ওপর দিয়ে যে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা চালানো হয়েছিল, সমগ্র বিশ্বই তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হোক। সামহোয়্যার ইন ব্লগের পক্ষ থেকে ভয়াল সেই ২৫ র্মাচ রাতের সকল শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। তারা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মতা হস্তান্তর না করে গোপনে গোপনে নিতে থাকে সামরিক প্রস্তুতি। মুক্তিকামী বাঙালি তখন স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বেলিত। আলোচনার নামে শাসকগোষ্ঠীর সময়পেণকে বাঙালিরা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। ােভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার একটি দিকনির্দেশনামূলক রূপরেখা পেশ করেন, যা ছিল প্রকৃতপে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মূলমন্ত্র। তত্কালীন সামরিক জান্তা বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের এ আকাঙ্খাকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজ বোঝাই করে সৈন্য ও গোলাবারুদ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়। বিষয়টি বাঙালিদের অজানা ছিল না। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে তারা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। পাকিস্তানি জান্তারা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের পথ বেছে নেয়। পরিণতিতে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিােভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। নস্যাৎ হয়ে যায় পাকিস্তানের দুইটি অংশের একত্রে থাকার সকল সম্ভাবনা।
একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনে বাঙালির জীবনে নেমে আসে নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চুড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন যা প্রথম কালুরঘাট বেতর কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়।বঙ্গবন্ধুু তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণায় যে কোন মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ইপিআর সদর দপ্তর এবং দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে। শুরু হয়ে যায় সীমিত পর্যায়ে মুক্তি সংগ্রাম। ২৫ মার্চ রাতেই পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা শুরু করে প্রতিরোধ যুদ্ধ, সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ। এই প্রতিরোধ যুদ্ধই সূচনা করে সহায়- সম্বলহীন গৃহহারা, সর্বহারা বাঙালি জাতির প্রত্যক্ষ মহান মুক্তিযুদ্ধের। এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
ঢাকার ইপিআর সদর দফতর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। সেদিন মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়। পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানানদার বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকসা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালীদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাজার হাজার নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। হত্যাযজ্ঞ চলে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল পরিণত হয় ভূতুরে এলাকায়। হানাদারেরা রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। মেডিকেল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুঁড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষকে।
ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ৭১’সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার মধ্যদিয়ে এ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের। ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রমের জন্য জীবন দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মা-বোনকে। মাত্র নয় মাসে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। নয় মাসব্যাপী গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের অর্ধেকই ছিলেন নারী। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য নারী পাকিস্তানি সেনা ও সহযোগী বাহিনীর সদস্যদের ধর্ষণের শিকার হন। গবেষক সুসান ব্রাউনমিলার অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন-উইমেন অ্যান্ড রেপ বইতে লিখেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আট বছরের শিশু থেকে ৭৫ বছরের বৃদ্ধাকে পর্যন্ত বর্বরভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অব্যাবহিত পূর্বে ঢাকার মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র পরিণত হয়েছিল বুদ্ধিজীবী নির্যাতন কেন্দ্রে। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে সেখানে নির্যাতন করত পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগী আলবদররা, আর পরে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করা হতো। ২৫ র্মাচ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কুক্ষাত রাত। এ রাতের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। সামেহোয়্যার ইন ব্লগের পক্ষ থেকে ভয়াল সেই ২৫ মার্চ রাতের সকল শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৩:২৩