প্রতিদিনই আমরা কিছু না কিছুর অপেক্ষায় থাকি। কৃষক অপেক্ষায় থাকে, কবে তার কষ্টের ফসল ঘরে উঠবে। মাছরাঙাটা মাছের আশায় সারাদিন চুপটি মেরে বসে থাকে। অপারেশন থিয়েটারের সামনে প্রিয়জনরা অপেক্ষা করে একটা ভাল সংবাদের। এভাবে শিশু থাকে খেলনার অপেক্ষায়, শিক্ষার্থীরা ভাল রেজেল্টের, পাশকরা ছেলেটি একটা চাকরির, তরুন-তরুনীরা তাদের মনের মানুষের। বয়স্ক লোকটি অপেক্ষা করে, গল্প করার মানুষটি কখন আসবে?
আমিও অপেক্ষায় থাকি! আবার কবে দেশে ফিরবো, গ্রামের মেঠোপথে হাঁটবো, আপন জনদের দেখবো, সবার বাসায় ঘুরবো, আরো কত কি করবো?
ইদানিং ছুটির দিনে ব্লগেও অপেক্ষায় থাকি। কখন প্রিয় মানুষগুলো আসবে, কিছু লিখবে? সেসব পড়ে ক্যাচাল, প্যাচাল করবো। আর ঢাকা শহরের/দেশের নানা সমস্যা থেকে মুক্ত হবার আশা/অপেক্ষা তো সবারই।।
আচ্ছা? সব অপেক্ষার কি অবসান হয়? হয়তো হয় কিংবা হয় না? তবে আমরা যত অপেক্ষাই করি না কেন? মায়েদের অপেক্ষার কোন তুলনাই হয় না।
আর সন্তানেরাও কেমন জানি!
মাকে বুঝতেও চায় না, মায়ের অপমানও সহ্য করে না। তাই তো আরেক মাকে(দেশ) শকুনির দৃষ্টি থেকে বাঁচাতে শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর মা থাকে খোকার অপেক্ষায় "এই বুঝি তার খোকা বাড়ী ফিরল?"
খোকা তুই কবে আসবি?
মায়েদের এই আকুতি আর শেষ হয় না। তাই মায়েরা প্রতিদিন পথ চেয়ে থাকে, রেল লাইনের ধারে, কিংবা মেঠো পথের পাড়ে। মায়েরা খোকা জন্য উড়কি ধানের মুড়কি, খই কতো কিছুই না করে। আর করবেই বা না কেন? খোকা যে তার বাড়ী ফিরবে!
ক্লান্ত খোকাদের কেউ হয়তো কথার ঝুড়ি নিয়ে, বিষন্ন মুখে বাড়ী আসে। মাকে একটিবার দেখেই সে চলে যাবে। মা খোকার মুখ দেখেই বুঝতে পারে, বাছা তার সারারাত ঘুমায় নি। মাকে দেখার জন্য খালি পায়ে অনেক পথ হেঁটেছে। মা খোকাকে বারান্দায় বসায়। আহারে! বাছা কতদিন পেট ভরে খেতে পারে নি। খোকা জানায় তাদের কেউই পেট ভরে খেতে পারে না। মা বড় আশা করে, আজ নিজ হাতে খোকাকে খাইয়ে দেবে।
কিন্তু মায়ের আশা পুরন হয় না!
পাশের বাড়ীর মিরজাফরটা ক্যাম্পে খবর দেয়। হায়েনার দল খোকাকে বেঁধে নিয়ে যায়। বাক্যহারা মা শুন্য দৃষ্টিতে, ভাতের থালার দিকে চেয়ে থাকে!
সেদিন, দুপুরের আগেই সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। হায়েনারা ছেলেদের দেখা মাত্রই গুলি করে, যুবতীদের ধরে নিয়ে যায়। ওদের হিংস্রতা থেকে দুধের শিশুটিও রেহায় পায় না। খাল পাড়ের সবুজ ঘাসে রক্ত জমাট বাঁধে, পানি হয়ে ওঠে রক্তিম লাল। জীবন বাঁচাতে যে যার মত লুকিয়ে পড়ে। কেউ জঙ্গলে, কেউ কচুরি পানার আড়ালে, আবার কেউ পুরনো কবরস্থানে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। কয়েক টা মাছি থালার উপর ভনভন করে। মায়ের কোন ভাবান্তর হয় না। পাশের বাড়ীর নেড়ি কুকুরটা কে সারাদিন দেখা যায় না। আচ্ছা ওই হায়েনাগুলোর ভয়ে কুকুরটাও কি পালিয়েছে?
সন্ধ্যায় একে একে সবাই বাড়ী ফেরে। কয়েক দিনের মধ্যেই সবাই গ্রাম ছেড়ে যায়। কিন্তু মায়ের যাওয়া হয় না। খোকা এসে যদি ভাত চায়, তখন? রাতে ঘুমও আসে না। মনে হয়, এই বুঝি খোকা এসে ডাকছে?
একদিন দেশ স্বাধীন হয়, সবাই বাড়ী ফেরে। কিন্তু মায়ের অপেক্ষার পালা শেষ হয় না। খোকাকে ধরে নিয়ে যাবার পর থেকে মা আর বিছানায় ঘুমান না, মেঝেতে ঘুমান। খালি পায়ে হাঁটেন, যে মাটিতে তার কলিজার টুকরার রক্ত লেগে আছে, জুতা পায়ে তিনি তা মাড়াবেন কীভাবে? আর ভাত? সেটা কী মায়ে গলা দিয়ে নামবে??
এভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরোয়।
দেশ গরিব থেকে ধনী হয়। সেই উন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে মিরজাফররা দালান গড়ে তুলে। মায়ের কুটিরের কোন পরিবর্তন হয় না। হয়--- ভাঙা কুটির টা আরো ভেঙে পড়ে, পাশের দালানের জন্য সূর্যের আলো পড়ে না।
একদিন কেউ এসে খবর দেয়, স্কুলের মাঠে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। ছেঁড়া কাপড় গায়ে, খালি পায়ে এক জনকে সাথে নিয়ে মা অনুষ্ঠানে আসে। প্রধান অতিথি হিসেবে মিরজাফরটা কে দেখে মা কেঁপে ওঠে। তার মনে প্রশ্ন জাগে, তার খোকা কি এই জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল? শূন্য দৃষ্টিতে মা টেবিলের দিকে চেয়ে থাকে। লাল রঙের ক্রেস্টটি দেখে মনে হয়, ওটা খোকার রক্ত, ওটা তার কলিজার টুকরার-------
পুরস্কার নেয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য, কোনটাই হয় না মায়ের।
ভেবোনা গো মা তোমার ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছে পথে,
ওরা আছে মাগো হাজার মনের বিপ্লবী চেতনাতে।
(সমাপ্ত)
ছবিঃ নেট থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৯:১৯