গ্র্যাফ্টন স্ট্রিট, ডাবলিন।
সময়টা দারুণ। রাত বাজে ২৩.২৩ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে এগারোটা। বাসায় এসেছি একটু আগে। আজ খুব ক্লান্ত। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু ঘুমানোর উপায় নেই। রাইস কুকার মহাশয় ভাত রান্না করছেন, অতঃপর ডিনার হবে, তারপর ঘুম। সেই বিরতীতে কী করা যায়? কিছুক্ষণ চিন্তা করে বসে পড়লাম ডায়েরী লিখতে। অনেক দিন লিখি না। আজ তাই মাঝের দিনগুলোর টুকটাক ব্যবচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করেছি।
গতকাল থেকে শুরু করি। মাস্টার্সের থিসিস জমা দেয়ার পর আমি একটা কলেজে ক্লাস নিতে শুরু করেছি। ডার্ট স্টেশন (ডাবলিনের লাইট ট্রেন) থেকে নেমে সেখানে যেতে গ্র্যাফ্টন স্ট্রিট বলে একটা রাস্তার মধ্য দিয়ে হেটে যেতে হয়। এই রাস্তাটা ডাবলিনের সবচেয়ে বিখ্যাত রাস্তা। এখানে প্রতিদিন প্রায় চব্বিশ ঘন্টা স্ট্রিট শো চলতে থাকে। এমন কি রাত এগারোটা বারোটার সময়ও বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মানুষ বসে বসে কিছু না কিছু বাজাতে থাকে। বিকেলে আমি যখন রাস্তাটা দিয়ে যাই তখন রীতিমত পিক আওয়ার। হরেক রকমের আজব আজব স্ট্রিট শোর মেলা বসে। শো-এর পাশাপাশি আরেকটা বিষয় এই রাস্তায় বেশী দেখা যায়। বিভিন্ন চ্যারিটির জন্য টাকা তোলা। মাঝ রাস্তায় থামিয়ে প্রথমে একটা লেকচার দেয়, তারপর ১২ ইউরো করে প্রতি মাসে এক বছরের কন্ট্রাক্টে সাইন করতে অনুরোধ করে। আমি সব সময় হেসে-রেগে-বিরক্ত হয়ে তাদের পার হয়ে চলে যাই। কালও কয়েকজন এগিয়ে এসেছিল। আমি হেসে এড়িয়ে যাই। রাস্তার শেষ মাথায় যখন যাই, তখন চ্যারিটির একটা মেয়ে খপ করে আমার হাত চেপে ধরে। আমি হেসে সরি বলে যেই সরে যাবো, সে আমার হাত আরো জোরে চেপে আমাকে রাস্তার পাশে নিয়ে যায়। তারপর এক নাটকীয় দৃশ্য। মেয়ে আমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমিও তার চোখের দিকে! কিছুক্ষণ পর সে সিনেমাটিক গলায় বলে উঠলো, “তুমি কী জানো তোমার চোখ অসম্ভব সুন্দর?” মনেমনে ভাবলাম, শেষ বেলায় ফ্লার্ট করে টাকা নিচ্ছ সুন্দরী? মেয়েটা এবার আমি কী করি ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলো এবং দুই মিনিটের মধ্যে তার ১২ ইউরো চেয়ে বসলো। সাথে সাথে আমার মনে পড়লো লাঞ্চন গল্পের কথা - আমি যে “টু ইয়াং টু সে নো”। সুন্দরীর চোখের দিকে তাকিয়ে কন্ট্রাক্ট সাইন করে দিলাম। সে যারপরনাই আনন্দিত হলো। তারপর বলল, কাম অন নিয়াজ। গিভ মি অ্যা হাগ। আমিও হেসে তাকে একটা হাগ দিয়ে চলে এলাম আর মনেমনে ভাবলাম, হায় নারী। তুমি ভালই জানো কী করে পকেট কাটতে হয়!
আরো কিছুদিন আগের ঘটনা। এবার গ্র্যাফ্টন স্ট্রিট থেকে সরাসরি বঙ্গবাজারে। ডাবলিনে একটা রাস্তা আছে যেখানে সব এশিয়ান দোকানের আড্ডা। খোলা বাজারে বাংলাদেশী স্টাইলে সব বিক্রি হয় সেখানে। সিনেমায় যাওয়ার জন্য সেটা একটা শর্টকাট রাস্তা। তাই আমি যখনই মুভি দেখতে যাই, সেই রাস্তা দিয়ে যাই। একদিন সেখান দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি এক মহিলা হাঁটছেন আর তার সামনে তার ছোট্ট মেয়ে হেটে হেটে যাচ্ছে। মেয়েটা একদমই ছোট এবং ঠিক মত হাটতেও পারে না। তার মূল আকর্ষণ একটা পায়রা যেটা ঠিক তার সামনে হেটে হেটে যাচ্ছে। মেয়েটা সেই পায়রাটাকে ধরার চেষ্টা করছে আর দুষ্ট পায়রাটা উড়ে না গিয়ে একটু একটু করে হেটে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে দৃশ্যটা অদ্ভুত ভালো লাগছিল। তাই হাটার গতি কমিয়ে মা-মেয়ের পেছনে হটতে লাগলাম। পেছন থেকে মা ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে আর ছোট্ট মেয়ের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আছে পায়রার পেছনে। একসময় মা কপট অভিমান দেখিয়ে বলল, “তোমাকে আজ মা এবং পায়রার মধ্যে যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে।” মেয়ের সেসব ঢং-এর কথা শোনার সময় কই? সে যে আছে পায়রার পেছনে। কিন্তু হঠাৎ পায়রাটা উড়ে ঠিক মেয়েটার মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। এতে মেয়েটা এত ভয় পায় যে কান্না করে দৌড়ে মায়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকে, আর মা তাকে অভয় দিতে থাকে। আমি ততক্ষণে তাদের ছাড়িয়ে গিয়েছি। তবু মাথা ঘুরিয়ে পেছনে অপলক তাকিয়ে দেখছিলাম সেই মা এবং সন্তানের ভালোবাসা। একটা সত্য, যা সব সময় ভুলে যাই, সেদিন আবার মনে পড়ল - জীবনে মা হচ্ছে সবচেয়ে বড় এবং শেষ আশ্রয়। সেদিন আম্মুকে খুব মিস করছিলাম। কবে যে দেশে যাবো, কবে যে আম্মুকে দেখবো।
(আমার ভাত সম্ভবত হয়ে গিয়েছে। অতএব এখন থামছি। ডিনার করে এসে আবার লিখতে বসবো।)
আহ! দারুণ একটা ডিনার করে আসলাম। এখন আবার নূতন উদ্যমে লিখতে শুরু করছি। আজকের লেখাটা অন্যরকম হচ্ছে। ডায়েরী বলতে ঠিক যেমনটা বোঝায় তেমন না। অনেকটা পাগলা ঘোড়ার মত। যা খুশি লেখার লিখছি।
এবার আরেকটা গল্প শোনাই। একটু আজব। এখানে বলাটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, যাইহোক। যখন ঠিক করেছি লিখবো, লিখেই ফেলি। আমি যেখানে থাকি সেই এলাকাটা বেশ ভালো। প্রতিবেশীদের দেখলে ভদ্রলোকই মনে হয়। রাস্তাগুলোও পরিষ্কার। আর এই পরিষ্কার রাস্তার কারণেই এই ঘটনার অবতারণা। আমার বাসা থেকে গড়ে সাত মিনিট লাগে হেটে ডার্ট স্টেশনে যেতে। গত ডিসেম্বরের আগের ঘটনা। সকাল নয়টায় আমি ক্লাস নিতাম। ফলে আটটার মধ্যে আমাকে বাসা থেকে বের হতে হতো। প্রতিদিন একটা বিশেষ বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একটা বিষয় আমার নজরে ব্যাপক ভাবে পড়তে শুরু করে। বাসার ঠিক সামনে পরিচ্ছন্ন রাস্তার উপর একটা ব্যবহৃত কনডম! দৃশ্যটা চরম দৃষ্টিকটু এবং দৃষ্টি-আকর্ষণীয়। একটা হিসেব আমি কিছুতেই মেলাতে পারছিরাম না। এটা এখানে আসলো কী করে? এই বস্তু কোন ভাবেই বাসার ভেতর থেকে এখানে আসার কথা নয় কেননা বাসার সামনে গ্যারেজ আছে যেখানে দুটো গাড়ি একটার পেছনে একটা থাকে। এর থেকেই গ্যারেজটার দৈর্ঘ্য অনুমান করা যায়। কাউকে যদি বাসার ভেতর থেকে এটাকে রাস্তায় ফেলতে হয় তাহলে তাকে লং জাম্পের মত লং থ্রোইং বিশেষজ্ঞ হতে হবে। প্রথম যেদিন দেখি সেদিন হেসে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরদিন আবার একই দৃশ্য দেখে অবাক না হয়ে পারিনি এবং পরের সপ্তাহে আবার দুই দিন। উল্লেখ্য যে আমি সপ্তাহে দুই দিন শুক্রবার এবং শনিবার সকালে ক্লাস নিতাম। এ থেকে একটা বিষয় অনুমান করা যাচ্ছিল যে এই ঘটনা সপ্তাহে দুইদিন নয় বরং প্রায় নিয়মিতই হয়তো হয়। বিষয়টা আমাকে এতটাই ভাবিয়ে তুললো যে আমি রাতে যখন বাসায় ফিরতাম তখন অনধিকার চর্চা করে গাড়িগুলোকে দেখা শুরু করলাম। এভাবে দিনে এবং রাতে গবেষণা করে যে বিষয়টা বুঝলাম তা হলো সেখানে দুটো গাড়ি থাকে। সামনের গাড়িটা দামী এবং বাসার ভদ্রলোক চালান। পেছনেরটা বেশ পুরোনো একটা গাড়ি যেটা একটা খুব অল্প বয়সী ছেলে (সম্ভবত তার ছেলে) চালায় যাকে আমি বেশ কয়েকদিন রাতে এবং সন্ধ্যায় বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে আড্ডা দিতে দেখি। এভাবে চলতে চলতে এক সময় আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি (যদিও তখনও আমি মাঝে মাঝে কনডম পড়ে থাকতে দেখতে পেতাম)। তারপর হঠাৎ একদিনের ঘটনা। ক্লাস নিয়ে অন্যদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল সেদিন। রাত এগারোটা বিশের ডার্ট ধরে বাসায় আসতে আসতে পৌনে বারোটা। হেটে আসছি সেই বাসার সামনে দিয়ে। দুটো গাড়িই রাখা ছিল তখন। হঠাৎ শুনি পেছনের গাড়ি থেকে (কম বয়সী ছেলেটার গাড়ি) শব্দ আসছে। পুরুষ এবং নারীর আদিম শব্দচারিতা! সাথে সাথেই সমাধান হয়ে গেলো এই রহস্যের। কয়েকদিন আগেও হঠাৎ দেখতে পেলাম পড়ে আছে রাস্তায়। এবার কেবল হাসলাম। বেচারা!
ডাবলিন জীবনটা অনেক কিছু দেখিয়েছে আমাকে। অনেক কিছু শিখিয়েছেও। সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা হলো - জীবন নদীর মত। বহমান। চলতে থাকে, চলতেই থাকে। জীবনকে কখনও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, বরং জীবনই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে। কখনও চ্যারিটির সেই মেয়ের মত আজব কিছুকে আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়, কখনও পায়রার পেছনে ছোটা ছোট্ট মেয়েটার মায়ের কোলে শেষ আশ্রয়ের শিক্ষা দেয় অথবা কখনও গাড়ির ভেতরে লুক্কায়িত যুগলের মত নিষিদ্ধ আপেল খাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। জীবনটা সত্যি বড় আজব। তবে আজব বলেই এত ভালো লাগে, না হলে সেই কবে একঘেয়ে হয়ে যেতো!
১৭ ফেব্রুয়ারি (যদিও ১২টা পেরিয়ে এখন ১৮ ফেব্রুয়ারি)
ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।