ক্ষমতাসীন দলের প্রতিশ্রুতি যাতে শুধু প্রতিশ্রুতিই থেকে যায় সে আশা করছি শুরুতেই।
রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারনীর মাত্রায় বাংলাদেশকে লিবারেল ডেমোক্রেসির দেশ হিসেবে ধরে নেয়া যায়। ডেমোক্রেসির অপর প্রচলিত পিঠ হচ্ছে সোশ্যাল ডেমোক্রেসি। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হচ্ছে সুইডেনের এস.এ.পি., নরওয়ের ডি.এন.এ., জার্মানীর এস.পি.ডি., বৃটেনের লেবার পার্টি-এরা। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের রাষ্ট্র চালনার মূলমন্ত্র হচ্ছে শ্রমজীবি তোষন। বেকার সমস্যাকে এরা ম্যাক্রো-ইকোনমিতে স্থান দিয়েছে আর দ্রব্যমূল্যকে মাইক্রো-ইকোনমিতে। অপর পক্ষে লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা দ্রব্যমূল্যকে ম্যাক্রো-ইকোনমিতে স্থান দেয় এবং এরা বিশ্বাস করে যে, বেকার সমস্যার সমাধান নিহিত আছে মাইক্রো-ইকোনমিতে; যেখানে চাহিদা এবং যোগানের দরকষাকষিতে শ্রম বাজার নিয়ন্ত্রিত হবে। সোজা কথায়, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা চায়, মানুষ চিকিৎসা পাবে প্রয়োজন অনুযায়ী, সামর্থ্যের বিচারে নয়; শিক্ষা পাবে মেধা অনুযায়ী, টাকার জোরে নয়; আর চাকুরিতে প্রবেশ শ্রমিকের চাহিদা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে।
১ম বিশ্বযুদ্ধের পর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা বেশ সমাদর পেতে শুরু করে। সবাইকে চাকুরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার প্রতিষ্ঠা তাদের পক্ষে গণজোয়ারের সৃষ্টি করে। কিন্তু ভরাডুবি শুরু হয় কয়েক দিনেই। সবাইকে তুষ্ট রাখতে গিয়ে জার্মানীতে দেখা দেয় হাইপার ইনফ্লেশ্যন। ১৯১৪ সালে যেখানে ডলারের সাথে জার্মান মার্কের বিনিময় হার ছিল ১:৪, ১৯২৩ সালে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ১:১ট্রিলিয়ন!! মানুষ লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার টোপ গিলতে বাধ্য হয়। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ব্যর্থতার মূল ভিত্তি হচ্ছে তাদের আদর্শ। সবাইকে শ্রম বাজারে সুযোগ দিতে গেলে দেখা যায় উৎপাদন সীমাবদ্ধতার কারনে মাথাপিছু উৎপাদন হার কমে যায়। এতে মোট লাভের উপর প্রভাব ফেলতে না চাইলে বাধ্য হয়ে শ্রমিকের মজুরি কমাতে হয়। এমন উদ্যোগ সফল হতে পারে নি শ্রমিক ইউনিয়নের চাপের মুখে। বিকল্প পথ যা থাকে, শ্রমিকের মজুরি না কমিয়ে Real Income কমানো। যার মানে হচ্ছে, ইন্জিনিয়ারিং-এর মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়া- যাতে করে শ্রমিকের মজুরি না কমিয়েও মুনাফা বাড়ানো যায়। শিল্প মালিক এবং শ্রমিকদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে বাইরে থেকে ক্রমাগত অর্থের যোগান না থাকলে বাজার দূর্বল হয়ে যায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যায়।
অন্যদিকে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক আদর্শ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বন্ধু ভাবাপন্ন। এরা দ্রব্যমূল্যকে এমন পর্যায়ে রাখে, যাতে জনগণ নিজেদের অতি দরিদ্র মনে না করে এবং তাদের মধ্যে এমন একটা ধারনার সৃষ্টি করা যে, বাহ্যিক কিছু ভোগ-সম্ভোগ কমালে সহজেই সঞ্চয় করা যাবে। অপর পক্ষে, শ্রমিকের প্রবেশ বাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় শিল্প মালিকেরা বড় অঙ্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এনে দেয়। শ্রমিক অসন্তোষকে নিয়ন্ত্রন করতে দ্রব্যমূল্য বিশাল ভূমিকা পালন করে।
যে জন্য দেখা গেছে ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি সময় রাজত্ব করেছে লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা। গত কয়েক দশক ধরে মাত্র সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সাথে তাদের ক্ষমতা পাল্টা-পাল্টি করতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে একটা স্থিতিশীল পর্যায় পর্যন্ত আনতে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের উপর আস্থা রাখতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। পরবর্তীতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের আদর্শ বাস্তবায়িত হয়েছে লিবারেলদের উপর ভিত্তি করে। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসীর পালে এখনও পুরোপুরি হাওয়া লাগেনি, কারন নিরবিছ্ছিন্নভাবে লিবারেলদের মত তারা এখনও আলোয় আসে নি।
আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে চিন্তা করতে গেলে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসীর জন্য সময় এদেশে এখনও আসে নি। ৩য় বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা এখনও বৃটিশ আমলের অক্ষীয় অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে পারি নি। আমাদের বানিজ্য পন্য এখনও প্রাথমিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। যে জন্য দরিদ্র দেশগুলোর সাথে আমাদেরকে অবস্থান ও নিম্নমূল্য নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হয়। যে দেশে শ্রমিক মজুরি সবচেয়ে কম, গার্মেন্টস শিল্প সেই দেশে চলে যায়।এ অবস্থা থকে উত্তরনের জন্য প্রয়োজন লিবারেল ডেমোক্র্যাসীর সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাজার- গার্মেন্টস কিংবা ইদানীং জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকে যা আয় হচ্ছে তা আরও বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজন উৎপাদন বান্ধব শ্রম বাজার প্রতিষ্ঠা করা, পরবর্তীতে যাতে মাধ্যমিক এবং ক্রমান্বয়ে পুজি পন্যের বাজারে বিনিয়োগ করা যায়। আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, শ্রমিক শ্রেণীকে শোষন করা হচ্ছে, কম মজুরি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সঞ্চিত অর্থ নতুন খাতে বিনিয়োগ করে আসলে শ্রম বাজারের পরিধি ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধির দ্বারা নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, "প্রতিটি পরিবারের একজনের জন্য চাকুরী : বাংলাদেশের জন্য আত্নঘাতী"। এখনও আমাদের অর্থের ঝুলি শূন্য। বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ ব্যয় হয় ঋণ শোধ করতে। ঋণ নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে নিজেদের অক্ষীয় অবস্থানের পরিবর্তন করতে হলে ব্যবসাবান্ধব নীতি প্রণয়ন ছাড়া আমাদের ২য় কোন বিকল্প নেই। গার্মেন্টস কিংবা জাহাজ নির্মাণ শিল্প থেকে যে অর্থ আসছে তা এখনই ভোগ করা আমাদের উচিত হবে না। চাকুরির নিশ্চয়তা দিতে গেলে কৃত্রিমভাবে বেড়ে যাবে দ্রব্যমূল্য-যা সামাল দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নিশ্চিত অর্থ সরবরাহ আমাদের নেই। পুজিপন্যের উৎপাদন বাড়াতে হলে প্রয়োজন নির্দিষ্ট একটি বিশাল বাজার- বৃটিশরা যেটা করেছিল তাদের Colony বাড়িয়ে। আমাদের আগে দরকার বাজার প্রসারনের দিকে মনোযোগী হওয়া। চাকুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা হচ্ছে সময়ের সন্তান যদি ব্যবসা এগিয়ে যায়। উন্নতির জন্য কারা অমানুষিক পরিশ্রম করে নি?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০০৯ সন্ধ্যা ৭:২৩