‘ইচ্ছে’ নামে কলকাতার একটি বাংলা সিনেমা আছে। একটা পরিবারের গল্প। মায়ের প্রত্যাশার চাপ নিতে না পেরে ভেতরে ভেতরে বদলে যেতে থাকে ছেলে। কিন্তু মা বদলান না। কারণ তার একটাই চাওয়া, সন্তানকে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে হবে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সন্তানের ভাল থাকা যে তার হাতেই। বাবা-মা যে সন্তানের ভাল চান সে বিষয়ে কোন বিতর্ক নেই। তবে সেই ভাল চাওয়াটা সন্তানের ভাল করছে কিনা সেই বিতর্কের দোকান চলতেই পারে।
সন্তানের জন্ম মা-বাবার জীবনের সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি। মায়ের গর্ভে আর বাবার মনে একটু একটু বেড়ে ওঠা সন্তানকে ঘিরে যেকোন দম্পতি তাদের সেরাটা দিতে চান। কোনো কমতি রাখার প্রশ্ন-ই ওঠে না সেখানে। বাচ্চার স্কুলে যাওয়া, ভালো ফলাফল করা বাবা-মা’র খুশির উপলক্ষ্য হয়ে আসে । পিএসসি, জেএসসি পেরিয়ে যখন একজন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় স্বাভাবিক ভাবেই তার বয়স তখন ১৬/১৭। চঞ্চল-ঝলমলে কৈশোর তাদের প্রাণে। অথচ এই বয়সেই ঝরে যায় কিছু সম্ভাবনাময় জীবন। আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তারা। প্রতি বছরই বোর্ড পরীক্ষাগুলোর ফলাফল প্রকাশের পরে গণমাধ্যমের বরাতে বেশ কিছু আত্মহত্যার সংবাদ পাওয়া যায়। কেন? এই কেন’র উত্তর খোঁজার আগে এই বছরে কিছু খবর; প্রত্যাশা অনুযায়ী জিপিএ-৫ না পাওয়ায় ফলাফল প্রকাশের পর আতিকুর রহমান ইমন ট্রেনের নিচে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। জিপিএ-৫ না পাওয়ায় ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে দড়ি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছে দীপ। অকৃতকার্য হওয়ায় জামালপুরের ইসলামপুরে ট্রেনের নিচে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে শারমিনা নামের এক শিক্ষার্থী। এ সময় তাকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে অন্তঃসত্ত্বা খালাও। বিষপানে আত্মহত্যা করেছে মোঃ সামিম এবং জেসি আক্তার। ঘরের আঁড়ার সাথে ফাঁস দিয়েছে তাহমিনা আক্তার।
প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া বা আশার অনুরূপ ফলাফল না করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা; তারপরও সেই অপ্রাপ্তি আত্মহত্যায় রূপ নিচ্ছে কেন? যদিও আত্মহত্যা ব্যক্তিগত ব্যাপার, তবুও একে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে বিবেচনা করা যায় না। যে ছেলে বা মেয়েটার বয়স ১৬/১৭ বছর সে কেন আত্মহত্যার মতো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছে, সেটা নিয়ে আরো গভীর ভাবনার দরকার আছে বৈকি। মানুষ যেসব কারনে আত্মহত্যা করে তার মধ্যে পরিবার এবং অভিভাবকদের কথা অনেকের আলোচনাতেই তালিকার উপরের দিকে উঠে এসেছে। অভিভাবক এবং সন্তানদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন অনেকটাই শিথীল। সন্তানরা অনুভব করতে পারছেন না বাবা-মা তাদেরকে ভালোবাসেন। জীবনের সবথেকে খারাপ সময়ে অভিভাবকদেরকে পাশে না পেয়ে, অভিভাবকদের অসহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের কারণেই সন্তানরা এই ধরনের হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।
রাষ্ট্রের এডুকেশন সেক্টরের সাফল্যের তালিকায় পাশের হার বাড়ে, বাড়ে তথাকথিত গোল্ডেন (এ+)এর সংখ্যা আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে অভিভাবকদের প্রত্যাশা। এখন ক’জন বাচ্চাকে শেখানো হয় যে তাকে ভালো মানুষ হতে হবে? বরং সবাই জানে তাকে GPA-5 পেতে হবে। তাই যেকোন মূল্যে সেই ফলাফলকে বগলদাবা করতে তারা মরিয়া! ‘স্কুল-কোচিং-টিউশন’ ছুটছে তো ছুটছে। কারণ “সে জিতলে জিতে যায় মা”। মায়েরা এই জয়ের নেশায় সারাক্ষন বাচ্চাদের ভালো থেকে আরও ভালোর দিকে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছেন। জ্ঞান তো আর পন্য নয় যে, ভাল স্কুল কোচিং সেন্টার আর স্বনামধন্য শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে সেটা কিনে আনা যাবে। তবুও চেষ্টার কোনো কমতি রাখা যাবে না! প্রচারমুখি অভিভাবকরা আগে থেকেই জানেন কিংবা এমন ভাবে বলে বেড়ান যে তাদের বাচ্চা এ+ কিংবা গোল্ডেন এ+ পাবেই। যেন পরীক্ষায় অংশ নেয়া একটা নাম মাত্র অনুষ্ঠানিকতা!
অভিভাবকরা বাচ্চাদের আবদার পূরণ করেন আর বলে দেন “যখন যা চাচ্ছো দিচ্ছি, লেখাপড়ায় ভালো রেজাল্ট করা চাই”। বাচ্চা পারবে কিনা, তার সামর্থ্য কতটুকু; তা বিবেচনা না করে নিজেদের প্রত্যাশা জানিয়ে দেন তারা। কিংবা তুলনা করেন অমুকের ছেলে, তমুকের মেয়ে ভাল রেজাল্ট করেছে তোমাকেও করতে হবে। তোমার পেছনে তো কম খরচ করছি না। আচ্ছা, বেশি খরচ মানে কি বেশি ইনভেস্টমেন্ট, যে লাভের অংকটাও বেশি হবে! সবাই সমান মেধাবি হন না, কিংবা সবাই সমান পরিশ্রমিও নন। সেক্ষেত্রে সবাই একই মানের ফলাফল করবে সেটা আশা করাটা অযৌক্তিক। বর্তমানে ভালো মানের স্কুল-কোচিং আর প্রাইভেট টিউটর শিক্ষার্থীদেরকে পাঠানো হয় কাক্ষিত ফলাফলের প্রত্যাশায়। স্কুলগুলো কি কেবল পাঠ্যপুস্তক মুখস্ত করিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে? মানবিক কোন শিক্ষা কি সেখানে গুরুত্ব পায়?
প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব আমাদেরকে ভালো থাকতে দেয় না । কেননা প্রতিযোগিতার কোন শেষ কিংবা সীমা নেই। তথাকথিত দায়িত্বশীল বাবা-মায়ের মনোভাবের কারণে ৫/৬ বছরের বাচ্চারাও জানে, ক্লাসে প্রথম হতেই হবে। পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়াকে তারা বলে লাড্ডুগুড্ডু! অভিভাবকদের লাগামহীন প্রত্যাশার চাপে প্রতিনিয়ত চিড়ে চ্যাপ্টা তারা। হবে না কেন বলুন; সন্তানের সাফল্য যখন সামাজিক স্বীকৃতির অলংকার, তখন সে চাপ তো লাগামহীন হবেই! অথচ আয়োজন করে যাদেরকে নিয়ে এই উচ্চাকাংক্ষা করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই কৈশোরটুকু পেরিয়েছে এই সেদিন। নিজের পরিবারের চোখে ব্যর্থ হবার মতো লজ্জ্বা আর কিছুতে নেই। আকাংক্ষা সাফল্য আনলেও উচ্চাকাংক্ষা বয়ে নিয়ে এসেছে অস্থিরতা আর হতাশা। হতাশাই হচ্ছে আত্মহত্যার সবথেকে বড় কারণ। অনেক পরিবারেই বাচ্চা কাংক্ষিত ফলাফল না করতে পারলে তাকে মানসিক ভাবে কষ্ট দেয়া হয়, কোনো কোনো পরিবারে গায়ে হাত পর্যন্ত তোলা হয়। যেটা বাচ্চাদের আত্মসম্মান বোধে আঘাত হানে। সে মেনে নিতে পারে না। কোথাও কোথাও অভিভাবকদের উদাসীনতা এবং পারিবারিক মানবিক শিক্ষার অভাব আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জেকবজিনার-এর মতে আত্মহত্যা হচ্ছে হতাশা, বিষণ্ণতা, ক্রোধ বা প্রতিহিংসামূলক কর্মকান্ড; যা হটকারিতামূলক প্রতিক্রিয়ার ফল। অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চারা নিজেদেরকে অত্যন্ত উপেক্ষিত, অবহেলিত, প্রত্যাখ্যাত ও ব্যথিত বলে মনে করে। আত্মহত্যা, ক্ষেত্রবিশেষ আকস্মিক বিপত্তিমূলক সামাজিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসেবেও ঘটে থাকে।
সামাজিক চাপ সামলাতে অসমর্থ হলে কিংবা প্রচলিত অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হলেও ব্যক্তি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। যেসব কারণ আত্মহত্যায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে তার মধ্যে আবেগ প্রবনতা, অন্যের উপর প্রতিশোধ নেয়ার প্রবনতা, নিজের প্রতি আক্রমনাত্মক মনোভাব, সামাজিক চাপ, আবেগ শূন্যতা, ক্ষতিপূরন দেয়ার মানসিকতা, আত্মমর্যাদা হানি, সামাজিকভাবে ভাবমূর্তি বিনষ্ট, ভাগ্যকে দোষারোপ, বিষণ্ণতা, অনিয়ন্ত্রিত রাগ, নিকটজনকে শিক্ষা দেয়ার জন্য, বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট, হঠাৎ কোন ক্ষতি, সাম্প্রতিক ন্যাক্কারজনক ঘটনা, প্রতিকূল পরিবেশ প্রভৃতি মানুষের আত্মহত্যার প্রবণতাকে প্রভাবিত করে।
গণমাধ্যম এখন সব ঘরে, সমাজের সব শ্রেনিতে নিজের অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ় করে নিয়েছে।যা দেখে, শোনে– তা থেকেই শেখে। গণমাধ্যমের প্রচারণা মানুষের জীবনে গভীর রেখাপাত ফেলে। পরীক্ষায় ব্যর্থতার কারণ তুলে ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেসব তথ্য দেয়া হয় তার মধ্যে থাকে, কে আত্মহত্যা করেছেন, কোথায় করেছে্ন, কখন করেছেন, কিভাবে করেছে্ন মানে কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে করেছেন তার স্ববিস্তার বর্নণা। ক্ষেত্র বিশেষে “সুইসাইড নোট”ও ছেপে দেয়া হয়। তুলে ধরা হয় অভিভাবক ও প্রিয়জনদের আহাজারী, সন্তান হারানোর শোক, পরিচিতদের সমবেদনা। ‘যেটা’ তুলে ধরা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শই থাকে উহ্য। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ যদি পৌঁছে দেয়া যায়, যাতে আর কোন বাচ্চা যেন এই ভুল পথে পা না বাড়ায়। মানুষ দ্যা কমনওয়েলথ ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ এন্ড এজেন্সিস’র এক গবেষণায় দেখা গেছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার সংবাদ বা আত্মহত্যা চেষ্টার সংবাদে দীর্ঘদিনব্যাপী আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে হতাশা বা বিষণ্নতার কারণ মিলে গেলে, সংবেদনশীল মানুষদের মনে সেই সংবাদ গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ফলে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের সংবাদ সম্ভবত কিছু মানুষকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে আগ্রহী করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে এদেশের ১৫-২৯ বছর বয়সের মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারন ‘আত্মহত্যা’। হতাশা এবং হঠকারিতাকেই এর কারন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পরীক্ষার ফলাফলকে বাচ্চাদের জীবনের সাফল্যের মাপকাঠি এবং একমাত্র পরিচয় হিসেবে দাড় করিয়ে দেওয়ার সুদূরপ্রসারী সংস্কৃতি ভাবিয়ে তোলার মতো। মানুষ বয়সকে ধারন করে আর সময়কে যাপন করে। অনেকেই আছেন যারা বর্তমান প্রজন্মকে অমনোযোগি বলে নির্দ্বিধায় দোষারোপ করেন, তারা কী ভেবে দেখেছেন "এই প্রজন্মকে কতটা অস্থির সময় পার করতে হচ্ছে?" মানসিক বয়:সন্ধিকালীন সময়ে এসে তারা দেখছে পাশে আস্থা রাখার মতো মানুষ নেই। প্রযুক্তির হাতছানিতে কেবলই পিছিয়ে পড়ার আশংকা। ভীষণ অপ্রিয় সব বিষয়াদি চারপাশে আলোচিত। আপরাধ, অপ্রাপ্তি আর অপবাদ এই তিন নিয়েই তাদের সকাল-দুপুর-রাত। লাগামহীন প্রত্যাশার ভারে নুয়ে পড়েছে; অথচ তারা তাদের কৈশোরটুকুও পেরোচ্ছো মাত্র!
স্বপ্ন আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এক করে ফেলবেন না। অভিভাবকদের অনেকেই জানেন না যে, সফলতা আর সার্থকতা এক জিনিস নয়। যারা প্রত্যাশার অতলে তলিয়ে গেছেন, তারা জানেন অতল বড় অন্ধকার। ব্যর্থতার মধ্যে লজ্জ্বা নেই, লজ্জ্বা তো চেষ্টা না করে হার শিকার করার মধ্যে। বাচ্চাদেরকে উৎসাহ দিতে শুরু করুন। তাদেরকে বুঝুন, বোঝান এবং ভালোবাসুন। সন্তানরা যদি এই বোধ নিয়ে বড় হয় যে, বাবা-মায়েরা তাদের প্রতি কেবল দায়িত্ব পালন করছেন কিংবা তাদেরকে কর্তব্যবোধের জায়গা থেকেই দেখছে্ন; সেটা কোন আশার আলো দেখায় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন মানুষকে সার্টিফিকেট বা সনদ দিতে পারে, ভাল মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা পারিবারিক অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকেই দিতে হবে। সন্তান ভুল করলে শুধরে না দিয়ে নিপীড়নমূলক শাস্তি দেয়াটা যে কতোটা অযৌক্তিক ও অমানবিক, সেটা নিজেরাই বিবেচনা করুন। প্রলোভনকে জয় করতে হবে। বাচ্চা'দের দিয়ে তুলনা করার মানসিকতা থেকে নিজেদের দূরে রাখুন। সামাজিক সুনাম, আত্মীয়দের কাছে প্রশংসনীয় হয়ে ওঠার জন্য বাচ্চা'দের উপর প্রত্যাশা চাপিয়ে দিবেন না। সন্তানদের মেনে নিতে শেখান, মানিয়ে নিতে শেখান। জীবনের অনেকগুলো জানালা। সবগুলো খুলে সন্তানকে উদার হতে শেখান। জীবনটা বিশাল, একবছরের পাশ ফেল, পরীক্ষার রেজাল্ট সেখানে একটা ঘটনা মাত্র, পুরো জীবন কখনোই নয়।
কালীপ্রসন্ন ঘোষের লেখা ছড়া শুনিয়ে সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন “একবার না পারিলে দেখো শতবার”। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাচ্চাদেরকে শেখাতে হবে, সব থেকে সুন্দর এই জীবন! সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:২৫