“মনে আছে সেই নীল খামে চিঠি ‘তোমার ঘন কালো চুলে হারিয়ে যায় মন’। উহু ‘আমার মন এখনো হারায়’”- জুঁই তেলের বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল এটা। বিটিভি’র একটা যুগ ছিলো। সেই যুগে এই বিজ্ঞাপন ছিলো জনপ্রিয়তার তালিকায় শীর্ষে। এই বিজ্ঞাপন দেখে সুখ-স্বপ্নে যে মেয়ে বিভোর হয়নি তাকে দেখার বড় স্বাদ জাগে!
জীবনানন্দের বনলতা’র চুল ছিলো ‘কবে কার অন্ধকার’। হালের কবিরা চুলের বন্দনা করার আগেই পার্লারে গিয়ে মেয়েরা লেয়ার কাট দিয়ে আসে। চুল বাঁধার টিউটোরিয়ালে ঘন চুল কি করে বাঁধবেন সেটা দেখানো হয় না যে! বাঙ্গালী প্রেমিক তার অনাগত প্রেমিকার মুখ যখনই ভাবে অবধারিত ভাবে সেখানে একরাশ ঘন কালো চুলের উপস্থিতি অনিবার্য থাকে। তাই তো চুলের গোড়া মজবুত হলে রোমান্সও জড়ায় মজবুত বাঁধনে। সূর্য ডাকে আমার রোদে চুল শুকাতে আসো না। জুঁই নারকেল তেল রোমান্সের শুরু এখানেই (বাবলি’র জন্য)। রোদে চুল শুকাতে ছাদে কিংবা বারান্দায় দাড়ালে মাঝে মধ্যে দেখা হয়ে যেত প্রেমিক যুগলের।
সাজানো ঘরের গোছানো সুখি দম্পতি। বৃষ্টি পড়ছে বলে স্ত্রী চান স্বামী আজ বাসায় থাকুক। দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর অনুরোধ উপরোধ উপেক্ষিত কেননা স্বামীর আজ অফিসে অনেক কাজ। তারপর একরাশ মেঘের মতো কালো সিল্কি চুল স্বামী বেচারাকে বেঁধে ফেলে ফাঁদে। মন তো বাঁধা পড়বেই, চুল যদি হয় এমন প্রেমের ফাঁদ!(বেঁধে রাখুন চুলের ফাঁদে, জুঁই নারকেল তেলের বিজ্ঞাপন)। আমি ভেবেই রেখেছি অনুরোধ ছাড়াই আমার উনি বৃষ্টি দিনের কদর বুঝে অফিস কামাই করবে!
দিনে দিনে দাম্পত্য পরিনত হলে, হিসেবের খাতা বড় হলে স্ত্রীর বেঁধে দেয়া টাই এর সময় টুকুকে কাজে লাগেতে স্বামী সেলফোনের ক্যালকুলেটরে প্রয়োজনীয় হিসেব সেরে নেন। মিথিলা তাহসানের কাজ থেকে শিখলাম। তখন কী করতে হয় সে দাওয়ায় তো সেখানে আছে। আমি তো এখন পুরনো হয়ে গেছি! কি দেখো? তোমার চুল। চুল ধরতে হবে না তুমি তোমার হিসাব নিয়েই থাকো (জুঁই নারকেল তেল)।
তারপর আমি থেমে গেছি, আমি হতভম্ব হয়েছি, এবং আমি কেঁদেছি। না কোনো বেদনাবোধ থেকে নয়, আমার সামনে তখন সেই ৭২ ভাগ নারী যারা কখনো নির্যাতনের কথা মুখে বলেন না। আচ্ছা কেন মেয়েদের লুকাতে হয়? চেপে রাখতে হয়? কোন লজ্জ্বায়, কার ভয়ে।
কত বিজ্ঞাপনের পোষ্ট মার্টেম রিপোর্টে লিখে দিয়েছি ‘মানহীন বিজ্ঞাপন’। কটাক্ষ করেছি। পরামর্শ দিয়েছি। আজ অনেক দিন বাদে একটা বিজ্ঞাপন দেখে স্যালুট নির্মাতাকে। কত সহজ ভাবে, ভনিতা ছাড়া, সরল করে সত্যিটা বলে দিয়েছেন। নির্মাতা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা গল্প বলেছেন। গল্পে একজন বৌ সেজে বেরিয়ে যাচ্ছে হাসি মুখে, চোখে অচেনা জীবনের সুখ স্বপ্ন। সিরিয়াল আসে গল্পের মূল চরিত্রের। এই চরিত্রের কোন নাম নেই, যৌন আবেদন নেই, আকুতি নেই, আকাংক্ষা নেই। শুধু একটা প্রয়োজন আছে। সে তার চুল গুলো ছোট করতে চায়। যিনি চুলে কাটেন দারুন আন্তরিক মানুষ। একটু একটু করে কাটছিলেন নিজ দায়িত্বে। মেয়েটা বার বার খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে বলছে আরো আছো। শেষমেশ পার্লারের হেয়ার আর্টিষ্ট ‘ব্ল্যাংক’কাট দিয়ে ব্যাক মিরোরটা ধরলেন। বলছিলেন ম্যাডাম বোধহয় চুলের যত্ন নেয়ার সময় পাননা, তাই না?। এবার কোজ শর্ট। ‘আরো ছোট করে দিন, যাতে এভাবে আর ধরা না যায়’ কেঁদে ফেললো মেয়েটি।
কেন কেঁদেছে মেয়েটি? অপমানে, লজ্জ্বায়, বেদনায়? না ঘৃণায়? নারী নির্যাতন সারা বিশ্বে খুব কমন একটা বিষয়। একজন অথর্ব পুরুষও নিজের স্ত্রীকে অধস্তন মনে করেন। বৌ না পেটালে তাদের মধ্যে ঠিক পুরুষ মানুষ ফিলিংটা আসে না কিনা!
মেয়েটা পার্লারে না গিয়েও নিজের চুল নিজেই কেটে ফেলতে পারতো। সব চুল ফেলে দিতে পারতো। তারপরও সে পার্লারে গিয়েছে। নিজেকে আর অসম্মানিত করতে সে চাইনি। চাইনি অন্যের সহানুভূতি পেতে, অযাচিত প্রশ্নের সম্মুখিন হতে। হতো দিন শেষে তাকে তার অভিনীত চরিত্রের কাছে ফিরতে হয় বলে, সে অন্যদের সামনে খোলসটা খুলে ফেলতে চাইনি। সে তার স্বত্তাধিকারীকে উপহাসের পাত্র করেনি। পাছে লোকের কাছে সমালোচিত করেনি। ঝগড়া করেনি, অভিযোগ করেনি, মিনতি করেনি, উপেক্ষা করে প্রস্থান করেনি। সে করুণা করেছে। সে তার শারিরীক বেদনাবোধকে একটু কমাতে চেয়েছি। সমাজের মুখে এর থেকে ‘বড় থাপ্পর’ আর কিছু হতে পারে না।
হেনরিক গিবসন এর বিখ্যাত নাটক ‘ডলস হাউজ’ এর কেন্দ্রিয় চরিত্র নোরা। যিনি স্বামী-সন্তান-সংসারের জন্য সর্বোচ্চটুকু করার পরও উপহাস আর তিরস্কার পায় স্বামীর কাছ থেকে। শেষে পায় নিষেধের বেড়াজাল না ডিঙ্গানো পরামর্শ। তাকে দেখানো হয় সমাজের ভয়। মনে করিয়ে দেয়া হয় মা হিসেবে তার দায়িত্ব। অথচ ততক্ষনে নোরা জেনে গেছে ‘প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়, অধিকার নয়, নারী শুধু প্রয়োজনের”। নোরা অপেক্ষা করে ভোরের আলো ফোটার, যে সূর্যকে আজ সে দিবে তার মুক্তির বারতা। এবং যাবার আগে বলে যায়, ঠিক প্রায় সমান পবিত্র একটি দায়িত্ব আমার নিজের প্রতিও রয়েছে।
পৃথিবীর সব নারী একটা জায়গায় গিয়ে এক, তারা নারী। নারীকে নারী বলে নয়, অন্তত একজন মানুষ হিসাবে প্রাপ্য সম্মানটুকু করবেন। “আত্মসম্মান আর সাহস-ই হোক একজন নারীর আসল পরিচয়”। ধন্যবাদ ‘সান কমিউনিকেশন’কে ২মিনিটের অসাধারণ এই বিজ্ঞাপনটির জন্য। ডিরেক্টর আশুতোষ সুজন এবং ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর তানভীর হোসাইন কে। ভবিষ্যতে আরো ভালো ভালো কাজের অপেক্ষায় রইলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৫:৫৪