somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাষ্ট্রীয় আদেশে আম্রপালিকে হতে হয়েছিল 'নগরবধূ'

০৭ ই জুন, ২০১৬ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বেলোয়ারি ঝাড়ে সজ্জিত জলসাঘরের উজ্জ্বল আলোর উৎসবকে প্রাণবন্ত করতে যাদের উপস্থিতি ছিলো অপরিহার্য তাদেরকে ইতিহাস মনে রেখেছে বাঈজী হিসেবে। শাস্ত্রীয় নৃ্ত্য গীতে পারদর্শী এই নারীরা ছিলেন সক্রিয়, সাবলীল এবং শিক্ষিত। সমাজের ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের অর্থ বিত্তের জৌলুস এবং আধিপত্য প্রদর্শনে বাঈজীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

চৌষট্টি কলায় পারদর্শীতা এবং নৈপুন্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে তবেই বাঈজীর পেশায় নাম লেখাতে হতো। সেখানে কেবল নাচ আর গান নয়, ছিলো আরো অনেক কলা। অভিনয়, চিত্রঅঙ্কন, গৃহসজ্জ্বা, রূপচর্চা, গান বাধা, ধাধা সমাধান, কবির লড়াই, তাস পাশা, জুয়া, রান্না, রাত্ন নির্নয় এবং তারিফ করার গুন গুলো অর্জন করতে হতো। বাঈজীর পেশাকে শিল্পের মর্যাদায় নিয়ে যেতে সেই প্রাচীন কাল থেকেই সাংস্কৃতিক বিষয় গুলোতে বাঈজীরা তালিম নিতেন দেশ সেরা ওস্তাদজীদের কাছে। “বাইঈ” শব্দ থেকে মূলত বাঈজি শব্দেটি এসেছে। বাইঈ বলতে বোঝানো হতো নৃ্ত্য গীতে পারদর্শী নারী। সম্মানার্থে জী শব্দটি যুক্ত করে পরে আসে বাঈজী। যাকে আমরা পেশা হিসেবে জানি। এই পেশাতে অর্থের সমাগমই বলে দেয় বাঈজী নারীরা কতটা প্রভাবমূলক পেশাতে ছিলেন। অর্থ আয়ের জন্য তারা বিভিন্ন “মুজরো” আসরে নাচগান পরিবেশন করতেন। আর নিজেদের ঘরে বসাতেন “মাহফিল”।

প্রাচীন ভারতে আম্রপালিকে রাষ্ট্রীয় আদেশে হতে হয়েছিল “নগর বধু”। যুক্তি ছিলো, “আম্রপালি এত বেশি সুন্দর ও আকর্ষনীয় যে সে কেবল একজন পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে পারেন না- হওয়া উচিৎ নয়। সেটি হবে দারুন অপচয়। শুধু তাই নয়, তার মতো দেহপল্লভীর অধিকারী এক মেয়ে রাষ্ট্রের কোনো এক বিশেষ পুরুষের স্ত্রী হলে অন্য পুরুষদের মধ্যে তার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ বেঁধে যাবে। ফলে আম্রপালিকে নিযুক্ত করা হয় নগরবধূ হিসেবে। এখানে আম্রপালির নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা-মতামতের কনো মূল্য নেই। রাষ্ট্রের আদেশে বারবনিতা হয়ে আম্রপালি বহু ক্ষমতাধর পুরুষের সঙ্গে দৈহিক মিলনে মিলিত হয়েছেন, এমনকি দেশের শত্রু ভিনদেশের রাজাও আম্রপালির প্রেমে উন্মত্ত হয়ে তার ঘরে আসতে ও থাকতে শুরু করেন”। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক এই নারীদের রূপ এবং যৌবনে ভাটা পড়লেই তাদের ধাত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হতো। অথবা তাদের স্থান হতো রান্নাঘরে। এটার নাম দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় পুনর্বাসন।

আঠারো শতকের শেষের দিকে লক্ষনৌ, বানারাস এবং পাটনা থেকে কিছু বাঈজী কোলকাতা এবং ঢাকাতে আসেন। অযোধ্যার বিতাড়িত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ কোলকাতায় নির্বাসিত জীবন যাপনের সময় মূলত সেখানে বাঈজীদের আগমন ঘটে। এমনটা শোনা যায় যে, প্রথমে আপত্তি থাকলেও স্বামী বিবেকানন্দ এক বাঈজীর গান শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন।

মুঘল আমলে যখন ঢাকাতে বাঈজী’রা আসেন তখন আহসান মঞ্জিলের রঙমহল, শাহবাগের ঈশরাত মঞ্জিল এবং দিলকুশার বাগান বাড়িতে বসতো “মুজরো”। লক্ষনৌর সাপান খানের স্ত্রী সুপনজান সে সময় বাঈজীর হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। আরো ছিলেন গওহরজান, জদ্দন বাঈ, মোস্তরী বা্ঈ, মানদা, আবেদী বাঈ, জানকী বাঈ আচ্ছি বাঈজী, আমিরজান বাঈজী, রাজলক্ষী প্রমুখ। গওহারজানকে গ্রামোফোন রেকর্ডের সম্রাজ্ঞীও বলা হয়ে থাকে। গানের সুমধুর কন্ঠ এবং গায়কির জন্য তিনি ছিলেন সংগীত ভূবনে কিংবদন্তি। রেকর্ডকৃত গওহরজানের একটি জনপ্রিয় গান ছিল, “ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেল আর এল না”। মোস্তারী বাঈ এর পুরবী রাগের খেয়াল শুনে ঐ আসরের পরবর্তী শিল্পী বিখ্যাত ফৈয়াজ খাঁ, এনায়েত খাঁ ও হাফেজ খাঁ মঞ্চে উঠতেই অস্বীকৃ্তি জানিয়েছিলেন।

বিখ্যাত বাঈজী গওহরজান ছিলেন বেনারসের মালিকজানের কন্যা। অসামান্য রূপসী মালিকজানের মা ছিলেন ভারতীয়, বাবা ব্রিটিশ। আগের নাম লেডী এডেলাইন। আর্মেনিয় ইহুদি। স্বামী রবার্ট ইওউয়ার্ডের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর এডেলাইন বাঈজীর পেশা গ্রহণ করেন। তখনই ইওসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন মালিকজান, কন্যা এঞ্জেলিনার নাম রাখে গওহরজান। মালিকাজানের সৎ বোন ছিলে জদ্দন বাই। গওহরজান ভীষন সৌখিন এবং ফ্যাশন সচেতন ছিলেন। নিজেকে সব সময় সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করতেন। গান গাওয়া ছাড়াও তিনি নিজে গান লিখতেন। নজরুল গীতির ওস্তাদ জমিরউদ্দিন ছিলেন গওহরজানের শিষ্য।

পাটনা থেকে ঢাকায় আসেন আবেদী বাঈ। আবেদীর তিন কন্যা-আন্নু, গান্নু ও নওয়াবীন নওয়াব আবদুল গনির দরবারে নিওয়মিত নাচতেন, গাইওতেন এবং মাসোহারা নিতেন। তারা তিন বোন ১৮৮০ সালে ঢাকায় মঞ্চস্থ ইন্দ্রসভা নাটকে অভিনয় করেন।

এলাহাবাদ থেকে এসেছিলেন জানকী বাঈ। তিনি এক একটি মুজরোতে তখনকার সময় দেড় হাজার টাকা করে নিতেন। তখনকার দিনে এটাই ছিলো সমভবত সর্বোচ্চ সম্মানী। জানকী ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী এবং নবাবের অতি প্রিয় রক্ষিতা। কেউ যেন জানকীকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্যে জানকীকে একটু কুৎসিত করতে নবাব ৫৬ বার ছুরি দিয়ে আঘাত করেছিলেন।একারণে জানকী বাঈ ৫৬ ছুড়ি বলেও পরিচিত।

ঢাকার আরেক বিখ্যাত বাঈজী ছিলেন আচ্ছি বাঈজি। লক্ষনৌ থেকে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন নওয়াব আবদুল গনির সবথেকে নামকরা বাঈজী। আমিরজান এবং রাজলক্ষী বাঈজীও তখনকার দিনে বেশ নামকরা ছিলেন। রাজলক্ষী বাঈজী জিন্দাবাজারের কালীবাড়ী ভেঙ্গে গেলে তা মেরামত করে দেন। ১৮৭৪ সালে নওয়াব আবদুল গনি ঢাকা শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থাপনার জন্য এক বৈঠকের আয়োজন করেন। সেই বৈঠকে রাজা-মহারাজা, জমিদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এই দু’জন বাইজীও উওপস্থিত ছিলেন। নবাব পানি সরবরাহ প্রকল্পের জন্য সবাইকে কিছু অর্থ সাহায্য করতে আহবান করলে সাড়া জানিয়েছিলেন মাত্র দু’জন। আমিরজান ও রাজলক্ষী বাঈজী। তাঁরা প্রত্যেকে ৫০০টাকা করে দান করতে রাজি হয়েছিলেন। নবাব অবশ্য কারো কাছ থেকে কোনো সাহায্য না নিয়ে পরে নিজেই একলাখ টাকা দান করেছিলেন।

বিশ শতকের বিখ্যাত বাঈজী ছিলেন দেবী বালা। খাজা হাবিবুল্লাহর বিয়ের অন্যষ্ঠানে তিনি নাচ পরিবেশন করেন। দেবী বাঈজী পরে ঢাকায় নির্মিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস-এ অভিনয় করেন। অভিনয় শেষে ফিরে যান নিজ পেশায়।

ঢাকার বাঈজীদের সময় বিংশ শতকের চল্লিশের দশকেই ফুরিয়ে যেতে থাকে। দেশভাগ আর জমিদারী প্রথার উচ্ছেদের সাথে সাথে তারা পৃষ্ঠপোষকহীন হয়ে পরে। এক সময় সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেদেরকে যৌন আদবকেতা শেখানোর জন্য পাঠানো হতো বাঈজীদের কাছে। দৃষ্টিপাতের কটাক্ষতা, কথার দক্ষতা আর কামকলাপারদর্শী বাঈজীরা ছিলেন শিক্ষাদীক্ষায়ও এগিয়ে।

বাঈজীর নৃত্যের সাথে নর্তকীদের নাচের পার্থক্য ছিলো কেবল অবস্থানে নয় বরং পরিবেশনায়। নর্তকীরা নাচের মাধ্যমে যৌন আবেদন পরিবেশন করলেও বাঈজীর নৃ্ত্যে প্রধান ছিল হাতের ছন্দময় দোলা। মুখ, চোখ, নাক ও ঠোঁটের সুক্ষ কম্পন। ছিলো বিভিন্ন ভাবের প্রকাশ। বাঈজীদের পোশাক ছিল চুড়িদার পাজামা, ঘেরদেয়া জামা এবং ওড়না। পায়ে চিকন ঘুঙুর। নর্তকীরা সাধারণত জাতে উঠত বাঈজী হয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৫:৫০
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সংস্কারের জন্য টাকার অভাব হবে না, ড. ইউনূসকে ইইউ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে ঢাকার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এবং সফররত এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক পাওলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বিহনে কাটে না দিন

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:০৩



অবস্থানের সাথে মন আমার ব্যাস্তানুপাতিক,
বলে যাই যত দূরে ততো কাছের অপ্রতিষ্ঠিত সমীকরণ।
তোমাকে ছেড়ে থাকা এতটাই কঠিন,
যতটা সহজ তোমার প্রতিটি চুল গুনে গুনে
মোট সংখ্যা নির্ণয় করা।
তোমাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

×