সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ এনামুল কবির কফির কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, কফিটা খান ভাল্লাগবে । আমি চুমুক দিতেই তিনি জিজ্ঞাস করলেন, কেমন?
বেশ ভালো । স্বাদটাই আসল কফির ।
ডঃ এনামুল বলতে লাগলেন পিওর কলম্বিয়ান কফি । আমার এক বন্ধু পাঠিয়েছে । অনেক দামী ।
তা এতো দামী জিনিস হঠাত খাওয়াচ্ছেন, কি মনে করে? দামী জিনিসটা নিশ্চয়ই প্যাশান্টের পেছনে এভাবে বিলিয়ে দেবেন না!
তিনি হেসে উঠলেন, ওদের কাছে জিনিসটা দামী হলেও আমার কাছে ততোটা নয় । পেটেই তো চলে যাচ্ছে, ধরে রাখা তো আর সম্ভব নয় । খাবার দাবার নিয়ে বিলাসিতা আমার মাঝে নেই বললেই চলে ।
আমি চুমুক দিতে দিতে গতকালকে দেখা আমার স্বপ্নের কথাটা বললাম তাঁর কাছে । তিনি বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং কাগজে কি কি নোট করে নিলেন ।
তারপর কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তিনি আমাকে স্বপ্ন নিয়ে কিছু জ্ঞান প্রদান করলেন ।
প্রিকগনিশন ড্রীম বলে একটা টার্ম আছে । যেখানে মানুষ স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখে!
কিন্তু এটা তো কাকতালীয়ও হতে পারে ।
হ্যাঁ তা হতে পারে । কিন্তু কাকতালীয় ব্যাপারগুলোও একটা স্প্যাটিস্টিক্যাল প্রবাবিলিটির ভেতর থাকতে হবে । কিন্তু প্রিকগনিশন ড্রীমের ক্ষেত্রে তা থাকছে না । প্রিকগনিশন ড্রীমটা আসলে আসে প্রিকনশাস থেকে । হয়তো আপনার বাসার ভিতগুলো ততোটা মজবুত নয় এবং আপনি এটা নিয়ে ঘনঘন চিন্তা করেন । একদিন স্বপ্ন দেখলেন ভূমিকম্পে আপনার বাসাটা ভেঙ্গে পড়ছে । পরদিন দেখলেন ঠিকই ভূমিকম্প হয়েছে এবং যা ঘটার তা ঘটেছে ।
তাহলে আপনি এখন কি সাজেস্ট করছেন?
আপনি ইদানীং খুব বেশি আজেবাজে চিন্তা করছেন । আমি কিছু ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি আর কয়েকদিন একটু বিশ্রাম নিন । ঠিক হয়ে যাবে আশা করি ।
রাতে ঘুমানোর আগে ডাক্তারের পরামর্শমত ঘুমের ওষুধটা খেয়ে নিলাম ।
“আত্নহত্যা আর আত্নরক্ষা দুটোই কঠিন কাজ । বখে যাওয়া সমাজের দুষিত জিনিসগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখাটা খুবই কঠিন । ইফতেখার কদিন চেষ্টা করেছিলো সিগারেট, গাঁজা থেকে বিরত থাকার । কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠতে পারেনি । টিংটিঙে শরীরের ঢোলা ফতুয়াটা বাতাসের তোড়ে পতাকার মত উড়ছে । তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই । একটা বন্দী নৌকার পাটাতনে বসে আপনমনে গাঁজা টেনে যাচ্ছে আর হেঁড়ে গলায় স্বরচিত গানে সুর বসাচ্ছে । খুব দূর থেকে একটা আলোর স্রোত ভেসে আসে । চরের লোকেরা নাকি দুর্ধর্ষ হয় । কিন্তু নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা ইফতেখার তা আমলে নেয়না । একটা মাছ ধরা ট্রলারে চড়ে কয়েকজন লোক পাড়ে এসে নামে । অন্ধকারে তাদের চেহারা বুঝা যায়না । ইফতেখারের দিকে আলো ফেলে ওরা । তাকে পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে ট্রলারে তুলে ফেলে অনায়াসে । তারপর আবার তারা চলে যায় যেখান থেকে এসেছে সেখানে” ।
আমার ঘোর কেটে যায়! স্তব্দ হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ; একি দেখলাম! রাত তিনটা বেজে বিশ মিনিট । আমার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে । একি!! সবকিছু মনে হয় মৃদু কাঁপছে । ভূমিকম্প নয়তো আবার! তিন চার সেকেন্ডের মাঝেই সবকিছু আবার সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়! ভূমিকম্পই হয়েছিলো মনে হয় । ঘণ্টাখানেকের আগে আর ঘুম বাবাজী আসবে না । টেবিলের ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ালাম । শূন্য! একটা সিগারেটও নাই । কি আর করা ।
বসে বসে ভাবতে লাগলাম একটু আগে দেখা স্বপ্নটার কি ব্যাখ্যা হতে পারে! নরমালি স্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা নেই । সারাদিনের ভাবনাগুলো থেকে অবচেতন মন একটা জগাখিচুড়ী বানিয়ে মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দেয় । সেটাই আমরা স্বপ্ন হিসেবে দেখি । কিন্তু আমার স্বপ্নগুলো একটু অন্যরকম । আধোঘুম আধোজাগ্রত অবস্থায় একটা ঘোরের মধ্যে স্বপ্নগুলো আমার এন্টেনায় এসে ধরা দেয় । এবং এগুলোর একটা মিনিং থাকে । ব্যাপারটা এমন নয় যে স্বপ্নগুলো বাস্তবতার সাথে মিলে যায়, বরং তার উল্টোটা । যেমন, একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম আমার প্রমোশন হয়ে গেছে । তার একসপ্তাহ পর আমার চাকরী চলে যায়, অনিয়মের অভিযোগে ।
ইফতেখার হচ্ছে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু । ভবঘুরে ইফতি ভার্সিটি পড়াকালীন সময়ে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যায় । তারপর একটা গুরুত্বপূর্ণ মার্ডার কেসের পিষ্টনি থেকে বাঁচতে সে পালিয়ে যায় দেশের বাইরে । চার বছর পর ফিরে এসে একটা টেক্সটাইল কোম্পানিতে চাকরী জুটায় । বিয়েথা করে আরো বছরখানেক আগে । তারপরও এখনো সময় পেলে মেতে উঠে পুরনো বদঅভ্যাসে । চলে যায় নির্জন কোনো স্থানে, সাথে কাউকে নেয়না ।
আমি পায়চারী করতে করতে এসব চিন্তা করতে থাকি । হঠাত চোখে পড়ে আমার ঘরের সদর দরজাটার লক খোলা । তাড়াতাড়ি আমি দরজা খুলে দেখি বাইরে কেউ আছে কিনা । নাহ! কিচ্ছু নেই । দরজা লক করে দেই এবার । মনে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে । আজকে সব কেমন যেন উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে । এমন তো হওয়ার কথা নয় । আমি খুবই সাবধানে চলি, এ ধরনের ভুল সাধারণত হয়না আমার!
পরদিন আমি অফিস থেকে অসুস্থতার ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ইফতির অফিসের উদ্দেশ্যে । কিন্তু গিয়ে তাকে পেলাম না । ও নাকি আজকে অফিসেই আসে নাই । মোবাইলে আবার ট্রাই করলাম । বন্ধ এবারো! অজানা আশঙ্কায় আমার বুকে ধড়পড় শুরু হয়ে গেছে এবার । আর থাকতে পারলাম না । রিকশা নিয়ে ওর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম এবার । মনে একটাই চিন্তা চলছে । কি কারণে সে আজ অফিসে এলো না, মোবাইলটাই বা বন্ধ কেন?
ডোরবেল কয়েকবার চাপার পরে ওর স্ত্রী দরজা খুলে দিলো । আমি ভেতরে ঢুকে বসলাম । ভয়ে উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছি শুধু ।
বললাম ভাবী একগ্লাস পানি দাও ।
ধীরেসুস্থে পানিটা খেলাম । তারপর জিজ্ঞাস করলাম ইফতি অফিসে যায়নি আজকে?
না । ও তো কেক এর অর্ডার দিতে গেছে ।
কিসের কেক? অবাক হয়ে বললাম ।
কালকে আমাদের প্রথম এনিভার্সারী তো তাই ।
তাই নাকি? তাহলে শালা আমাকে জানালো না কেন?
আজকেই জানাতো । খবরদার আমি যে আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছি; ওটা কিন্তু ওর কাছে ভুলেও বলা যাবে না ।
আমি একগাল হেঁসে বললাম, ঠিকাছে । ও কিছুই টের পাবে না ।
যে কাজে এলাম তার কিছুই হলো না । শেষমেশ ভাবীকে বললাম, ইফতিকে একটু চোখে চোখে রাখতে । অজানা কোথাও যেতে না দিতে । বলেই ভুল করে ফেললাম ।
ওর বৌ উদ্বিগ্ন হয়ে কারণ জানতে চাচ্ছে । কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছেনা । বললে হয়তো আরো চিন্তিত হয়ে উঠতে পারে । আর আমার এই রোগের কথা কেউ জানেনা । এমনকি আমার ঘনিষ্ঠ জনেরাও না । কিংবা ওরা হয়তো স্বপ্ন স্বপ্নই বলে উড়িয়ে দিতে পারে । শেষতক সিদ্ধান্ত নিলাম জানিয়ে দেওয়ার ।
আমার এই স্বপ্নতত্ত্ব এবং ইফতেখারকে নিয়ে স্বপ্নের সবটাই ব্যাখ্যা করলাম তার কাছে; শুধু নেশাগ্রস্থ উপকরণগুলো বাদে । ওর স্ত্রী খানিকক্ষণ কি যেন চিন্তা করে, তারপর হেসে উড়িয়ে দিলো সব । যা ভেবেছিলাম তাই হলো ।
বলল, ইফতেখার এখন খুবই সাবধানে চলে । এমনটি ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই । তাছাড়া, স্বপ্নে দেখা একটা জিনিস যে বাস্তবে ঘটে যায় এমন কোনো নজিরও পৃথিবীতে নেই । থাকলেও আকস্মিক, কাকতালীয়! আর মানুষ স্বপ্নে ভবিষ্যৎ দেখতে পায় বলে আমার মনে হয়না ।
আমি বেজার মুখে ফিরে এলাম । জানতাম এমন একটা কাণ্ডই ঘটবে । মনে পড়ল, আমার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে একবার যাওয়া দরকার । ওয়ালেট হাতড়ে তার ভিজিটিং কার্ডটা বের করলাম । ফোন করলাম ফোন নম্বর বন্ধ । তাঁর অফিসের ঠিকানায় চলে এলাম ।
এসে আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম! শুনলাম ডঃ এনামুল কবির বলে এখানে কোনো ডাক্তার বসেন না ।
তাহলে কি তিনি চেম্বার পাল্টিয়েছেন?
জবাব এলো, এই নামে কোনো ডাক্তার ও মনরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন বলে মনে হয়না । অন্তত আমরা চিনিনা । আমি তাকে ভিজিটিং কার্ডটা বের করে দেখালাম । রিসেপশনিস্ট ভিজিটিং কার্ডের নামটা কম্পিউটারে সার্চ দিয়েও পেলো না কাউকে ।
আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম । এর মানে একটাই হতে পারে লোকটা ফ্রড ছিলো । কিন্তু ক্যাম্নে কি? এর কারণটাই বা কি হতে পারে! নাহ! আমার মাথায় আর কিচ্ছু ঢুকছেনা । সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । বাসায় গিয়ে একটা ঘুম দরকার ।
বিছানায় শুয়ে ইফতিকে একটা টেক্সট দিলাম । বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা ও সাবধানে চলাফেরা করার উপদেশ দিলাম । ঘুমানোর আগে আরেকটা স্বপ্ন দেখলাম, ওকে নিয়েই । নিহত রিংকুর বড়ভাই ইফতেখারকে মালা পড়াচ্ছে! রিংকু, পাঁচ বছর আগে যার খুনের প্রধান আসামী ছিল ইফতেখার । এই স্বপ্নটার মিনিংও বুঝলাম না ।
পরদিন আমার ঘুম ভাঙ্গে বেলা করে । আজকে শুক্রবার । দুপুরের পরে ইফতির মোবাইলে কল দিলাম বন্ধ । মনে মনে গালি দিলাম তাকে কয়েকবার । বিকেলবেলা বের হবার জন্য রেডি হচ্ছিলাম । এমন সময় মোবাইলে এলো কল । ইফতির বৌয়ের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ শোনা যায়!
জিজ্ঞাস করলো সে আমার এখানে আছে কি না ।
আমি বললাম, না ।
জানা গেলো সকালে বেরিয়েছে এখনো ফেরার নামগন্ধ নেই ইফতির । এমনিতে শুক্রবার দিনটা ঘরেই কাটায় সে । আমিও উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজখবর নিতে লাগলাম ।
নাহ! কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তাকে ।
রাতে একবার বাসায় ফোন করে জেনে নিলাম । নাহ, ফেরেনি সে । ঘুম আসেনা আমার শুয়ে শুয়ে । নানা চিন্তা, অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠছি বার বার । আবার ফোন এলো মোবাইলে । ইফতির স্ত্রীর কান্নাজড়িত কণ্ঠ । কিছু একটা করার জন্য আকুতি জানাচ্ছে । ওর সরলতা, বন্ধুত্বের মর্যাদা নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলছে । শেষে আমাকে স্তব্দ করে দিয়ে জিজ্ঞাস করলো ওকে কোথায় রেখেছি?
আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, মানে?
লাইন কেটে গেলো ফোনের । আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিনা । সারা শরীরে থরথর করে কাঁপছে আবার । সবকিছু আবার পুনর্বিবেচনা করে দেখলাম । হিসেব মিলাতে লাগলাম সবকিছুর ।
ওইদিনের রাতের পর থেকে শুরু হয়েছে সব; যেদিন আমি ভুয়া সাইকিয়াট্রিস্টের কাছ থেকে ট্রিটমেন্ট নেই । আচ্ছা সাইকিয়াট্রিস্টের কার্ডটা কে দিয়েছিলো যেন? হ্যাঁ, আমার অফিসের এক সহকর্মী । কিন্তু কেন? আচ্ছা তারপর এই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা । সবকিছু উল্টাপাল্টা লাগা! ধ্যাৎ, মাথাটাই বিগড়ে যাচ্ছে এসব চিন্তা করতে গেলে । সবসময়ই নেগেটিভ চিন্তাটা সবার আগে আসে । অপ্টিমিস্ট হওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু পারিনা ।
ভোররাতের দিকে দরজায় কড়া শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । আরেকটু হলে দরজা ভেঙ্গেই ফেলতো মনে হয় । জোরে হাঁক দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম কে?
জবাব এলো পুলিশ ।
আঁতকে উঠলাম আমি ।
দরজা খুলে জিজ্ঞাস করলাম, কি ব্যাপার?
আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে । থানায় জিডি করা ছিল আগেই ।
কিসের ওয়ারেন্ট? কে করেছে জিডি?
ইফতেখার আলমের স্ত্রী ।
মাথায় আসমান ভেঙ্গে পড়লেও এতটা অবাক হতাম না আমি । জিডি করেছে! আমার নামে!!
ওদের কাছ থেকে এক মিনিট সময় নিয়ে কল দিলাম ইফতির নম্বরে, বন্ধ!! ওর বৌয়ের নম্বরেও কল দিলাম । রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছেনা । আমি পুলিশ সদস্যদের আইডি কার্ড দেখতে চাইলাম ।
একজন ধমকে বলে উঠলো, আমাদের সন্দেহ করছেন?
বলা তো যায়না ভাই । দেশে যে হারে গুম, হত্যা বেড়েছে ।
ওরা আইডি দেখালো । তারপরও আমি পুলিশ ষ্টেশনে যোগাযোগ করে এর সত্যতা যাচাই করলাম । ওদের আর তর সইছে না । বার বার তাড়া দিচ্ছে শুধু ।
দুদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ইফতির গলাকাটা লাশ ভেসে ওঠে । দুর্বৃত্তদের সাথে আমার একটা যোগসূত্র আছে বলে ধরা হলো । ইফতির উদ্ধারকৃত মুঠোফোনের ডাটাগুলো উদ্ধার করা হলো । সেই সাথে প্রমাণ হিসেবে আমার পাঠানো টেক্সটা তারা তুলে ধরল । ‘সাবধানে থাকিস’ এই ধরনের একটা উপদেশবাণী তাদের কাছে থ্রেট হিসেবে গণ্য হলো । আর ওর স্ত্রীর জবানবন্দী তো আছেই! পরিস্থিতি একটা মানুষকে কিভাবে বেমালুম পাল্টে দেয় তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম সেদিন ।
আমাকে তারা রিমান্ডে নিয়ে কনফেস করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো । কিন্তু আমার চিন্তা অন্যদিকে । আমি কিছু একটা মিলানোর চেষ্টা করতে লাগলাম । আমার লইয়ারের সাথে কথা বলে অনেক কষ্টে রিংকুর বড় ভাই চুন্নুর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম । চুন্নু নিজে এলো না কিন্তু তার এজেন্ট পাঠিয়ে দিলো ।
লোকটার চেহারায় একটা নিষ্ঠুরতা আছে! আমি তাকে সবকিছু খুলে বলতে গেলে । সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে সব বলতে শুরু করলো । এমনকি আমার স্বপ্নগত সমস্যা এবং ঐদিনের সমস্ত ডিটেইলস । আমার সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া, রাতে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা সব ।
আমি অবাক হয়ে গেলাম! আমাকে ফলো করা হয়েছে নিশ্চয়?
লোকটি মৃদু হেঁসে বলল, দেখুন তো আমাকে পরিচিত লাগছে কিনা?
আমি তার চেহারা, চোখ এবং হাঁসিটা লক্ষ্য করলাম ভালোভাবে । কেমন যেন পরিচিত ঠেকছে । কোথায় যেন দেখেছি মনে করতে পারছিনা ।
কী! মনে পড়ছে না তাইতো? আপনার সাইকিয়াট্রিস্টের চেহারাটা মনে আছে?
চমকে উঠি আমি । বজ্রাহতের মত স্থির হয়ে যাই । হ্যাঁ, এবার ধরতে পেরেছি । কোথায় সেই রাশভারী চেহারা, চোখের ভারি চশমা আর থুতনিতে দাঁড়ি । কই গেলো সব?
লোকটি এবার ধীরেধীরে ঝাঁপি খোলা শুরু করলো । কলম্বিয়ান কফিতে মেশানো কেমিক্যাল, যা কার্যকর হয় প্রেসক্রিপশনে দেয়া ঔষধটি গেলার পর । তারপর দীর্ঘ ঘুমে তলিয়ে যাওয়া । যার কারণে আপনার ঘরে অন্যকারো অনুপ্রবেশ আপনি টের পান নাই । আপনার ঘুমটা শেষরাতের দিকে পাতলা হয়ে যায় । মানে প্রথম স্তরে চলে আসে । ঠিক ঐ সময়টা বেছে নিয়েই আপনাকে হিপ্নোটাইজ করা হয়, বাধ্য করা হয় ঐ ধরনের একটা স্বপ্ন দেখতে ।
এবার আমার কাছে সব খোলাসা হয়ে যায় । আমিও সায় দিয়ে বলতে শুরু করি, তাইতো বলি দরজার লক কেন খোলা ছিল? আর খালি সিগারেটের প্যাকেট তো আমি কখনো টেবিলে রাখিনা ।
প্যাকেটে একটাই ছিল । নার্ভাস ফিল করছিলাম, সিগারেটটা কাজে দিয়েছে । লোকটা এমনভাবে বলল যেন সিগারেটের জন্য সে আমার কাছে কৃতজ্ঞ!
এতসব শুনার পর খুব অসুস্থবোধ করছি । এরকম একটা পরিস্থিতির মাঝেও মুখে হাঁসি রেখে বললাম, ব্রাভো! চমৎকার আইডিয়া!!
ধন্যবাদ!! বলে লোকটি উঠে দাঁড়ালো যাওয়ার জন্য । ঘুরে বলল, আবার হয়তো বা দেখা হবে! কিংবা নাও হতে পারে ।
আমি বললাম, নিশ্চিন্তে থাকুন । দেখা হবে আবার ।
লোকটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, প্রত্যুত্তরে একটা ঝাঁজমেশানো হাঁসি দিয়ে চলে গেলো ।
লোকটিকে যতটা চতুর মনে করেছিলাম আসলে ততোটা নয়! তার ভাবা উচিৎ ছিলো বিনা কারণে কেন আমি চুন্নুর তলব করতে যাবো? সে তো আমার কোনো উপকারে আসবেনা; তার উপর ইফতির শত্রুপক্ষ ।
টোপটা জুতসই হয়েছে! লইয়ারকে দিয়ে ম্যানেজ করা শার্টের বোতামের উল্টোপিঠে লুকানো ছোট্ট মাইক্রোফোনটা সাবধানে বের করে নিলাম এবার । কি ক্ষুদ্র একটা জিনিস! আমার বাঁচার একমাত্র উপায় । এই ছোট্ট জিনিসটাই এখন বহন করছে আমার প্রাণ । গুপ্ত কোন এক জায়গায় লুকায়িত আমার প্রাণভ্রমর । একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এবার প্রাণপণে ।।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৪ রাত ১০:০২