ইহা আমার বিদ্যালয় জীবনের কাহিনী। শৈশবকালে আমাদিগের বাটী হইতে বিদ্যালয়ের আপেক্ষিক দূরত্ব ও যাতায়াতের অসুবিধাহেতু নানাবিধ কারণে আমাকে বেশ কতকবার বিদ্যালয় পরিবর্তন করিতে হইয়াছিল। ফলস্বরূপ দেখা যাইত আমি একেক ক্লাশে একেক বিদ্যালয়ে বিচরণ করিতেছি । যথা চতুর্থ বত্সর বয়সে নার্সারী ক্লাশে গ্রিনরোডস্থিত একটি বিদ্যালয়ে আমার শিক্ষাজীবনের শুভসূচনা হইলো। কিন্তু এক বৎসরকাল অতিক্রান্ত হইতে না হইতেই আমার পিতামাতা আমাকে উহা হইতে আমাদের বাড়ির অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী আরেকটি বিদ্যালয়ে আনিয়া ভর্তি করাইলেন। অতঃপর কেজি ক্লাশে নতুন বিদ্যালয়ে আমার যাত্রা শুরু হইলো। কিন্তু বিধি বাম। উহার দূরত্বও আমার পিতামাতার নিকট সুবিধাজনক বিবেচিত না হওয়াতে তৃতীয় বত্সরে তাহারা আমাকে বাড়ির অতিশয় নিকটবর্তী একটি বিদ্যালয়ে আনিয়া প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করাইলেন। অবশেষে সেইখানে থিতু হইতে পারিলাম। কাকতালীয়ভাবে এই তিনটি বিদ্যালয়ই ছিল মিশনারী। যাহা হউক,আমি আমার নুতন বিদ্যালয়ে সহপাঠীদিগের সহিত হাসিয়া-খেলিয়া আনন্দে দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলাম । আমি ছিলাম ক্লাশের অভ্যন্তরে একবাক্যে যাহাকে বলে শয়্তানকুল শিরোমনি । ইহা শুনিয়া আপনারা ভাবিবেন না যে আমি অহেতুক দৌড়ঝাপ লম্ফ-ঝম্প ও দুরন্তপনা করিয়া সমস্ত বিদ্যালয় দাপাইয়া বেড়াইতাম। আমার ন্যায় শান্ত-শিষ্ট লেজবিশিষ্ট সুশীলা বালিকা সচরাচর কমই দৃষ্টিগোচর হইত। আমি কোনদিন কাহারো সহিত কলহ-বিবাদ করিয়াছি কিংবা উচ্চস্বরে কথা কহিয়াছি এহেন অপবাদ অতিবড় শত্রুও আমায় দিতে পারিবে না । তথাপি আমার প্রিয় সহপাঠিগণ আমার যন্ত্রণায় কিঞ্চিত অস্থির ছিল। তাহার কারণ আমি নানাবিধ উপদ্রব করিয়া তাহাদের স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটাইতাম। প্রতিনিয়ত নূতন নূতন বিদঘুটে ফন্দি আঁটিয়া আমি তাহাদিগকে জব্দ করিতাম এবং যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিতাম। বলা বাহুল্য এহেন শয়্তানিমূলক কার্যকলাপ করিয়া আমি নির্মল আনন্দ উপভোগ করিতাম। কিন্তু যেসকল নিরীহ বালিকাগণ আমার উপদ্রবের শিকার হইত তাহাদিগের নিমিত্ত ব্যাপারখানা ঠিক অনুরূপ উপভোগ্য ছিল না। অতঃপর তাহারা প্রত্যহ গিয়া শ্রেণীশিক্ষকের নিকট আমার নামে অভিযোগ উপস্থাপন করিতে লাগিল । কেহ কহিল, ম্যাডাম ম্যাডাম! তিথি না কালকে আমার চুলে চুইংগাম লাগাইয়া দিয়াছে। উহা টানিয়া তুলিতে গিয়া আমার মাথার অর্ধেক চুল উঠিয়া গিয়াছে - এই বলিয়া ক্রন্দন! কেহ কহিল, ম্যাডাম দেখুন না! তিথি আজ প্রত্যুষে আমার টিফিনের বাক্সে একটি তেলাপোকা ছাড়িয়া দিয়াছিল।আমি উহা দেখিয়া আতঙ্কে ভিরমি খাইয়া বেঞ্চি হইতে মাটিতে আছাড় খাইয়া পড়িয়া ভীষণ ব্যথা পাইয়াছি। আপনি সহসা এর বিচার করুন! কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ আমাকে বিশেষ স্নেহচক্ষে দেখিতেন এবং স্নেহের অধিক্যহেতু আমা সম্বন্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ কোনরূপে কাটাইয়া দেওয়ার প্রয়াস করিতেন । তথাপি অভিযোগের আধিক্যহেতু একদা কিঞ্চিত অপ্রসন্ন হইয়া আমাকে নিজ কক্ষে ডাকাইয়া লইয়া ঈষৎ তিরস্কারের ভঙ্গিতে কহিলেন, আহ! তুই যে বড় জ্বালাতন করিলি! প্রত্যহ তোর নামে অভিযোগ শুনিতে শুনিতে আমি ব্যতিব্যস্ত হইয়া গেলাম! কেন তুই অযথা উহাদিগকে খোঁচাইতে যাস? বলাই বাহুল্য আমি উনার মুখের ভাবখানা দেখিয়াই বুঝিয়া লইয়াছিলাম, উহাতে ভৎর্সনার পরিমান যত না তাহার চাইতে অধিক প্রশ্রয় মিশানো ছিল। সুতরাং আমি তৎক্ষণাত আদুরে বেড়ালটির ন্যায় আহ্লাদে কাঁচুমাচু মুখ করিয়া কহিলাম, ম্যাডাম আমি তো উহাদিগকে আপনার মনে করিয়া ভালবাসিয়া উহাদের সহিত কিঞ্চিত মশকরা করিবার চেষ্টা করি,কিন্তু উহারা আমাকে ভুল বুঝিয়া খেপিয়া উঠে! যাহা হউক, উহারা যখন রুষ্ট হইয়াছে আমি আর এহেন উপদ্রব করিব না! আমার কথা শুনিয়া ম্যাডামের হৃদয় সম্পূর্ণরূপে বিগলিত হইয়া গেল এবং তিনি আমাকে কোনরূপ শাস্তি প্রদান না করিয়াই আরো দুই-একটি স্নেহমিশ্রিত তিরস্কার প্রদানপূর্বক বিদায় করিলেন। কিন্তু ক্লাসে আমার ভুক্তভোগী সহপাঠিগণ বিচারের এরূপ রায়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না মোটেই! তাহারা যখন দেখিল আমি তাহাদিগকে নানারূপে নাকাল করা সত্বেও এহেন নির্ভাবনায় বিনা বিচারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি তখন তাহাদের অন্তর জ্বলিয়া পুড়িয়া খাক হইয়া গেল! অতঃপর তাহারা কেবল নিষ্ফল আক্রোশে ফোঁসফোঁস করিতে করিতে আপাতদৃষ্টিতে আকাশ বাতাস কাঁপাইয়া তুলিতে লাগিল এবং পুনঃ পুনঃ আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া আমাকে ভষ্ম করিয়া ফেলিতে চাহিল । আমার পরম সৌভাগ্য যে তাহাদের মধ্যে কেহই মুনি দধীচি ছিলেন না, নচেৎ তাহাদের চক্ষুবর্ষিত অগ্নিতে আমি ওই মুহূর্তে ওই স্থানেই সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হইয়া যাইতাম! যাহা হউক এ যাত্রায় ঈশ্বরের কৃপায় বাঁচিয়া গেলাম।
উপরোক্ত বিদ্যালয়ে প্রিয় শিক্ষক ও সহপাঠিগনের অপার স্নেহে সুখেই দিনাতিপাত করিতেছিলাম কি অকষ্মাৎ আমার মাতার মস্তিষ্কে পুনরায় আমার বিদ্যালয় পরিবর্তন করিবার চিন্তা উদয় হইল । তিনি আমাকে দেশের একটি নামকরা বিদ্যালয়ে আনিয়া প্রায় বিনা প্রস্তুতিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াইলেন এবং আশ্চর্জনক্ভাবে আমি সেই সুকঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া যাওয়ায় আনন্দের আতিশয্যে আমাদের বসতবাটী হইতে উহার দূরত্বের কথা এইবার কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া আমাকে উক্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি করাইয়া দিলেন। অতঃপর আমি নবম বর্ষীয়া বালিকা চতুর্থ শ্রেণীতে একটি সম্পূর্ণ নূতন পরিবেশে নূতন একটি বিদ্যালয়ে পদার্পণ করিলাম।
নূতন বিদ্যালয়ে আসিয়া প্রথমে কিছুদিন আমি গভীর মনোযোগের সহিত চতুর্পার্শ্বের পরিবেশ পরিস্থিতির আনুকুল্য পর্যবেক্ষণ করিলাম। অতঃপর অল্পদিনের মধ্যেই পরীক্ষার ফলাফল ও ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষিকাগনের সহিত স্বতঃস্ফুর্ত ও সপ্রতিভ বাক্যবিনিময়ের মাধ্যমে তাহাদের বিশেষ স্নেহ ও সুদৃষ্টি লাভ করিতে সক্ষম হইলাম । উহার পর আমাকে আর পায় কে? আমি স্বরূপে প্রত্যাবর্তন করিলাম এবং সকল প্রকার ভয়-ভীতি ভুলিয়া পুনরায় দ্বিগুন উত্সাহে নানাবিধ শয়্তানিমূলক কার্যকলাপে আত্মনিয়োগ করিলাম । আমার প্রধান শিকার ছিল মাতব্বর শ্রেনীর ক্লাস ক্যাপ্টেনগণ যাহাদের হবি-তম্বি আর ভাব দেখিয়া প্রায়ঃশই বোধ হইত যে উহারা রাজা আর আমরা সাধারণ ছাত্রীগণ উহাদের প্রজা । অতঃপর আমি প্রায়ঃশই তাহাদের নানাবিধ নির্দেশ অমান্য করিতে লাগিলাম এবং কথার নানা প্যাঁচে ফেলিয়া সমগ্র ক্লাসের সম্মুখে উহাদের মান-মর্যাদা ধূলিতে বিসর্জন করিতে উদ্যত হইলাম। উহারা আমাকে দুই-চক্ষে দেখিতে না পারিলেও আমার বিরুদ্ধে কোনোরূপ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় এবং আমি শিক্ষিকাগণের বিশেষ প্রিয়ভাজন হওয়ায় আমার এহেন দৌরাত্ম্যের কোনো প্রতিকার করিতে পারিত না। আর আমিও মহানন্দে নিশ্চিন্তমনে তাহাদের পিন্ডি চটকাইয়া যাইতাম
একদিনের ঘটনা! তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। সেইদিন কোনো কারণে শিক্ষক ক্লাসে উপস্থিত হন নাই। তো ছাত্রীগণ সকলে যথারীতি হই-হট্টগোল আর পরস্পরের মধ্যে খোশগল্পে মশগুল! এমত সময়ে আমার মস্তিষ্কে শয়তানি বুদ্ধি খেলিয়া গেল। আমার সম্মুখের বেঞ্চিতে ছিল ক্লাসের সর্বাপেক্ষা সুন্দরী কন্যা যে কিনা কিছুদিন পূর্বেই ক্লাসভিত্তিক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়া সকলের দৃষ্টি কাড়িয়া লইয়াছিল! অন্য সকল সুন্দরীগণের মতই তাহার একটি মুদ্রাদোষ ছিল কিয়ৎক্ষণ পর পর আয়নায় আপন চন্দ্রবদনখানি অবলোকন করা এবং তাহার কিঞ্চিত পরিচর্যা করা (যাহা আমার নিকট সম্পূর্ণরূপে অনাবশ্যক বলিয়া বোধ হইত )! তাহার জন্য উহার স্কুলব্যাগে সর্বদা একটি ক্ষুদ্র আয়না ও চিরুনি থাকিত! কিন্তু ইহাতেও সে পরিতুষ্ট থাকিতে না পারিয়া ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে যখনি অবসর পাইত ধৌতখানায় গিয়া বড় আয়নায় সৌন্দর্যচর্চায় প্রবৃত্ত হইত!
যাহা হউক উহার এইরূপ কর্মকান্ডে যারপরনাই বিরক্ত হইয়া আমি মনে মনে উহাকে সামান্য শিক্ষা দিবার ফন্দি আঁটিলাম। সেইদিন সে আমার সম্মুখের বেঞ্চিতে বসিবার দরুন তাহাকে জব্দ করিবার সুযোগ পাইলাম। আমি আমার খাতার একটি পৃষ্ঠা ছিঁড়িয়া উহাতে বড় বড় করিয়া লিখিলাম, আমি এক গর্দভ! রাঙ্গা আলুর ন্যায় মুখখানি আমার; কিন্তু ঘটে বুদ্ধি নাই!
লিখিবার পরে আমি ভাবিতে লাগিলাম কিরূপে ইহাকে তাহার পৃষ্ঠদেশে সাইনবোর্ড রূপে সংযুক্ত করা যায়! এমতাবস্থায় আমার এক সখী আমার সহযোগিতায় আগাইয়া আসিল! সে তাহার কেশ হইতে একখানি হেয়ারক্লিপ খুলিয়া আমার হস্তে দিল!আমি উক্ত ক্লিপ দিয়া অতিশয় সাবধানতার সহিত আমার লিখিত কাগজটি সুন্দরীর পৃষ্ঠদেশে লাগাইয়া দিলাম
অতঃপর আমরা দুইজনেই রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। কিয়ৎক্ষণ পরেই সুন্দরী বেঞ্চি হইতে উঠিয়া যথারীতি ধৌতখানার দিকে যাত্রা করিল এবং তাহার পৃষ্ঠের সাইনবোর্ডখানি সকলের দৃষ্টিগোচর হইলো ! বলা বাহুল্য উহা দেখিয়া সমগ্র ক্লাসে হাসির রোল উঠিল ! সুন্দরী প্রথমে কিয়ৎক্ষণ তাহাকে দেখিয়া সকলের এরূপ হাসির কারণ বুঝিতে না পারিয়া হতবুদ্ধির ন্যায় এদিক ওদিক চাহিল। পরক্ষণে তাহার এক সখী যখন তাহাকে তাহার পৃষ্ঠের দিকে নির্দেশ করিল তখন সে ঘটনা বুঝিয়া লজ্জা-ক্ষোভ-অপমানে রক্তিমবর্ণ ধারণ করিল! ইহার পর সুন্দরীগণের চিরাচরিত নিয়মানুসারে নিজের বেঞ্চিতে আসিয়া অবুঝের ন্যায় ক্রন্দন করিতে আরম্ভ করিল! তাহার সহচরিগণ তখন তাহাকে নানারূপে সান্তনা দিতে লাগিল কিন্তু সে কিছুতেই ক্রন্দন থামায় না! আমি যদিও তাহার এই অহেতুক ক্রন্দনে কিঞ্চিত বিরক্ত হইয়াছিলাম তথাপি যখন দেখিলাম তাহাকে নিবৃত্ত করা মুশকিল তখন তাহাকে ডাকিয়া কহিলাম, বন্ধু তুমি এরূপ বিচলিত কেন হইতেছ? এইখানে তোমাকে হীন করার নিমিত্ত আমরা কিছুই করি নাই, আমরা তো কেবল তোমার সহিত একটুখানি দুষ্টামি করিতে চাহিয়াছিলাম! তাহাতে যে তুমি এরূপ আঘাত পাইবে তাহা তো স্বপ্নেও ভাবি নাই!
অতঃপর বহু সাধ্য-সাধনায় তাহাকে শান্ত করিলাম [সুন্দরী বলিয়া কথা ]। পরবর্তী কিছুদিন যাবত ক্লাসে এই খেলা চলিতে লাগিল! যে যাহাকে জব্দ করিতে চাহিত সে তাহার পৃষ্ঠে কিছু না কিছু আপত্তিকর কথা লিখিয়া টাঙ্গাইয়া দিত! তবে আমার প্রতি বহুজনেরই বহু ক্ষোভ থাকা সত্বেও আমার পৃষ্ঠে কেহ কোনদিন কিছু টাঙ্গাইবার সাহস করে নাই। ভরসা কি আমি আবার কোনদিন কি ফন্দি আঁটিয়া উহাদের বারোটা বাজাইয়া দিই!!!
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জুন, ২০১০ রাত ৩:৩৮