"হিউম্যান রিসোর্স আবার কোন কোম্পানি?" পান চিবোতে চিবোতে বদখত চেহারার ইমিগ্রেশনের এক মহিলা পুলিশ বাজেভাবে জিজ্ঞেস করল!!!





আমার তিনদিনের অফিসিয়াল ট্রেনিং। ফ্লাইটের কারণে আমি পৌঁছলাম আগের দিন ভোরে। তাই সারাটা দিনই ছিল ফাঁকা। হোটেলে চেক-ইন করেই সকাল নয়টার মধ্যেই বের হয়ে গেলাম ঝটিকা ট্যুরে। এই এ্যাপ দিয়ে আগে থেকেই একটা রাফ ট্যুর প্ল্যান করে নিয়েছিলাম। এই এ্যাপে দর্শনীয় স্থানগুলোর ডিটেইলস, ম্যাপ, খোলা-বন্ধের সময়, টিকেটভাড়া ইত্যাদি থাকে, ফলে পরে আর অন্ধের মত হাতড়ে বেড়াতে হয় না।
সি একুরিয়ামঃ
৩৮ ডলারের টিকেট কেটে প্রথমেই ঢুকে পড়লাম সি একুরিয়ামে। লক্ষাধিক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের এক একটি বিশালাকার স্বচ্ছ জলাধার। গোল্ডফিশের চাইতেও ক্ষুদ্র মাছ থেকে শুরু করে হ্যামারহেড শার্ক, সবই আছে এখানে। পুরোটা ঘুরে দেখতে কমপক্ষে তিনঘন্টা সময় লাগবে। পুরো জায়গাটি জুড়ে খুব স্লো মিউজিক বাজতে থাকে। সবমিলিয়ে চমৎকার এক পরিবেশ। চোখের সামনে এক সঙ্গে এত মাছ দেখাটাও একটা বিশাল ব্যপার। ছোট ছোট বাচ্চারা খুবই মজা পাচ্ছে এসব দেখে। পুরোটা ঘুরে দেখার পরে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। এর বিশালত্ব নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। চলুন কিছু ছবি দেখে আসা যাক।
ইউনিভার্সেল স্টুডিও-সিঙ্গাপুরঃ
এর নাম বহু শুনেছি। যে-ই সিঙ্গাপুর যাই, সে-ই নাকি একবার ঘুরে আসে। সি একুরিয়াম শেষ করেই ৭৪ ডলারের টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম এই অসাধারণ থিম পার্কে, এই টিকেটে সমস্ত রাইডে চড়া যাবে। বিশাল বিশাল সব কার্টুন কারেক্টার সাজানো চারদিকে। মাদাগাস্কারের রাইডে চড়লাম প্রথমে। মাদাগাস্কার পার্ট ওয়ান পুরোটা রাডাইডের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে রোবটিক কারেক্টার দিয়ে করা। রাইডের শুরুতেই বিশাল আকারের কাঠের বক্স আপনার উপর এসে পড়তে যাবে...কিন্তু ভয় নেই, পড়বে না। পুরো রাইডে আছে ছোট ছোট চমক। তারপর ঢুকলাম, শ্রেক-এর ক্যাসলে। সেখানে ছিল ফোর ডি মুভি। সেখানে মুভমেন্টের সাথে সাথে আপনার সিটটিও নড়তে থাকে। আবার গাধাটি থুতু দিলে আপনার গায়ে পানি ছিটকে আসে। সবচেয়ে মজার হল, থ্রিডি স্ক্রিনে অনেকগুলো মাকড়সা নিচে পড়ামাত্রই মনে হল পায়ের উপর কী যেন নড়ছে!


আরেকটি রাইডে চড়লাম যাতে পা ঝুলিয়ে বসতে হয়। আমার মুখোমুখি আরেকটি বাচ্চা মা'র সাথে বসেছিল। রাইডে আমার জান যায় যায়, রাইডের শেষে পিচ্চি হতাশভাবে বলে, "দ্যাটস ইট!"

এরপরে ঢুকলাম 'মামি'র সেটে। বিশাল আকারের পিরামিড গেট দিয়ে আমরা ঢুকলাম। এই রাইড আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ রাইড। রাইডের শুরুতে আমার পাশে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে বসলো, বয়স বড়জোর পাঁচ কি ছয় হবে। আমি বললাম, ডোন্ট গেট স্কেয়ার্ড, ইট উইল বি এ গ্রেট ফান। সে হেসে বলল, ইয়েস আই নো। আমার কোন ধারণাই ছিল না যে আসলে কী হতে যাচ্ছে। পুরো অন্ধকার আর ভয়াবহ সাউন্ড ইফেক্টের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকাভাবে প্রচন্ড স্পিডে চলছে কার্টটি...পুরো সময়টি আমি সমানে চিৎকার করে চললাম। রাইড শেষে আমি চোখ খুললাম, পাশের পিচ্চিটা আমারে কয়, "ইটস সো ফানি..."








মুস্তাফা সেন্টারঃ
পরদিন ট্রেনিং শেষে সন্ধাবেলায় গেলাম মুস্তাফা সেন্টারে। এটা পুরাপুরি ঘুরে দেখতে সারাদিন লেগে যাবে। হেন জিনিষ নেই যা সেখানে পাওয়া যায় না। দামও তুলনামূলক। কাজেই টুকটাক কিছু গেরস্থালীর কেনাকাটা সেখান থেকে করলাম। হবু পিচ্চির জন্যও কিছু মোজা, ফিডার ইত্যাদি কিনলাম :!> :!> কিছু গোল্ডের অর্নামেন্টস কিনলাম। জানতাম এখানে গোল্ডের দাম কম। কিন্তু ট্যাক্স, মেকিং চার্জ সহ প্রায় প্রতি ভরিতে ৪৬০০০ টাকা পড়ল। এখানে টুরিস্টের জন্য জিএসটি রিফান্ড বলে একটি বিষয় আছে, আগে জানতাম না। কেনাকাটার পরে নির্দিষ্ট কাউন্টারে গেলে একটি এমাউন্ট ওরা রিফান্ডের জন্য ডকুমেন্ট দেবে। যা দেখিয়ে এয়ারপোর্টে ক্যাশ রিফান্ড পাওয়া যাবে। না জানার কারণে প্রায় ১৫০ সিঙ্গাপুরী ডলার ধরা খাইলাম।


চায়না টাউনঃ
আহামরি কিছু নয়। স্ট্রিট সাইড শপ। এখানকার পন্য মোটামুটি পুরো সিঙ্গাপুর জুড়েই পাওয়া যায়।
লিটল ইন্ডিয়াঃ
ঘুরে দেখার তেমন সময় পাইনি। যখন গিয়েছিলাম ততক্ষণে অধিকাংশ দোকনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সিংহভাগ দোকান তামিল বা ভারতের দক্ষিণীদের মালিকানায়। এই এলাকায় অধিকাংশ দোকানের রজনীকান্তের ছবি দেখা গেল

মেরিনা বেঃ
ট্রেনিং শেষ করে সন্ধ্যায় বের হলাম সিটি ভিজিটে। প্রথমে গেলাম মেরিনা বে রিসোর্টে। এর ৫৭ তলা উপর থেকে পুরো সিঙ্গাপুর শহরটার চমৎকার একটা ভিউ পাওয়া যায়। এর টপ ফ্লোরে উঠতে সাধারণতঃ টিকেট কাটতে হয়। তবে রেস্টুরেন্টে খেলে কোন টিকেট লাগে না। এই ফ্লোরটা একটা নৌকার শেপে করা। আসলে পুরোটাই একটা বিশাল সুইমিংপুল। তবে সেখানে কেবল হোটেল গেস্টদের প্রবেশাধিকার আছে। আমরা আউটডোর লাউঞ্জে বসে সবচেয়ে কমদামের (১৫ ডলার) জুস এপল মোজিতো খাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখলাম না। যাই হোক, বিল্ডিংটার ইন্টিরিয়র আর আর্কিটেকচারাল ডিজাইন সত্যিই অসাধারণ। এই ছাদ থেকেই আমরা মারলায়ন পার্কের সামনের লেকের উপর লেজার লাইট শো দেখলাম। এই শো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে একঘন্টা পরপর হয়। মারলায়ন পার্ক থেকে এটা আরও সুন্দর দেখা যায়। চাইলে টিকেট কেটে লেকের উপর বোটে ভেসে ভেসেও শো'টি উপভোগ করা যেতে পারে। অবশ্য আমরা দুজনেই স্ত্রী-বিহীন হওয়ায় আর তেমন আগ্রহ হয় নাই...


সিংগাপুর ফ্লায়ারঃ
মানে চরকী আর কী! তবে বিশেষত্ব হল এর আকার এবং উচ্চতা। এটিকে অবশ্য বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ফ্লায়ার বলা হয়। টিকেট লাগলো ৩৩ ডলার, তবে সিংগাপুর এয়ারলাইন্সের বোর্ডিং পাস বা টিকেট দেখাতে পারলে ২০% ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে। সাথে না থাকায় পুরাই লস খাইলাম


মারলায়ন পার্কঃ
এটি হচ্ছে সিঙ্গাপুরের আইকন। এখানে ঢুকতে কোন টিকেট লাগে না


মারলায়ন পার্ক থেকে প্যানোরামাঃ
নাইট সাফারিঃ
ট্রেনিং শেষে পরের সন্ধ্যায় গেলাম নাইট সাফারীতে। সাফারী পার্ক সম্বন্ধে আমার জ্ঞান ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পর্যন্ত। নাইট সাফরী পার্কটা সিঙ্গাপুর জু'র একটা অংশ বলে মনে হল। ৩৮ ডলারের টিকেট কেটে লাইন ধরে উঠে পড়লাম চারদিক খোলা একটি ট্রেনে। চারদিক সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। হালকা মৃদু আলোয় বাঘ-সিংহ থেকে শুরু করে বাইসন সবই প্রায় দেখলাম। পুরো সময়টা জুড়ে মিষ্টিকন্ঠে একটি মেয়ে বর্ণনা দিচ্ছিল...They may not have voice like us, but they have the same heart as we have. এখানে পায়ে হাঁটার পথও আছে। অনেককেই দেখলাম স্ট্রলারে পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চা নিয়ে সাফারী পার্কে হেঁটে বেড়াচ্ছে


খাবারঃ
স্থানীয় খাবার বা সি-ফুড ট্রাই করে দেখার তেমন আগ্রহ বা সময় কোনটাই আমার ছিল না। তবে মুস্তাফা সেন্টারের আশেপাশে অনেক ভারতীয় রেস্তোঁরা আছে যেখানে দেশীয় ধাঁচের খাবার পেতে পারেন। তবে সবকিছুরই দাম আকাশছোঁয়া। আধালিটার পানির দাম প্রায় ১০০ টাকা। আমার ভরসা ছিল ম্যাডোনাল্টস বা স্টারবাক্স।
আরও কিছু বিষয়ঃ
এখানে চাইলেই ট্যাক্সি থামানো যায় না। প্রতিটি শপিং মলের নিচে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে। সেখানে ৩০-৪৫ মিনিট লাইনে দাঁড়ানোর পরে আপনি ট্যাক্সিতে উঠতে পারবেন। প্রতিটি ট্যাক্সিতে মাস্টার/ভিসা/এমেক্স কার্ড পাঞ্চের ব্যবস্থা আছে। তবে সারচার্জ সংক্রান্ত জটিলতায় ট্যাক্সিতে ভিসাকার্ড ১লা মে ২০১৪ থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ফোনে দেশে কথা বলতে নাম্বারের আগে ০১৯ যোগ করে কল করলে, (মানে ০১৯৮৮০১৭৩০******) - কথা বলার খরচ অনেকখানি কমে যায়





ছবিস্বত্বঃ লেখক
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৪ সকাল ১১:১৭