উপন্যাসের নামঃ নমানুষ
লেখার জনরাঃ গোয়েন্দা / থ্রীলার
লেখকঃ মহিউদ্দিন মোহাম্মাদ যুনাইদ
প্রকাশনীঃ শব্দশিল্প প্রকাশনী
প্রচ্ছদঃ @মোজাদ্দেদ আল ফাসানী জাদিদ
প্রকাশঃ একুশে বইমেলা ২০২২
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৭৫
মলাট মূল্যঃ ২৫০/=
এই ব্লগের অন্যতম সেরা গল্পকার মহিউদ্দিন মোহাম্মাদ যুনাইদ ব্যক্তিগতভাবে আমার সহপাঠী, বুয়েটের বন্ধু এবং বর্তমানে অফিস কলিগ। সামু ব্লগের ওর লেখার নিয়মিত পাঠক আমি। ওর লেখা পড়ার জন্যই আমি সামু ব্লগে এসেছি। নমানুষ প্রকাশের পরপরই অফিসে আমি এর একটা কপি পাই ওর কাছ থেকে। যুনাইদের লেখার ধরন কিছুটা ভিন্নধর্মী। প্রায় সব সময়ে সামাজিক বিষয়গুলি নিয়ে ও লেখে এবং এই উপন্যাসটাও এর ব্যতিক্রম নয়। দৈনিক পত্রপত্রিকাতে আমরা যেইসব পাপাচারের ঘটনাগুলি নিয়মিতই পড়ি সেইগুলি এবং এইসব ঘটনাগুলির পিছনের অন্ধকার জীবনের কাহিনী কলমের খোঁচায় দুর্দান্তভাবে ও উপন্যাসের পাতায় তুলে এনেছে।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
লেখা শুরু হয়েছে এক লাশের পানিতে ভেসে আসার ঘটনা নিয়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটা মেয়ের মৃত লাশ ভেসে আসা নিয়ে হইচই শুরু হলে পুলিশ নামে সেই ঘটনার তদন্তে। শুরু হয় পুলিশের গোয়েন্দা তদন্ত। সাব ইন্সপেক্টর মারুফ লাশের খোঁজখবর নেয়া শুরু করলে শুরু হয় আশ্চর্য্য সব ঘটনা। কেঁচো বের করতে যেয়ে বের হয়ে আসে আস্ত এক অজগর। লাশের সাথে মারুফের স্ত্রীর চেহারার মিল থাকার কারনে লাশের প্রতি সফট কর্নার গড়ে উঠে মারুফের। শুরু হয় নিজের ভিতরের অর্ন্তদ্বন্দ। উপর থেকে ক্রমাগত চাপ আসে কেস গায়েব করে দেয়ার জন্য। সবদিকের চাপ সহ্য করতে না পেরে মারুফ সাহায্যের জন্য যায় একজন সাইকোলজিস্টের কাছে। মনের সব বদ্ধ দুয়ার সাইকোলজিস্ট উন্মুক্ত করে দিলে মারুফ আবার ঝাঁপিয়ে পরে সেই তদন্তের কাজে। উদ্ধার করে ফেলে নোংরা এক নির্মম সত্য। পরেরদিনই হুট করেই আসে মারুফের সাসপেনশন অর্ডার। সাস্পেন্ড করে সেই থানা থেকে সরিয়ে দেয়া মারুফকে।
এখন কী করবে মারুফ?
.
গ্রাম থেকে আসা ঢাকা ভার্সিটির হলে থাকা মেয়ে সোমা হুট করেই উধাও হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সোমার বয়ফ্রেন্ড সাজিদ কোন হদিশ পায় না। কিছুদিন পরেই ঢাকার এক বিশাল নাইটক্লাবে সিমি নামের একজন র্যাম্প মডেলের উত্থান ঘটে। আন্ডারওর্য়াল্ডের ডন জিসান সিমি নিয়ে মেতে উঠে নোংরা সব কাজে। গড়ে তুলে নাইটক্লাব, প্রস্টিটিউশন এবং এডাল্ট ভিডিও বানানোর ইন্ডাস্ট্রি। দ্রুত উপরে উঠে আসা সিমি নাটকীয়ভাবে জড়িয়ে পরে আরেক ভয়ংকর অপরাধে। জিসানের সাথে বাধে বিরোধ। খুন হয়ে যায় সিমি। কিন্তু কেন?
.
হুট করেই বিয়ের কয়েক বছর পর ফাহরীনের শখ হয় মডেলিংয়ে নামার। একটা এ্যাড ফার্মের প্ররোচনায় ঘর থেকে বের হয়ে আসে মডেলিং জগতে নাম কামানোর জন্য। মডেলিংয়ে এবং সুন্দরী প্রতিযোগীতায় নামার জন্য ছয়মাসের বাচ্চা মেয়ে এবং স্বামীকেও পুরোপুরি অস্বীকার করে মিডিয়ার কাছে। অভিমানী স্বামী ফিরোজ ফাহরীনের এইসব নোংরা কাজ সহ্য করতে না পেরে ঢাকা থেকে পালিয়ে অনেক দূরে চলে যায় মেয়েকে নিয়ে।
.
থানায় ৯৯৯য়ে কল করে সাহায্য চাওয়া হলে পুলিশ যেয়ে উদ্ধার করে পারিবারিক গণ্ডগোলে মারধর খাওয়া প্রচণ্ড আহত অবস্থায় একজন গৃহিনী আঁখিকে। নারী নির্যাতন মামলায় পুলিশ তদন্তে নেমে ধরে নিয়ে আসে এর স্বামীকে। কিন্তু কেস মোড় আমূল ঘুরে গেল এই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদে। বের হয়ে আসলো প্রচন্ড নোংরা এক ঘটনা। প্রবাসীদের স্ত্রীদের নিয়ে মৌজ ফুর্তি করা গোপন এক অধ্যায়। আঁখি কার নির্দেশে খুন করেছিল আরেকটা ছেলেকে? পুলিশের এ্যারেস্ট করা একজন অপরাধীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় প্রায় অনেকগুলি প্রবাসীদের স্ত্রীদের নোংরা ভিডিও। সর্ম্পূন স্বেচ্ছায় এইসব ভিডিও করা হয়েছে। তদন্তে এইসব স্ত্রীদের নাম বের হয়ে আসলে সব জায়গায় হইচই পরে যায়। আতংক ছড়িয়ে পরে অনেক নামীদামী মানুষের। প্রচণ্ড চাপ আসে থানার দায়িত্বে থাকা এএসপি শুভ আহমেদের কাছে। একের পর এক ঘুষের প্রলোভন আসতে থাকে পুলিশের কাছে।
.
মধ্যরাতে নায়িকা এবং মডেল ফাহরীন এক নাইটক্লাবে ব্রুটালি রেপড হলে ঘটনা মোড় নেয় আরেকদিকে। মূল অপরাধীর বাবা দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য উনি নেমে পরেন সর্বশক্তি নিয়ে। উনার অনুরোধেই পুলিশের ভিতরে চলে ব্যাপক রদবদল।
.
ঘটনার পরেরদিন সকালবেলা রমনা থানায় ধর্ষিতা ফাহরীন সোজা চলে আসে এএসপি শুভ আহমেদের কাছে নায্য বিচারের দাবী নিয়ে। ঘটনার সত্যতা জেনে শুভ নির্দেশ দেয় পূর্ণ তদন্তের।
.
গুলশানের এক হোটেলে শুভকে ডেকে নিয়ে সরাসরি ভয়ংকর হুমকি দেন জিসানের বাবা। ফাহরীনের ধর্ষন কেস মিটমাট করার জন্য প্রচণ্ড চাপ দেন শুভকে।
.
এখন কী করবে এএসপি শুভ আহমেদ? কোন দিকে যাবে?
.
উপন্যাসের পরতে পরতে টানা উত্তেজনা। উনার লেখা আগের উপন্যাস #শবনম এর পাঠক পাঠিকাদের জন্য বাড়তি পাওনা হিসেবে সেই উপন্যাসের নায়িকা শবনমও আছে এই উপন্যাসে শুভ আহমেদের স্ত্রী হিসেবে। সম্ভবত শবনম'কে নিয়ে উনার এটাই শেষ লেখা।
কিছু সমস্যা এবং যা যা ভালো লাগেনিঃ
উপনাসের প্রুফ রিডারের ব্যর্থতা কিছু কিছু জায়গায় চোখে পড়ে। খুব মনোযোগী পাঠকরা অল্প কিছু বানানও ভুল দেখতে পাবেন। পেজের কিছু কিছু জায়গায় ফরম্যাট ঠিকমতো হয়নি।
বাড়তি কিছুঃ
এই উপন্যাসের নায়ক শুভ আহমেদের সাথে সাথে যেই চরিত্রগুলি পাঠকদের আকর্ষন করবে-
১) দৃঢ়চেতা পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর মারুফ
২) সাইকোলজিস্ট নাবিলা হক
৩) পুলিশের গোয়েন্দা অফিসার রাহাত
অসাধারন কিছু দৃশ্য আছে এই উপন্যাসে। যেই জায়গাগুলি রীতিমত মুগ্ধ হয়ে পড়েছি-
১) সাজিদের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাবার ঘটনা
২) মাঝের চরে রাতেরবেলা মারুফের এ্যাকশন যাবার ঘটনা
৩) নাইটক্লাবের ভিতরের দৃশ্য বর্ননা
৪) ফাহরীনের নিজের সংসারে ফিরে আসার দৃশ্য
সামুর মডু জাদিদ সাহেব অসাধারণ একটা ডিজিটাল প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন। উনাকে ধন্যবাদ। প্রচ্ছদ দেখামাত্রই সবাই পছন্দ করেছে।
১৭৫ পৃষ্টার এই উপন্যাস পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠা যায় না। পুরো উপন্যাস আমি একটানা পড়েছি।
পাঠকদের লেখার ভিতরে বেঁধে রাখার আশ্চর্য এক গূণ আছে যুনাইদের। সম্ভবত অন্যতম সেরা লেখা এটা ওর।
সবাইকে নমানুষ পড়ার আমন্ত্রন দিচ্ছি। আশা করছি নমানুষ পড়ে সবাই মুগ্ধ হবেন।
(সোশাল মিডিয়ায় বেশ কিছু সাহিত্য গ্রুপে আমি এই রিভিউ পোস্ট করেছিলাম আমার ফেসবুক আইডি রওনক হাসান দিয়ে। সেখানেও পড়ে আসতে পারেন)
উৎসর্গঃ শ্রদ্ধেয় ব্লগার, গল্পকার, উপন্যাসিক মহিউদ্দিন মোহাম্মাদ যুনাইদকে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:২০