ডিপার্টমেন্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথটা বেশ নির্জন। ধীরে হাঁটলেও মিনিট পনেরর মত লাগে বাড়ি পৌঁছাতে। হাঁটতে হাঁটতে নিবিষ্ট মনে জীবনঘনিষ্ঠ অনেক কিছু চিন্তা করা যায় এসময়। যেমনঃ ‘বাড়ি গিয়ে কী খাব?’, ‘বাসন মাজার ডেট কি আমার?’ ‘কতদিন ধরে না ধুয়েই একি কাপড়ে চলছে?’ এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে শুরু করে ‘সামনে ক’টা পরীক্ষা?’, ‘কত বড় সিলেবাস?’, ‘পিএইচডি করে আদৌ কী লাভ?’ এধরণের তুচ্ছ বিষয়াদি নিয়ে নিজের সাথে গভীর আলোচনার সুযোগ পাওয়া যায় এসময়। আজকে কেন যেন এসবের কোন কিছুই মাথায় আসছেনা। বার বার বরং মনে হচ্ছে আমি এখনো কনফারেন্স রুমের হোয়াইট বোর্ডের সামনে কালো মার্কার পেন নিয়ে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছি আর আমার সামনের টেবিলে প্রফেসর ম্যারিলুসোফা, প্রফেসর উইমার, প্রফেসর গ্রিমশ আর প্রফেসর গুরুমূর্তি রুক্ষমূর্তি হয়ে বসে আছেন। সদ্য বিগত পঞ্চাশ মিনিটের পিএইচডি কোয়ালিফায়ার ভাইভায় এরা চারজন মিলে আমাকে যার পর নাই ধুয়ে ফেলেছে। তাদের জ্ঞানগর্ভ প্রশ্নের উত্তরে আধাভাঙ্গা ইংরেজি আর হাত-পায়ের বিচিত্র অংগভঙ্গি দিয়ে নানা কৌশলে যা পারি তা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তবুও মনে হচ্ছে, ওরালটা কি আদৌ পাশ হবে?
রাস্তা এখন ডানে বাঁক নেবে। এরপর মিনিট পাঁচেকের মত পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সোজা নামতে হবে। পথ থেকে মন সরিয়ে নিয়ে নিরপেক্ষভাবে আজকের পুরো ঘটনাটা এখনই বিশ্লেষণ করা দরকার। যত দেরি করব ততই দ্রুত সবকিছু ভুলে যাব আর এবার যদি সত্যিই ফেইল করি তবে এই মূহুর্তের পর্যালোচনা পরবর্তিতে বেশ কাজে আসবে। চিন্তা শুরু করলাম প্রিপারেশনে কি কি কমতি ছিল সেটা থেকে।
প্রথম কমতি হলো ‘সময়’। রিটেনে ফেল করব ধরে নিয়ে ওরালের জন্য আগে থেকে কোন প্রিপারেশন নিইনি। আবার যখন জানতে পারলাম রিটেনে পাশ করেছি তখন আর ওরালের প্রিপারেশন নেবার কোন সময় ছিলনা। তারপরও আমার অ্যাডভাইজার শ্রদ্ধেয় প্রফেসর স্ট্যানকোভিকের উৎসাহে ভাইভা দিতে রাজি হয়ে গেলাম। তার উপদেশ ছিল, ভাইভা দিতে তো কোন দোষ নেই, এক্সপেরিয়েন্স কাউন্টস। সে বলেছিল, আমি বিশ্বাস করি তুমি পাশ করবে। আমি মনে মনে বলেছিলাম, মামা, তুমি বিশ্বাস করলে তো হবেনা, কোন জনমে কি কি সব বুঝে-না বুঝে পড়েছিলাম এসব জিনিস এখন কি করে মনে করব? সে অবশ্য আমাকে পার্সোনাল ইউকলি মিটিংয়ে ভাইভা দেয়ার বেশ কিছু টেকনিক শিখিয়ে দিয়েছিল। দু-একটা টেকনিক পয়েন্ট আকারে এখনো মনে আছেঃ (১) ভাইভায় কিছু না পারলে সরাসরি ‘পারিনা’ বলা যাবেনা। দরকার পড়লে মার্কার পেন দিয়ে বোর্ডে প্রশ্নটাই ছবি এঁকে এক্সপ্লেইন করতে হবে। তারপর ছবিটা দেখিয়ে এ বিষয়ে যদি অন্য কোন কিছুও জানা থাকে তবে সেটা বলা শুরু করতে হবে। এরপর এক সময় স্বীকার করে নিতে হবে যে, আমি পারছি না। (২) ভুল কোন কিছু বলা যাবেনা। যদি নিজের অজান্তে কোন প্রশ্নের উত্তরে ভুল কিছু বলে ফেলার পর পরবর্তিতে বুঝতে পারি যে আমি ভুল বলেছি, তবে সাথে সাথে সেটা স্বীকার করে নিতে হবে। এটাতে নাকি ভাইভা বোর্ড বুঝতে পারে যে ছেলেটা চিন্তা করতে সক্ষম। (৩) সবসময় উদাহরণ দিয়ে এক্সপ্লেইন করতে হবে। উদাহরণ হতে হবে সহজ এবং যেটা আমার নাগালের মধ্যে। ভাইভা বোর্ড সবসময় সম্পূরক প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত থাকে। তাই আগাগোড়া জানা আছে এধরণের সহজ উদাহরণ না হলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনার সম্ভাবনা আছে। এসবের সাথে সাথে সে বইপুস্তক পড়ার পাশাপাশি প্রাকটিস ভাইভার (মক ভাইভা) কথা বলল। ডিপার্টমেন্টে নাকি সিনিয়র ছাত্রদের উদ্যোগে মক ভাইভার সেশন হয়। সে আমাকে তার অন্যতম প্রিয় ছাত্র ও বেশ কয়েকবার ভাইভায় ফেল করা ‘হ্যাংচ্যাং’ এর সাথে কথা বলার পরামর্শ দিল। হ্যাংচ্যাং চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তার জন্য এবারই ভাইভায় পাস করার শেষ সুযোগ। এবার ফেল করলে তাকে ইউনিভার্সিটি থেকে বের করে দেয়া হবে। জানলাম, সে নাকি এ সেমিস্টারে কোন কোর্সওয়ার্ক বা রিসার্চওয়ার্ক নেয়নি ওরালের প্রিপারেশন নেবার জন্য।
স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়েছি। খালিপায়ে হাঁটা শুরু হয়েছে। বৃষ্টিটাও মনে হলো কমে এসেছে। পেছন থেকে একটা মেয়ে খুব দ্রুত জগিং করতে করতে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এ্যাথলেটিক পোষাক পরে ঢালু ফুটপাতে মেয়েটার দ্রুত ও ছন্দময় জগিং দেখে মনে হলো যেন ম্যারাথন দিচ্ছে। আমেরিকার পথে ঘাটে এই দৃশ্য খুবই কমন। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টাই এরা মর্নিংওয়াক করে। একে দেখে থিওরীর প্রফেসর গেইব রবিন্সের একটা কথা মনে পড়ল। গেইব একবার ক্লাসে বলেছিল, হুট করে কেউ ম্যারাথন রেস জিততে পারেনা, এর জন্য দিনের পর দিন প্রাকটিস করতে হয়। ভাইভাটাও নাকি সেরকম বিষয়। এনসাইক্লোপিডিয়া পুরোটা মুখস্থ থাকলেও ভাইভার সময় হাত-পাঁ কাঁপাকাঁপি করবেনা এরকম মানুষ নেই। সেই তুলনায় আমার প্রিপারেশন ছিল আজকে শূন্যের কোঠায়। খুব বেশি হলে পাঁচদিন সময় হাতে পেয়েছিলাম। ভাইভা দেব কি দেবনা এটা ঠিক করতেই প্রথম দুদিন চলে যায়। বই-পুস্তক দেখেই মাথা ঘোরা শুরু করে। হতাশ হয়ে একপর্যায়ে ঠিক করি যে, কিচ্ছু পড়াশোনা করব না। প্রথমবার ভাইভায় ফেইল করতে আপত্তি নাই। আরো দুবছর তো চান্স আছেই। এসব ভাবতে ভাবতে একদিন বিকেলে কফি হাতে এ্যাপার্টমেন্টের লিভিং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। কোত্থেকে এনামুল এসে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেই বলল, ‘ভাইয়া, এটা জানেন নাকি- কোয়াল পাস করলে যে বেতন বাড়ে?’ আমি এরকম একটা কথা আগে কোথায় যেন শুনেছিলাম। ওর কথা শুনে তাৎক্ষণিক ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট ঘেটে আবিষ্কার করলাম কথা সত্য। কোয়ালিফায়ার পাস করতে না পারলে কি হবে এটা নিয়ে ছাত্ররা এত শঙ্কিত থাকে যে এটা পাস করলে যে কোন প্রাপ্তি থাকতে পারে কেউ অতটা তলিয়ে দেখেনা। ওয়েবসাইট ঘেটে জানলাম, পাস করতে পারলে প্রতি মাসে ১০০ ডলার বেতন বাড়বে। আল্লাহর দয়ায় থাকা খাওয়ার খরচের তুলনায় ভার্জিনিয়ার স্কলারশিপের পরিমাণ কম নয়। তারপরও আমার মত গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টের কাছে শ’ডলার বেতন বাড়ার হাতছানিটা বেশ লোভনীয়। প্রথমবারের মত মনে হলো, কঠিন একটা ট্রাই দিতে হবে মনে হচ্ছে।
সিলেবাস বলতে গেলে সম্পূর্ণ ওপেন। পাঁচ সাবজেক্ট থেকে প্রশ্ন করবে বলা হলেও এসবের কোন গ্যারান্টি নেই। ক্যান্ডিডেটকে কম্পিউটার বিজ্ঞানের সবকিছুই জানতে হবে। তিনদিন এত্ত এত্ত সাবজেক্টের বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতেই চলে যাবে, তাই কী পদ্ধতিতে রিভিশান দেয়া যায় বুদ্ধি বের করা শুরু করলাম। অনুমান করে বের করলাম ‘আটলান্টার কোক পদ্ধতি’ এক্ষেত্রে কাজে দিতে পারে। কম সময়ে অনেক কাজ করার জন্য এটা আমার আবিষ্কৃত এক পদ্ধতি। পদ্ধতির উৎপত্তিস্থল হচ্ছে জর্জিয়ার আটলান্টা শহর, সেজন্যই এই নামকরণ। আমেরিকার শত শত বড় বড় শহরের মাঝে যেসব শহর একটু বেশি বড়, আটলান্টা তাদের একটি। রিসার্চের প্রয়োজনে আমাকে একবার আটলান্টার জর্জিয়াটেক ইউনিভার্সিটিতে যেতে হয়। গ্রাম থেকে ঢাকায় আসলে সবাই যেমন মিরপুরের চিড়িয়াখানাটা দেখেই যায়, আটলান্টায় আসলেও তেমনি বিশ্ববিখ্যাত কোকাকোলা কম্পানির বিল্ডিংটায় একবার সবাই ঢু-মারেই। আমিও তিরিশ ডলারের টিকিট কেটে বোকার মত ঢুকে পড়লাম। কোকাকোলা বিল্ডিংটি সত্যিকার অর্থেই এক আজব জায়গা। পুরো বিল্ডিংটাকে এরা মিউজিয়াম বানিয়ে রেখেছে। ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে সাদা পোলার বেয়ারের নাচানাচি, শত বছর আগের কোকাকোলার ইতিহাস, কোকাকোলার বোতলের বিবর্তনের কাহিনী, মিনি কোকাকোলা ফ্যাক্টরি, বিশ্বের সব দেশের কোকাকোলার অ্যাড ও মডেলদের ছবি ও ভিডিও, কোক নিয়ে ফোর-ডি এ্যানিমেশন মুভি ইত্যাদি। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে ৮৮টি ভিন্ন স্বাদের কোকাকোলা ফ্রী-তে চেখে দেখার সুযোগ। কোক-স্প্রাইটের যে এত ভার্সন আছে এটায় আমি বেশ অবাক হলাম। পণ করলাম আজকে এই সবগুলো স্বাদের কোক আমি খেয়েই তারপর যাব। তিরিশ ডলার দিয়ে টিকিট কেটেছি, কম পক্ষে তিরিশ বোতল কোক তো খেতেই হবে আমাকে। বিভিন্ন মহাদেশের জন্য আলাদা আলাদা সেকশানে আলাদা আলাদা কোকের ট্যাঙ্কি রাখা আছে। আমি ইউরোপের দিকে গেলাম। খোদ ইউরোপেই কোক-স্প্রাইট মিলিয়ে এক ডজনের মত ফ্লেভার। দুটি ফ্লেভারের দু-গ্লাস কোক খাবার পর তৃতীয় গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে বুঝলাম আর তো পারছিনা। এখনও আশির ওপর ফ্লেভার বাকি। ঠিক তখনই মাথায় বুদ্ধিটা আসলো। একটা গ্লাস নিয়ে সেটাতেই সব ফ্লেভারের কোক অল্প অল্প করে নিতে থাকলাম। এভাবে করে সব গুলো ফ্লেভার মিলে এক গ্লাসের মত হলো। তারপর এক ঢোকে পুরোটা খেয়ে নিলাম। ব্যস, এখন শান্তি। খেতে খুব একটা ভালো না লাগলেও, দুনিয়ার সবরকম কোক এখন আমার পেটে আছে, এটা ভেবেই শান্তি। কোয়ালের ভাইভার প্রিপারেশানও এই একই ভাবে নিতে হবে। সবগুলো বইয়ের সবগুলো চ্যাপ্টারের ভেতরে বোল্ড অক্ষরে যত সংজ্ঞা আছে আর যত ডায়াগ্রাম টাইপ জিনিস আছে সেগুলো পড়া শুরু করলাম। টানা তিনদিন একাজ করার পর যখন নিজেকে একটু জ্ঞানী জ্ঞানী লাগতে শুরু করলো, তখন বুঝলাম ভাইভার আর মাত্র এক ঘন্টা বাকি।
(বাকি রইলঃ ভাইভা রুমের ঘটনাবলী আর কিছু ব্লুপারস)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:২৬