তোমরা কি আমাকে চিনতে পারছো? আমি অরিত্রি। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো, অরিত্রি অধিকারী। 'অধিকারী' টাইটেলটা এখন আর ভালো লাগে না আমার। একটা সময় অনেক কিছুই অধিকার করে থাকতাম; ভালোবাসার অধিকার নিয়ে কথা বলতাম বাবা-মায়ের সাথে, পিচ্চি বোনটাকে আদর করতাম অধিকারের জায়গা থেকে, শিক্ষকদের সম্মান করতাম ছাত্রীর অধিকারে, বন্ধুদের সাথেও খুনসুটি করতাম অধিকার নিয়েই। কিন্তু এখন আর কিছুই অধিকার করে নেই আমি। সব অধিকার, চাওয়া-পাওয়া, আকাঙখা, হতাশা, আবেগ, অনুভূতি থেকে চলে গিয়েছি অনেক অনেক দূরে।
.
তোমরা যখন মায়ের কোলে মাথা রেখে লেপের নিচে আরামে ঘুমাচ্ছো, আমি তখন আমার বাবা-মায়ের থেকে অনেক অনেক দূরে। তোমাদের মাথার উপরে মেঘ, তারও অনেক উপরে বসে বসে একা একা কাঁদছি। আমার ভীষণ একা লাগছে, জানো? মনে হচ্ছে, সেদিন আত্মহননের পথটা আমার বেছে নেওয়া ঠিক হয়নি। মনে হচ্ছে, আমি যেন হেরে গেছি! আমি তো হেরে যাওয়ার পাত্র ছিলাম না! কত কষ্ট করে দিনরাত খেটে পড়ে দেশের সেরা স্কুল অ্যান্ড কলেজে চান্স পেয়েছিলাম! বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে নিয়মিত ক্লাসে যেতাম, ভালো ফল করার চেষ্টা করতাম। কত স্বপ্ন ছিলো বুকের মাঝে নিজেকে নিয়ে, একদিন অনেক বড় কিছু হবো বলে, সবকিছু শেষ হয়ে গেলো! কেন করলাম আমি এমন? কেন নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না?
.
বিশ্বাস করো বন্ধুরা, আমি মোটেও ভীরু কাপুরুষ নই। আমি এটাও খুব ভালো করে জানি যে আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। কিন্তু আমি আসলে তখন খুব অসহায় বোধ করছিলাম। চোখের সামনে আমার জন্মদাতা বাবা-মায়ের অপমান আমি সহ্য করতে পারিনি। যে বাবা আমাদের দুটি বোনের পড়ালেখার জন্য শত কষ্টেও সবকিছু করতে রাজি ছিলেন, যে মা একা হাতে সংসার সামলে আমাদের বড় করেছেন, আমার এক ভুলের জন্য তাঁদের অমন অপমান আমি সইতে পারিনি। আমি দেখলাম, আমার বাবা-মাকে একবার বসতেও বলা হলো না, চা তো দূরের কথা। রুমভর্তি স্যার-অভিভাবকদের সামনে তাঁদেরকে বাজেভাবে তিরষ্কার করা হলো, যেন আমাকে জন্ম দিয়ে তাঁরা অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছেন! আমাকে নাকি টিসি দিয়ে দেওয়া হবে! এতো কষ্ট করে এখানে কতজনকে পিছনে ফেলে কতটা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে চান্স পেয়েছি! অথচ.. আমাকে এই স্কুল থেকে বের করে দেবে? দিলে আমি কোথায় গিয়ে ভর্তি হবো? সবাই আমাকে দেখে হাসাহাসি করবে। আমি কোথাও মুখ দেখাতে পারবো না হয়তো! এসব ভেবেই..
.
আমার কি দোষ ছিলো, বলতে পারো বন্ধুরা? মানলাম মোবাইল ব্যবহার করা বা সাথে রাখা ঠিক না। কিন্তু দিনকালের যা অবস্থা, আমি একটা হবু ষোড়শী মেয়ে.. মা দুশ্চিন্তা যাতে না করেন, সবসময় যোগাযোগ রাখা যায়, তাইতো মোবাইল! মোবাইল থাকলেই যে সবাই তা দিয়ে নকল করবে বা প্রেম করবে তা কি ঠিক? আমি অন্যায় করেছি পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে, এজন্য স্যারেরা আমাকে বকাঝকা করতে পারতেন, অথবা ফেইল করাতে পারতেন। কিন্তু আমার বাবা-মায়ের কি দোষ? তাদের চোখে জল আমি সইতে পারিনি বন্ধুরা! আমাকেও কি আমার দোষটা বুঝিয়ে বললে আমি শুনতাম না?
.
বন্ধুরা,
আমি চলে আসার পর তোমরা আমার জন্য কেঁদেছো, কাঁদছো, প্রতিবাদ করছো। উপর থেকে দেখে আমার আরও কষ্ট হচ্ছে। তোমরা আমাকে এতো ভালোবাসো জানলে আমি এই পথ বেছে নিতাম না। আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি তো আর ফিরে আসতে পারবো না তোমাদের মাঝে। তোমাদের কারো যেন আমার মতো মরতে না হয় সেই কামনা করি। আমার বাবা-মা আর ছোট বোনটাকে একটু দেখে রেখো। আর যখন তোমরা অনেক বড় হবে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, মন্ত্রী-সচিব, কিংবা প্রিন্সিপাল হবে, তখন সাধারণ, দুর্বল আর অনুজদের প্রতি তোমাদের আচরণ যেন হয় মানবিক। এইটুকুই চাওয়া শুধু তোমাদের কাছে আমার। ভালো থেকো সবাই। ভালোবাসা নিও।
কল্পনাঃ দেব দুলাল গুহ।