মাত্র তিন কিলোমিটার দূরত্বের ব্যবধানে একই পণ্যের দাম ২৫ হাজার ২০০ টাকা কম-বেশি! পান্থপথের বসুন্ধরা শপিংমলে যে শাড়ির দাম ৪০ হাজার টাকা, সেই একই শাড়ি গুলিস্তানের পাইকারি বাজারে ১৪ হাজার ৮০০ টাকা! 'প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৫৬' অনুযায়ী বস্ত্র নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হলেও দাম নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। সরকারি সংস্থা 'জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর' কাঁচাবাজারে কিছুটা সরব হলেও ঈদবাজারে নীরব। 'ফিক্সড প্রাইস'-এর নামে প্রতারণা করা হচ্ছে ক্রেতাদের সঙ্গে।
বসুন্ধরা সিটির চতুর্থতলায় দোকান 'প্রেমজয়'-এ একটি টিস্যু শাড়ির দাম চাওয়া হলো ৪২ হাজার টাকা। এটি একদরের দোকান। কিন্তু সকালবেলার ক্রেতা বলে কিছুটা 'সম্মান' করার প্রস্তাব দিলেন বিক্রেতা। কতটা সম্মান করা হবে? এ প্রশ্নে জানালেন, দুই হাজার টাকা 'সম্মান' করবেন। এই শাড়ি কিছুতেই ৪০ হাজার টাকার কমে দেওয়া সম্ভব নয়। বিক্রেতা এটি বলে ক্রেতার সঙ্গে আর কথা বাড়ালেন না।
ক্রেতারূপী এই প্রতিবেদক একই শাড়ির খোঁজে মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে যান গুলিস্তানের বঙ্গবাজারের পাইকারি বাজারে। ভারত থেকে আমদানি করা একই টিস্যু শাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল। একই রঙ এবং একই নকশা। এখানে মূলত পাইকারি দরে শাড়ি বিক্রি করা হয়। তবে খুচরাও বিক্রি হয়। গুলিস্তানের অন্যতম বৃহৎ শাড়ির পাইকার নজরুল ইসলামের দোকানে সেই শাড়িই বিক্রি হচ্ছে ১৪ হাজার ৪০০ টাকায়।
ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯ সালের ৩৮ ধারা অনুযায়ী পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রিত করার কথা বলা হয়েছে। পণ্যের গায়ে লেখা দামেই বিক্রি করতে হবে। তবে অযৌক্তিক দাম নির্ধারণ করা যাবে না। তবে এসব নিয়ম শুধু কাগজে-কলমে। বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। কে কত বেশি দাম রাখতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে শপিংমলগুলোতে। অভিজাত মার্কেটগুলোতে এক হাজার টাকার পণ্য চার হাজার টাকা, তিন হাজার টাকার পণ্য আট হাজার টাকা দাম লিখে রাখা হয়েছে। এমনই চিত্র দেখা গেল সরেজমিনে।
রাজধানীর ইসলামপুরে মেয়েদের থ্রিপিসের পাইকারি বিক্রেতা শামিম বস্ত্রালয়ের স্বত্বাধিকারী মো. শামিম জানান, বড় শপিংমলের বিক্রেতারা ইসলামপুর থেকেই থ্রিপিস কিনে নেন। এবারের ঈদের চাহিদার শীর্ষে 'কিরণমালা' থ্রিপিসের কিছু ভারত থেকে আমদানি করা, কিছু দেশীয় বাজারে তৈরি। ভারত থেকে আমদানি করা কিরণমালার গড়পড়তা দাম ৭০০ থেকে ২০০০ টাকা। সেই একই থ্রিপিস অভিজাত বিপণিবিতানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে চারগুণ বেশি দামে।
কেন এত দামে বিক্রি করা হয়? নামিদামি বিপণিবিতানগুলোর কোনো বিক্রেতাই এর 'রহস্য' খুলে বলেন না। কারণ জানালেন ইসলামপুরের ক্রেতা ও ময়মনসিংহের 'জিরোপয়েন্ট' ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী ফুয়াদ হাসান। তিনি জানান, সারা বছরের মুনাফা রোজার ঈদে করে নেন পোশাক বিক্রেতারা। এ কারণেই ঈদে এমন উচ্চদাম থাকে। ঈদের পোশাক, তাই ক্রেতাদেরও খরচ করার মানসিকতা থাকে। সেটাকেই কাজে লাগান বিক্রেতারা। ফুয়াদ হাসান জানান, একজন দোকানি ঈদের সময় সারা বছরের দোকান ভাড়া, কর্মচারী খরচ ও মুনাফা করে নেন। বিক্রেতাদের এই মানসিকতার কারণে দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে।
গতকাল মঙ্গলবার বসুন্ধরায় ছেলেদের পোশাকের দোকান 'ওয়েস্টার্ন'-এ একটি পাঞ্জাবির দাম লেখা ছিল ৬ হাজার ৬০০ টাকা। এই প্রতিবেদক দাম জানতে চাইলে বলা হয়, যা লেখা আছে তাই। বসুন্ধরার নিচতলার আরেক দোকান মালিকের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে দিলে সেই পাঞ্জাবিরই দাম চাওয়া হয় চার হাজার টাকা। এমনটিই একদরের দোকান! দোকানের কর্মী মুরাদ হোসেনের কাছে কারণ জানতে চাইলে বলেন, সমিতির লোকদের কেনা দামে দেওয়া হয়। এক ধাক্কাতেই দাম কমে যায় দুই হাজার ৬০০ টাকা। এই বিক্রয়কর্মীর কথা সত্য হলে, একটি পাঞ্জাবিতেই মুনাফা করা হয় ক্রয়মূল্যের প্রায় ৬০ শতাংশ। যেখানে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মুনাফার নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে সেই নিয়মের কোনো প্রভাব নেই বাজারে।
এসব বিষয়ে জানতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল হোসেন মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রির নিয়ম থাকলেও, দাম কী হবে তা বিক্রেতারাই নির্ধারণ করেন। এ কারণেই অধিদপ্তরের কিছু করার থাকে না।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, 'ক্রেতাকেই সচেতন হতে হবে। এ ছাড়া আর উপায় নেই। বাইরে থেকে এসে কারও পক্ষে তো দাম নির্ধারণ করে দেওয়া সম্ভব নয়।'
বসুন্ধরায় পিংকি স্টোরে বাচ্চাদের 'ফ্লোর টাচ' পোশাকের গায়ে দাম লেখা আছে চার হাজার টাকা। ধানমণ্ডির রাইসা ইসলাম তার মেয়ের জন্য দরকষাকষি করে পোশাকটি কিনে নিলেন আড়াই হাজার টাকায়। একই দোকানে বনানীর পিপা হোসেন 'ফিক্সড প্রাইস' ট্যাগ দেখে চার হাজার টাকাতেই আরেকটি পোশাক কিনলেন। একদাম লেখার পর দরদাম করার ব্যাপারে জানতে চাইলে পিংকি স্টোরের ম্যানেজার শফিউল্লাহ বলেন, কিছু করার নেই, দাম বেশি না হলে ক্রেতা আকর্ষণ করানো যায় না। তাই দাম বেশি লিখে রাখা হয়। দাম কম হলে ক্রেতা ভাবে জিনিস ভালো না। তাই কাপড়ের দাম বেশি লেখা হয়।
রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, প্রকৃত মূল্যের চেয়ে তিনগুণ-চারগুণ বেশি লিখে ট্যাগ ঝোলানো হয়েছে। বড় বড় মার্কেট থেকে শুরু করে ফুটপাতের পণ্যেও 'একদাম' ট্যাগ লাগানো। এমন দোকানের কয়েকটিতে একদাম লেখার পরেও দরদাম করতে দেখা যায়। ক্রেতাদের অভিযোগ, একদাম লেখা পণ্যগুলোতে যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে সেই একই পণ্য অন্য দোকানে আরও কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
বসুন্ধরার অধিকাংশ দোকানে ঈদ উপলক্ষে 'বিশাল ছাড়' দেওয়া হয়েছে। তা এক প্রতারণা। সরকারি চাকুরে মকবুল হোসেন জানান, মাসখানেক আগে এই মার্কেটে যে পণ্যের গায়ে ৫০০ টাকা লেখা ছিল, সেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করে ৫০ শতাংশ ছাড়ে ৫০০ টাকাতেই বিক্রি করা হচ্ছে।
আবদুল্লাহ আল রিফাত ধানমণ্ডির রাপা প্লাজার একদামের দোকান থেকে জুতা কিনেছেন ১২০০ টাকা দিয়ে। একই জুতা সায়েন্সল্যাবের মার্কেটগুলোতে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে দেখে ক্ষুব্ধ হন। তিনি জানান, একদামে বিক্রি করা খারাপ না। সেক্ষেত্রে ঝামেলা কম থাকে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই মাধ্যমটাকে প্রতারণার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন। একদাম বললে ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম করার প্রয়োজন হয় না এবং সে সুযোগে পণ্যের গায়েও অতিরিক্ত দামের ট্যাটু লাগিয়ে দেওয়া যায়। গাউসিয়া, নিউমার্কেট, চাঁদনী চকের অধিকাংশ দোকান ফিক্সড প্রাইসের। তবে এমন কোনো দোকান পাওয়া যাবে না, যেখানে দরদাম চলে না। সমকাল
তথ্যসু্ত্র: http://www.bdlive24.com/