বীরাঙ্গনা নয়, মুক্তিযোদ্ধা > স্বাধীনতার জন্য ইজ্জত হারাইলাম, পাইলাম না কিছুই : নাজমা বেগম শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫ কাগজ প্রতিবেদক:
‘স্বাধীনতার জন্য ইজ্জত হারাইলাম, স্বজন হারাইলাম। কিন্তু অপমান ছাড়া কিছুই পাইলাম না। একটু সাহায্যের জন্য যে যেখানে বলেছে, দৌড়াই গেছি। কিন্তু কিছুই পাই নাই। ৪৪ বছর ধইরা বস্তিতে পইড়া রইলাম, দেখার কেউ নাই!’ কেমন আছেন জানতে গিয়েছিলাম নাজমা বেগমের মিরপুরে মিল্কভিটা বস্তিতে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভোরের কাগজের সঙ্গে এভাবেই তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। নাজমা বেগম জানান, সপ্তাহে ১ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এসব জোগাতে গিয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এ অবস্থায় বাঁচতে চান না তিনি। সেই উত্তাল দিনের স্মৃতিচারণ করে নির্যাতিত এই মা চোখের জলে ভাসতে থাকেন। বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসের উত্তাল এক ভয়ঙ্কর রাত। জ্যৈষ্ঠ কী আষাঢ় মাস হবে। আমার তখন ১৮ বছর বয়স। ঠাকুরমার কাছে বসে গল্প শুনছিলাম। হঠাৎ শুনি চারদিকে গুলির আওয়াজ আর কান্নার রোল। বুঝলাম, আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। দেখি আমাদের ঘরেও পাকিস্তানি আর্মি ঢুকে পড়েছে। ঢুকে কথাবার্তা ছাড়াই বাবা-মাকে বেধড়ক মারতে শুরু করল। একজন পাকিস্তানি সেনা আমার মুখের দিকে চেয়ে দাঁত কেলিয়ে বিশ্রীভঙ্গিতে হাসছিল। আমি ভয়ে ঠাকুরমাকে জড়িয়ে ধরলাম। লোকটা ঠাকুরমার কাছ থেকে আমাকে টেনে নিতে চাইল। ঠাকুরমা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আর চিৎকার দিয়ে বলল, ‘ওরে ছাইড়া দে শয়তান।’ কিন্তু ছাড়েনি। পাকিস্তানি হানাদাররা দাদির কাছ থেকে আমাকে চিলের মতো ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে লাথি মেরে অনেক দূরে ফেলে দেয়। তারপর আমার চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে আমাদের গ্রাম থেকে নিয়ে যায় আধা মাইল দূরে পাকিস্তানি বাহিনীর দিগনগর ক্যাম্পে। যাওয়ার আগে আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। চিৎকার করে মাফ চাইলাম, ছেড়ে দিতে বললাম। ওদের দয়া হলো না। উল্টো মজা করছিল। ক্যাম্পে হাত বেঁধে আমার ওপর চলল পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন। কখন যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। জ্ঞান ফিরে আসার পর মনে হলো, এর চেয়ে মরে যাওয়াই তো ভালো ছিল। ছেঁড়া এক প্রস্থ কাপড়ই ছিল ভরসা। যত দিন বন্দি ছিলাম গোসলও করতে দেয়নি। একটা ঘরের মধ্যে গরু-ছাগলের মতো গাদাগাদি করে আমাদের রেখেছিল। আর ওই ঘরে আমি ছিলাম সবার ছোট। খাবার বলতে শুকনো রুটি আর একেক সময় শুকনো ভাত দেয়া হতো। ক্ষুধার জ্বালায় বেহুঁশের মতো, তাই না খাইয়া বেঁচে ছিলাম। মাঝে মাঝে ভাবতাম, আত্মহত্যা করে জীবনটা শেষ করে দিই। কিন্তু সেই সুযোগ পাইনি। কারণ একজন শাড়ি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করার পর থেকেই পাকিস্তানি আর রাজাকাররা আমাদের চোখে চোখে রাখত। মাস খানেক পর মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পটি দখল করে উদ্ধার করে আমাদের। তখন আমি গুরুতর অসুস্থ, বলতে গেলে মরা মানুষ। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে গেলে আমার পরিবারের লোকজন স্পষ্ট বলেছে, ‘এই মেয়েকে আমরা আর গ্রহণ করব না। ওকে গ্রহণ করলে সমাজ আমাদের তাড়াইয়া দেবে। আপনারা উদ্ধার করে আনছেন, আপনারাই একটা ব্যবস্থা করেন।’ তখন মুক্তিযোদ্ধা ভাই আবদুল হাকিম, আবু বকর মাতব্বর, ওয়ারেশ ফকির এরা আমাকে নিয়ে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস ফকির আর হারুন ফকির আমাকে ধর্মের বোন ডাইকা আশ্রয় দিলেন। তাদের ক্যাম্পে নিয়ে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুললেন। ভাবলাম দেশের জন্য মান গেল, ইজ্জত গেল, বলতে গেলে জীবন লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল। এখন দেশের জন্য জীবনটা গেলেও আর কোনো দুঃখ নেই। এইটা মনে কইরা যুদ্ধে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ট্রেনিং নিলাম গোপালগঞ্জের বাইনাচরের বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিনের কাছ থেকে। সেখানে গুপ্তচরের কাজ থেকে শুরু করে ভাত রান্না করেছি, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেছি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালনা এবং গ্রেনেড ছোড়ার কঠিন কৌশলও শিখেছি। এর পর সরাসরি যুদ্ধে থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালিয়ে অপারেশন করেছি। আসলে ট্রেনিং নেয়ার পর থেকে বুকে অন্য রকম সাহস এসেছিল। আমার এই জীবনের তো মানে শেষ। তাহলে গুলি খাইয়া আর কি শেষ হইব! বুকের ভেতরে অপমানের জ্বালাও ছিল অনেক (কান্না)। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু আমার তো কোনো আশ্রয় নেই! তখন আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের অনুরোধে স্বাধীনতার মাস খানেক পরে আমাকে বিয়ে করেন মুক্তিযোদ্ধা মোশারেফ শেখ। তিনিও ৮ নম্বর সেক্টরে হেমায়েত বাহিনীর হয়ে সরাসরি যুদ্ধ করেছিলেন। আমার ধর্ম ভাইয়েরা তাদের বাড়িতে রেখে আমাকে বিয়ে দেন। আমার নাম ছিল কাননবালা বণিক। বাবা জগদীশ বণিক। মা চারুবালা বণিক। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আমার নাম হয় নাজমা বেগম। আমাকে বিয়ে করার অপরাধে আমার স্বামীকে তার বাবা-মা আত্মীয়স্বজন সবাই ত্যাগ করেছে চিরদিনের জন্য। কিন্তু তিনি আমাকে ত্যাগ করেননি। আমাকে কেউ একটু বাজে কথা বললে তার মাথায় আগুন ধইরা যায়। তিনি একেবারে সহ্য করতে পারেন না। এর পর শুরু হয় আমাদের আরেক যুদ্ধ। কঠিন জীবনযুদ্ধ। স্বামীর পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে ১৯৭২ সালে স্বামী-স্ত্রী চলে আসি ঢাকায়। এখন এক কন্যাসহ চার সন্তান নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বরের ৬ নম্বর ওয়াপদা বিল্ডিংয়ের পেছনে একটি বস্তিতে আছি (এটাকে মিল্কভিটা বস্তিও বলে)। ৪৪ বছর ধরে এ বস্তিতে খেয়ে-না খেয়ে জীবনযাপন করছি। স্বামী ঢাকায় প্রথম ঠেলাগাড়ি ঠেলত, ইট ভাঙত, রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগালির কাজ করত। এখন হকারি করে। আর আমি ঝুট বাছাইয়ের কাজ করি। এ কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। নানা রকম রোগবালাই বাসা বেঁধেছে শরীরে। চোখে ছানি পড়েছে। ঠিকমতো দেখতে পাই না। কদিন আগে যায় হাসপাতাল থেকে ফিরলাম। সেখানকার নানা বিড়ম্বনার কথা আরেক দিন বলব। আমার স্বামীও অসুস্থ। এ বয়সেও বোঝা নিয়ে ফেরি করে বেড়ায়। খুব কষ্ট হয় তার। একদিন কাজ করলে দুদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। বাঁচার জন্য এত লড়াই আর ভালো লাগছে না। এর পরও ধার-দেনা করে এক ছেলেকে এইচএসসি পাস করিয়েছি। বঙ্গবন্ধু কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ার পর অর্থের অভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে পারিনি। ছোট ছেলেটাকেও মিরপুর উপদন স্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছি। মেয়েটাকে আইএ পাস করিয়েছি। খাওয়া-পরার পাশাপাশি ওদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে গিয়ে দিশেহারা লাগে। কোনো সহযোগিতা পেলে হয়তো তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার সাহস করব। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার নাম সরকারের তালিকায় আছে, অবশ্য ওই সনদ পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৫ বছর! সনদ পাওয়ার পর তো ভাতা পেতে পারতাম। থাকার জায়গা পেতে পারতাম। পেলাম না তো! অনেকে নাকি পাচ্ছে! ‘স্বাধীনতার জন্য ইজ্জত হারাইলাম, স্বজন হারাইলাম। কিন্তু অপমান ছাড়া কিছুই পাইলাম না। একটু সাহায্যের জন্য যে যেখানে বলেছে, দৌড়াই গেছি। কিন্তু কিছুই পেলাম না।’ একবার সরকার থেইক্যা ১০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। প্রশিকা থেকে এককালীন ভাতা হিসেবে তিনবার তিন হাজার টাকা করে পেয়েছি। একটু ভালো করে বাঁচার আশায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে আমি আর আমার স্বামী অন্তত ১০ বার আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ভাবছি আর করব না। শেষ আবেদন করলাম ২০১০ সালের ৩ ডিসেম্বর। শুনেছি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অনেক দয়াবান। মানুষের দুঃখে পাশে দাঁড়ান। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করতে পারছি না। দেখা হলে একটা কথাই বলতাম, ‘আমাদের কী অপরাধ ছিল! আজ আমরা কেন পথের ভিখারি? তিনি আমাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিয়েছেন জেনে অনেক কষ্টের মাঝেও খুশি লাগছে। তারপরও মনের কষ্টে মাঝে মাঝে ভাবি- দেশ স্বাধীন হয়ে লাভ কী হলো? আমরা কি এমন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম? কেউ পথে পথে ঘুরছে, কেউ বিল্ডিংয়ে থাকছে। এটা তো উচিত বিচার হচ্ছে না! এখন নতুন নতুন রাজাকারে ভরে গেছে দেশ। তার পরও যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে এতে অনেক খুশি লাগছে। যা বলে বুঝাতে পারব না। কিন্তু দু’একজনের করলে হবে না। সবাইকে ধরে ধরে ফাঁসি দিতে হবে। এখানে আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে, ওরা আমাদের পছন্দ করে না। বলে, অমন মুক্তিযোদ্ধা পথেঘাটে পইড়া রইছে। এত অপমানের পরও তবু এখনো স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করে কেন বুঝি না। নতুন মানুষ যারা দুনিয়াতে আসবে, তারা যেন সুখ-শান্তি নিয়ে বাঁচতে পারে সে জন্য মনে হয় এই স্বপ্ন। পরিচিতি : নাজমা বেগম গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার জলিরপাড় গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। সেখানে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরে হেমায়েত বাহিনীর অধীনে যুদ্ধে অংশ নেন। বর্তমানে তিনি মিরপুর-১০-এর ঝুটপট্টির ৬ নম্বর ওয়াপদা বিল্ডিংয়ের পেছনে মিল্কভিটা বস্তিতে থাকেন। তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর গোপালগঞ্জ প্র:৩/৭/২০০২/৩৪১৪; ম-১২৩৮৬৫)।
া
- See more at: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:৩৬