লাইভ ভিডিওতে এসে নিজের হাতে স্ত্রী’কে বারংবার কুপিয়ে হত্যা, অসুস্থ মা’কে সন্তানরা গোপনে জঙ্গলে ফেলে আসা, জীবন্ত মানুষের একটা পা কেটে বিজয় মিছিল করা কিংবা অসহায় মানুষের রিলিফের খাদ্য বা টাকাপয়সা লুটপাট করা ইত্যাদি খবরগুলি আমাদের মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে এখন সহসাই প্রশ্ন তুলছে! দিন দিন এইসব নৃশংস কর্মকান্ডগুলি দেখে আমাদের অবাক হবার ক্ষমতাও লোপ পাচ্ছে আর বাড়ছে বিষ্ময়ের মাত্রা! আসলে আর কী ঘটতে বাকি আছে এই দেশে? মনুষ্যত্ববোধ একদমই হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষগুলোও যেন দয়ামায়াহীন নিষ্ঠুর হয়ে পড়ছে। বর্বরতা যেন মহামারির আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, গুমসহ নানামুখী অপকর্মের শিকার প্রতিনিয়তই হতে হচ্ছে এইদেশের মানুষ'কে। ক্রমাগত এইসব নৃশংস ঘটনাগুলি দেশের মানুষের জন্য বইয়ে নিয়ে আসছে যেন অশনি সংকেতের সুতীব্র স্রোত। ইঙ্গিতের মধ্যে দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে মানুষের পাশবিক হিংস্রতার সুতীব্র উত্থানের!
.
এই সৃষ্টিজগতে মানুষ শুধুমাত্র নৈতিক মূল্যবোধের জন্যই অন্যসব প্রানীদের থেকে পৃথক। এই নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, লক্ষ্য/উদ্দেশ্য, সংকল্প, আচার-আচরণ এবং কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজের বেশিরভাগ মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অবনতির সমষ্টিগত নাম হলো সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। নৈতিক মূল্যবোধ’কে মানুষ থেকে পৃথক করলে, তখন শুধুই প্রানীর বৈশিষ্ট্য থাকবে; কিন্তু মনুষ্যত্ব বলে কোন বৈশিষ্ট্যই আর থাকে না।
.
নৈতিকতা হলো নীতিবোধ ও মানবীয় গুণাবলির জীবন দর্শন। মানবজীবন’কে সুপথে ভালোকাজে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নৈতিকতা হলো পাথেয়। নৈতিক মূল্যবোধ এবং মনুষ্যত্ব একটি অপরটির পরিপূরক। অথচ এইদেশে এখন শুরু হয়েছে ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতির অবাধ চর্চা। জঙ্গলের পশু সমাজের এই বৈশিষ্ট্য কোনোভাবেই মানবীয় বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। সর্বত্রই আজ অনৈতিকতার ছড়াছড়ি, মানবিক মূল্যবোধের নিদারূণ অবনতি। এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠছে মানবীয় বৈশিষ্ট্যহীন আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, অসহিষ্ণু, নৈতিকতা বিরোধী এক একটা যন্ত্রমানব হিসেবে। দুঃখজনক হলেও সমাজে এখন মানুষের চাইতে অমানুষের সংখ্যাই বেশি!
.
মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারার তিনটি স্তর; শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য। এর মধ্যে অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার এই যুবসমাজই দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের কর্ণধার। তারাই দেশ ও জাতির সম্পদ। কিন্তু এই যুব সমাজের নৈতিকতার অবক্ষয়ই সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এই অবক্ষয়ের RCA বা Root Cause Analysis যদি করা হয় তাহলে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে, এই যুবসমাজের নৈতিক অধঃপতনের প্রধানতম কারণ হ’ল সঠিক শিক্ষার অভাব। এই শিক্ষা আসে শুধুমাত্র দুইটা স্তর থেকে।
.
একঃ
আমরা আমাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেই, কিন্তু কয়জন ছেলেমেয়েদের’কে প্রকৃত মানুষ বানানোর চেষ্টা করি? পরিবার হলো প্রতিটা শিশুর শিক্ষার সূতিকাগার, প্রথম পাঠশালা। সততা, কর্তব্য পরায়নতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলী শিশুরা পারিবারিকভাবেই শিখে আসে। প্রতিটা পরিবার যদি নৈতিকতা চর্চার কেন্দ্র ও পরিশোধনাগার হয়ে ওঠে, তবে সমাজ থেকে অনেক অপরাধের চিরতরেই নির্বাসন সম্ভব। সমাজে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকার উপর গুরুত্বারোপ করা দরকার। নৈতিকতার শিক্ষা শুধু বক্তৃতায় আর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করলেই হবে না, বরং এগুলো পারিবারিক অনুশীলনের মাধ্যমে প্রতিটা শিশুর আচরণেই যুক্ত করা প্রয়োজন। অনেক পরিবারেই দেখা যায়, ছেলেমেয়েরা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে না, তারা কোথায় রাত কাটায়, কখন বাড়ী ফেরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখন যায় আসে, সেগুলোর ব্যাপারে কোন খোঁজখবর রাখে না। সন্তানকে ছোটবেলা শাসন করতে বললে তারা বলে, বড় হলে ভালো হয়ে যাবে। আবার বড় হলে বলে, তারা আমাদের কথা মানে না, এখন তাদের সাথে পারি না ইত্যাদি। পারিবারিক অনুশাসন ছোটবেলাতেই করতে হয়। ভালো বীজই যদি না লাগানো হয় তাহলে ভালো ফসল আসবে কিভাবে?
.
দুইঃ
দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল স্তম্ভ হলো তিনটি। শিক্ষক, ছাত্র ও পরিচালনা কমিটি। দলীয় রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলে এই তিনটি ক্ষেত্রই আজ নোংরা এবং ক্লেদাক্ত হয়ে গেছে। সর্বক্ষেত্রে দলীয় দিকই এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয়। আগে শিক্ষকগণ ছিলেন সবার অপরিসীম শ্রদ্ধার পাত্র। অথচ এখন এরাই নিজদলীয় ছাত্রদের ভাই ও বন্ধুর পর্যায়ে নেমে এসেছেন। বিরোধীমতের ছাত্র ও শিক্ষকগণ প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে পরস্পরের বিরোধী হিসাবে গণ্য হন। অথচ মহান দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, “শিক্ষা হলো মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের আবিষ্কারক। সত্য ও সুন্দরের পথ যারা দেখান তারাই হলেন শিক্ষক”। মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির নিপুণ শিল্পী হলেন শিক্ষক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে শিক্ষার পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ চর্চার অনন্য কারখানা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধের চর্চা তেমন নেই বললেও চলে। শিক্ষকতার সঙ্গে নৈতিকতা ও সততার বিষয়টি গভীরভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক যদি নৈতিকতা ও সততার ভিত্তিতে গড়ে না উঠে তাহলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতেই আজ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এত বেহাল দশা!
.
.
শেষ কথাঃ
আজ আমরা নৈতিকতার দিক দিয়ে চরমভাবে ধ্বংসের মুখে। ক্ষয়িষ্ণু এই সমাজের ভয়ংকর অবক্ষয়ের বিভিন্ন চিত্র
দেখেও আমরা এখন আর অবাক হচ্ছি না। সবারই চোখের সামনে এইসব ঘটনাগুলি ঘটছে, কিন্তু বিবেকের দরজা খুলে কেউ আসল সত্য উপলব্ধি করছে না। আসলে একটি সমাজ অবক্ষয়ের দিকে দ্রুত ধাবিত হয়, যখন সমাজের মানুষগুলোর বিবেকের সামনে মোটা কালোপর্দা ঝুলে যায়। একসময়ের বিবেকবান মানুষগুলো ধীরে ধীরে চরমভাবে বিবেকহীনতার পরিচয় দেয়।
.
সোসাল মিডিয়াতে এখন দেশের সবজায়গা থেকেই চাল চোর/রিলিফের সামগ্রী চোর/তেল চোর ইত্যাদি বিভিন্ন চোরদের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। এর অর্থ হলো, সামাজিক অবক্ষয় এখন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পরেছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের উপায় হলো সামাজিক নৈতিকতার আত্মশুদ্ধি, যা একমাত্র সমাজের প্রতিটা মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের আত্মশুদ্ধি ছাড়া কখনই সম্ভব না।
.
কবি ফররুখ আহমেদ বলেছিলেন, “রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী?”
.
কবি বেঁচে থাকলে এখন বলতাম, “রাত আর পোহাবে না পাঞ্জেরী, যদি আমরা নিজেরাই না জাগি!“
.
এই দেশে কোনদিনও হ্যামিলনের বাঁশীওয়ালার মতো কেউ আসবে না, যতদিন পর্যন্ত আমরা নিজেরা ভালো না হচ্ছি।
.
.
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
জনস্বার্থে – নীল আকাশ@সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, গ্রুপ এবং ফেসবুকের নিজস্ব পাতায় একযোগে প্রচারিত
কপিরাইট @ মহিউদ্দিন মোহাম্মাদ যুনাইদ, এপ্রিল ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:২৩