-কি দাদা, খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে? হন্তদন্ত হয়ে সারা অফিসে ছুটে বেড়াচ্ছেন?
-সে আর বলতে! ছুটতে ছুটতে আপনার কাছেও চলে এসেছি।
দুলালবাবু হাসিমাখা মুখে কথাটা বলেই দুইহাত তুলে প্রণাম করে আমার দিকে ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিলেন। খুলে দেখলাম, বিয়ের কার্ড।
-বিয়ের দাওয়াত দিচ্ছি সবাইকে। আমার ছোট ভাইয়ের। আগামী পরশুদিন রাতে কোষ্ঠীতে লগন মিলে গেছে। ছোটটা থাকে ইতালীতে। মাত্র কয়েকদিনের ছুটিতে এসেছে। এত অল্পসময়ে সবকিছু ম্যানেজ করতে যেয়ে আমার বারোটা বেজে গেছে। তাও ভগবানের কৃপায় সবকিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হলেই আমি খুশি।
-মেয়ে কি করে?
-লালমাটিয়া কলেজ থেকে এবার অর্নাস ফাইনাল দিল ইকোনমিক্সে।
দুলাল বাবু অফিসে আমার উল্টোদিকের টেবিলে বসেন। সরকারী অফিস। কাজের চাপ কম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুখদুঃখের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভালোই আড্ডা দেয়া হয়। দাদা আর বৌদি দুইজনের সাথেই খুব ভালো সম্পর্ক আমার। দাদা আমার পাশে বসে মেয়ের পরিবারের বিয়ে বিষয়ক সবকিছু গড়গড় করে বলতে লাগল। এখনও বিয়েই করিনি, আর তাই বিয়ে বিষয়ক কথাবার্তা শুনতে এখন বেশ ভালোই লাগছে। তাই দারুন আগ্রহ নিয়ে সব শুনছি। সবকিছু বলা শেষ হলে মেয়ের ছবি মোবাইলে বের করতে করতে বললেনঃ
-মেয়ে তো নয় যেন প্রতিমা, সাক্ষাৎ দেবী দূর্গা। একবার দেখলেই চোখ ফেরানো যায় না। এই দেখুন প্রদীপ বাবু!
দুলাল বাবু বেশ আগ্রহ নিয়ে মোবাইলটা আমার হাতে দিয়ে বলল, পানচিনির অনুষ্ঠানে বৌদি নিজের হাতেই তুলেছেন। মেয়ের ছবি দেখেই চমকে উঠে দাদার কাছে মেয়ের নাম জানতে চাইলাম।
-পরমা। ভালো নাম শ্রীমতি পরমা মুখার্জি।
হায় ভগবান! নামটা শুনেই আমার মাথা খারাপ অবস্থা! দ্রুতই মোবাইলে বাকি ছবিগুলিও ভালো করে দেখতে শুরু করলাম। হাত ইতিমধ্যেই কাঁপতে শুরু করেছে। পরমাকে নিয়ে আমার হৃদয়ে জমানো সব স্বপ্নগুলো যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো হয়ে গেল। সমুদ্রের ঢেউগুলো যেমন সৈকতে আসার আগেই নিঃশেষিত বেগে বিলীন হয়ে যায়, তেমনি আজ নিষ্ঠুর এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে সেই স্বপ্নগুলোও যেন হুট করেই অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলল। এর পরের চারটা ছবি দেখার পর মুহুর্তেই হারিয়ে গেলাম ফেলে আসা মাত্র একমাস আগের এক ভালোলাগাময় স্মৃতিতে......
এক
সাদা জমিনের উপর লাল সবুজ জামদানীর কারুকাজ করা লাল পাড়ের শাড়িতে মেয়েটাকে দেখতে কি যে সুন্দর লাগছে! লম্বা হাতাওয়ালা কুঁচি দেওয়া বাহারি লাল ব্লাউজটা যেন অন্যরকম একটা সৌন্দর্য্য এনে দিয়েছে শাড়ির সাথে। বড় করে সাজানো খোঁপাটা গাজরা ফুলের মালা দিয়ে আরও চমৎকার করে সাঁজিয়ে রেখেছে। কানের পাশে গুঁজে দিয়েছে কয়েকটা রক্তলাল গোলাপফুল। দূর থেকে মনে হলো কানে আর গলায় অ্যান্টিক ধাঁচের গয়নাও পড়েছে। এই তো সেদিন অফিসের এক সদ্য বিবাহিত কলিগ একঘন্টা মোবাইলে ছবি সহকারে এই বিষয় ব্যাপক জ্ঞান দান করল। তখন বেশ বিরক্ত লাগলেও এখন বুঝলাম জ্ঞান বেশ ভালোই অর্জন করেছি। একটু দূর থেকেও প্রায় সবকিছুই চিনতে পারছি। অফিসে যেয়েই দাদাকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিয়ে এককাপ চা খাওয়াতে হবে। মেয়েটা চপলা হরিনীর মতো আমার চোখের সামনেই সবজায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে দেবরাজ ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যেমন অপ্সরা মেনকা'কে পাঠিয়েছিলন, ঠিক তেমনি আমার নিরানন্দময় এই নিঃসঙ্গ জীবনেও যে বৈচিত্র্য আনা দরকার সেটা বুঝানোর জন্যই ভগবান একে আমার সামনে পাঠিয়েছেন।
আজ দূর্গাপূজার মহানবমী। আমি এসেছি বাসা থেকে একটু দূরের একটা বড় মন্দিরে পূজার মন্ডপে পূজা দিতে। দূর্গাপূজায় কোন অবিবাহিত ছেলেমেয়েই শুধু পূজা দিতে আসে না। আর তাই মন্ডপের কাছে একে দেখার পরেই মনে হলো কিসের পূজা আর কিসের কি? মেয়ের কাছ থেকে তো আমি এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারছি না। একবার দেখেই বুকের ভিতর ঢাক গুরগুর অবস্থা! গুরগুর বেড়ে গেলে পরিচিত বেশ কয়েকজনকে ডেকে এনে মেয়েটাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেসও করলাম, কেউ চিনে না। এতদিন তো জানতাম সরস্বতী পূজায় প্রণয়ের হাওয়া লাগে গায়ে, কিন্তু এবার তো দেখি দূর্গাপূজায় আমার মরি মরি অবস্থা! গায়ে পড়ে প্রথমেই কথা বলতে ঠিক সাহসও পাচ্ছি না। হাত দুইটা ভালো মতো আগে দেখে নেই। শাঁখা পড়া থাকলে সাড়ে সর্বনাশ! সাতপাকের এই বাঁধন আমি শত সহস্র বার চেস্টা করলেও ভগবান নিশ্চয়ই খুলতে দেবেন না.....
সাহস করে একবার সামনে এগিয়ে যেয়ে মেয়ের দুইহাত খুব ভালো করে দেখে নিলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাসটা বড় হয়ে বের হয়ে যেতেই বুক থেকে পাষান পাথরটাও নেমে গেল। যাক বাবা, ভগবান অন্ততঃ এইবারের জন্য হলেও আমাকে কৃপা করেছেন। ফর্সা দুইহাতে শুধুই এক গোছা করে লাল কাঁচের চূড়িগুলি যেন ওর হাত দুইটার সাথে আমার মনটাও রাঙ্গায়িত করে তুলল। মেয়ের সাথে কথা বলতে হবে, অতি দ্রুত, কিন্তু কিভাবে? ভেবে কোন কূলকিনারই করতে পারছি না। এতগুলি লোকজনের মধ্যে ডেকে যে আনব নামটাও তো জানি না। কাছে যেয়ে ডাক দিয়ে আসতে বলার পর যদি সবার সামনেই মুখের উপর না বলে দেয়, তখন পরিচিতদের কাছে মুখ দেখাব কিভাবে? কিন্তু আমি নিজেও আছি মহা বিপদে। ঠিক যেমন একদিন পরেই মর্ত্য ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যাবেন দেবীদুর্গা, আজকেও পূজা শেষে এই অচেনা মেয়েও চলে যাবে একবারে। আজকের মধ্যে যদি এই মেয়ের ব্যাপারে আমি কিছু না করতে পারি, তাহলে দশমীর বিসর্জনের পর ভক্তদের যে অবস্থা হয়, আমারও সেই একই হাল হবে!
পূজা মন্ডপে অগণিত পুণ্যার্থীর উপস্থিতি। বিরামহীন ভাবে ঢাকঢোল বেজে চলছে। আর সাথে শোনা যাচ্ছে থেমে থেমে ঘণ্টা, কাঁসার শব্দ আর উলুধ্বনি। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত আর আমি আছি আমার অপ্সরা’কে নিয়ে। কি করব ভাবতে ভাবতেই দেখি ছয় কিংবা সাত বছরের একটা বাচ্চাছেলে এসে এইমেয়ের হাত ধরে টান দিয়ে কিছু বলার চেস্টা করছে। দ্রুতই কাছে যেয়ে এদের কথোপোকথন মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। অতল গহবরে আশার আলোর মশাল হয়ে যেন বাচ্চাটা এলো, মেয়ের ছোট ভাই। দ্রুতপায়ে সাথে সাথেই মন্দির থেকে বের হয়ে আসলাম, এই সুযোগ হাতছাড়া করা একদম ঠিক হবে না।
মন্ডপের ভিতরেই বাকি বাচ্চাদের সাথে খেলছিল ছেলেটা। আস্ত দুইটা বড় বড় ক্যাডবেরি চকলেটের প্যাকেটেই কাজ হয়ে গেল। বোনের নাম বের করে ফেললাম, পরমা। পরমা তো আসলেও পরমা সুন্দরী। এক বোন এক ভাই। ছোট বাচ্চাটা বাসার ঠিকানাটা বলতে পারল না। মা আর বোনের সাথে এসেছে। এবার শুরু করতে হবে আসল কাজ!
দুই
-আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন?
অপেক্ষা করছিলাম আমি। সামনে এসে দাড়াতেই দুইহাত তুলে প্রণাম করে হাসিমুখে বললামঃ
-আপনার সাথে কথা বলার জন্য।
-আপনাকে তো আমি চিনিই না। আপনার সাথে কি কথা বলব আমি? আর আমার ছোটটাকে চকলেট দিয়েছেন কেন?
কিছুসময়ে সত্যের কোন বিকল্পই নেই। কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গিতে বললামঃ
-আপনাকে ডেকে আনার জন্য। আপনার সাথে কথা বলার জন্য। আমার মতো অসহায় মানুষের জন্য এছাড়া আর কি উপায় আছে বলুন?
আমার সহজ সরল স্বীকারোক্তি শুনে পরমা হেসে ফেলল। ওর চোখেমুখে দুস্টামির ছায়া দেখতে পেলাম।
-কি কথা বলতে চাচ্ছেন তাড়াতাড়ি বলুন!
-এত তাড়াহুড়া করছেন কেন? আগে আপনার সাথে ভালো করে পরিচিত হয়ে নেই!
পরবর্তি কিছুসময় ধরে আমার পরিচয় দিয়ে যখন ওকে খুব করে আমার ভালোলাগার কথাগুলি বললাম, ওর ফর্সামুখটা সহসাই লজ্জার আবীরে রক্তিম হয়ে উঠল। লজ্জাবনত মুখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আঙ্গুলে শাড়ির আঁচলের একটা অংশ পেচাচ্ছে। মুখে কিছুই বলছে না দেখে পরমাকে আবারও আমার পছন্দের কথা বলে ওর মতামত জানতে চাইলাম।
-অপরিচিত কারও সাথে কথা বলছি দেখলে মা খুবই রাগ করবে। আমি এখন যাই।
কি সর্বনাশা কথা? এই মেয়ে বলে কি? চলে যাবে মানে? এটা কোন কথা হলো?
-ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি বাঘ না ভাল্লুক? আরও কিছুক্ষন কথা বলি!
-না আমি যাই। ঐ যে মা আসছেন। অপরিচিত কারও সাথে দেখলে অনেক বকা দিবে।
-আপনার মোবাইল নাম্বারটা কি আমাকে দেয়া যাবে?
পরমা দুস্টামির হাসি দিয়ে দুইপাশে মাথা নেড়ে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিল নাম্বার দেয়া যাবে না। তারপর কিছু বুঝার আগেই আমার সামনে থেকে চলে গেল। হঠাৎ কি হলো সেটা দেখার জন্য পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম একজন মহিলা আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। ও আচ্ছা! কিন্তু এভাবে তো আমার হৃদয়ের সংহারিকা’কে চলে যেতে দেয়া যায় না। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী! যা থাকে কপালে, সোজা মন্ডপের প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পরলাম। বেশ কিছুটা ভিতরে ঢুকার পর, নবমীর দিনে যেমন রাম খুঁজে পেয়েছিলেন সীতা’কে আর আমি আজ খুঁজে পেলাম আমার বুকের ঢাক গুরগুরের অপ্সরা’কে। মন্ডপের একেবারে সামনে চন্দ্রামিত নেবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ ধাক্কাধাক্কি করে ওর পাশে যেয়ে দাড়াতেই হাসির আওয়াজ শুনে চারপাশে তাকিয়ে বুঝলাম বড়সড় অঘটন ঘটিয়েছি, মেয়েদের লাইনে এসে দাড়িয়ে গেছি! পরমা আমার কান্ড দেখে হাসতে হাসতে শেষ! এখানে আর বেশীক্ষন থাকা যাবে না, চুপচাপ লাইন থেকে বের হয়ে আসলাম। একটু দুরেই দাড়ালাম তবে পরমা’কে এবার আর আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে দিলাম না। এখন ও যা ইচ্ছে করুক, হারানো ভয় আর থাকলো না। পরমাও দেখলাম মাঝে মাঝে উঁকিঝুকি মেরে আমাকে দেখল।
অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি সুযোগের অপেক্ষায়। মন্ডপের সামনে থেকে সবাই এক এক করে অঞ্জলী দিয়ে চলে যাচ্ছে। পরমা’কে এগুতে দেখেই আমিও এগিয়ে গেলাম। পরমা’র অঞ্জলী দেয়া শেষ হয়ে ফিরে আসতেই ওর সামনে যেয়ে পথ আটকে দাড়ালাম।
-পরমা, আমি আপনার সাথে আরও দেখা করতে চাই, আরও কথা বলতে চাই!
-কেন?
-কারন আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কি যে সুন্দর লাগছে আজকে আপনাকে? একটা ছবি তোলা যাবে?
-এখনও তুলেন নি?
-তুলতে পারতাম, অন্যকোন মেয়ে হলে হয়তো এতক্ষনে তুলেও ফেলতাম। কিন্তু আপনারটা লুকিয়ে তুলতে মনে সায় দিল না!
-কেন আমি কি বিশেষ কেউ?
-আগে ছিলেন না তবে আজকে হয়েছেন। আর আজীবন আমার হৃদয়ে থাকবেন।
আমার কথা শুনে ওর ফর্সামুখটা আবার লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠল। লজ্জাবনত মুখে নীচে তাকিয়ে আছে। নিরবতা মৌন সম্মতির লক্ষ্যনং! মোবাইল বের করে বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললাম। পরমা আমার এইকান্ড দেখে কিছুই বলল না, মিটমিট করে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। আমার সাহস আরও বেড়ে গেল। এগিয়ে এসে ওর ডানহাতটা ধরে সেখানে ছোট একটা ভাঁজ করা কাগজ ওর মুঠির মধ্যে দিলাম।
তোমাকে দেখলেই হৃদয় জাগে অজানা শিহরতা
আবেগ এনে দেয় রক্তকোষে অছন্দের মাদকতা
আমার হৃদয়ের বর্ণিল প্রণয়ের সুতীব্র আকুতি
তোমার স্পর্শেই এনে দেয় অতলান্তিক প্রশান্তি!
আমার একবুক ভরা নিস্তব্ধ ভালোলাগা
বিমূঢ় নির্বাক হয়ে রয় তোমার পথ চেয়ে,
থাক না এলোমেলো, কিংবা অগুছালো
বেহিসেবী শিহরিত হয়ে সদ্যচেনা তোমার হৃদয়ে!
তোমার আঁচলের জড়ানো মধুর নিক্কনে
বারবার আমি ফিরে আসি প্রণয়ের আকুলতায়,
কম্পিত হৃদয়ে তোমাকে জড়িয়ে রাখব
সাতসাগর আর তেরনদীর সমান ভালোবাসায়!
কবিতাটা এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই ছোট কাগজটাতেই লিখেছিলাম। কাগজটাতে লেখার শেষে আমার মোবাইল নাম্বার আর সাথে অফিসের ভিজিটিং কার্ডও দিয়ে দিলাম। পরমা কাগজের ভাঁজ খুলে সবগুলি বের করে এক এক করে দেখল। কবিতাটা পরমা মনোযোগ দিয়ে পড়া শেষ করতেই পিছন থেকে কে যেন ওর নাম ধরে ডাক দিল শুনলাম।
-মা ডাকছেন, একক্ষন না গেলে অনেক রেগে যাবেন!
-চলে গেল যে আমার হৃদয়টা ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যাবে!
-যাই
-না, না, না।
যেতে যেন না পারে সেজন্য আমি ওর ডানহাতটা ধরে রাখলাম। পরমা হালকা করে আমার হাত ছুটানোর চেস্টা করছে।
-যেতে দিবেন না আমাকে?
-না। কক্ষনো না।
-প্লীজ, অবুঝ হবে না। মা অনেক বকা দিবে। আপনি কি চান আমি আপনার জন্য বকা খাই?
-তাহলে ভগবানের নামে শপথ করে কথা দিন আমাকে বাসায় যেয়েই ফোন দিবেন?
-আচ্ছা ঠিক আছে, ভগবানের নামেই শপথ করে বলছি আপনাকে আমি নিজেই ফোন দেব। বাসায় যেয়ে আগে কবিতাটা আবার পড়ব, তারপর। কবিতাটা ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিখেছেন, তাইনা? আমি কিন্তু দেখে ফেলেছি!
-আপনাকে নিয়ে আরও লিখব। ভালোবেসে সারাজীবন আপনাকে নিয়ে হৃদয়ের সব গোপন কথাগুলি লিখে যাব!
পরমা আমার দিকে তাকিয়ে খুব সুন্দর করে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল আর তারপর নিজের ডানহাত আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কানের পাশ থেকে একটা রক্তলাল গোলাপ খুলে আমার হাতে দিয়ে চলে গেল। যাবার সময় বারবার ফিরে আমার দিকে তাকালো। আর আমি চন্দ্রাহতের মতো বিমুগ্ধ হয়ে ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম.........
তিন
-কি প্রদীপ বাবু, কি চিন্তা করছেন? মেয়ে কেমন লাগল দেখতে?
দুলাল বাবু'র প্রশ্নগুলি শোনার পর সহসাই ফিরে এলাম বর্তমানে। জীবনের চরমতম নিষ্ঠুর বাস্তবতার আজ মুখোমুখি হয়ে। এই নশ্বর জীবনে কত যে ভয়ংকর সব কষ্ট হাসিমুখে মেনে নিতে হয়, কিংবা না চাইলেও মানিয়ে নিতে হয়! কি সুতীব্র বেদনার কালবৈশাখী ঝড় আমার হৃদয়টাকে এখন উলট পালট করে দিচ্ছে সেটা মনে হয় খোদ ভগবানও পুরোপুরি টের পাচ্ছেন না! তারপরও বুকে একটা মস্ত বড় পাথর চাপা দিয়ে বললামঃ
-জী দাদা, ভালো।
-দেখলেন? বলেছিলাম আপনাকে, মেয়ে একবার দেখলেই চোখ সরানো যায় না।
পরমা'কে নিয়ে এই নিষ্ঠুরতম সত্য কথা আমার চেয়ে ভালো আর কেই বা জানে এই পৃথিবীতে? বুকের ভিতর চিনচিন করে ব্যথা শুরু হয়েছে। কোন সুযোগ কি আছে এখনও আমার? শেষ একবার চেস্টা কি করা যাবে?
-বিয়ের কথাবার্তা কতদূর এগিয়েছে, দাদা?
-লগ্নপত্র, পানচিনি, আশির্বাদ ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। এখন শুধু আগামী পরশুদিন গাত্র হরিদ্রার পর সাতপাকে দুইজনকে বেঁধে দিতে পারলেই আমার কাজ শেষ!
প্রতিটা পর্বের নামগুলি যেন এক এক করে বিষ্ফোরিত হলো আমার হৃদয়ে। ওহ ভগবান, আর কতটা কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করলে তোমার কৃপা হবে! আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। মোবাইলটা দাদা'র হাতে ফিরত দিয়ে বাথরুমে যাবার নাম করে টেবিল থেকে উঠে আসলাম।
কেন যেন খুব করে কান্না পাচ্ছে! শূন্যতা, হাহাকার, নাকি নিঃসঙ্গতার জন্য, ঠিক জানি না। শুধু বুঝতে পারছি বুকের ভিতরে লুকানো অসহ্য কষ্টগুলি একদলা অভিমান হয়ে প্রচন্ড স্রোতে দু’চোখ ফেটে বের হয়ে আসার জন্য ছটফট করছে।
চোখে মুখে ভালো করে জল দেবার পরও চোখ জ্বলাটা কমল না। খুব অস্থির অস্থির লাগছে। ভগবান এত নিষ্ঠুর কেন? আমার মতো সামান্য একজনের মনের মন্দির ভেঙে কি লাভ হলো ভগবানের?
পরমা, তুমি আমার প্রণয়ের মন্দিরে শুধু পূজার ফুল হয়েই রয়ে গেল, ভালোবেসে পূজা করতে দিলে না।
নিজের অজান্তেই বুকের গহীন থেকে ভেসে আসছে…
“যদেতত হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।”
আমার এই অসহায় হৃদয় তোমার হৃদয়ে এতটুকু জায়গা না পেলেও, আমার হৃদয়ে তুমি প্রথম প্রেমের স্মৃতি হয়ে চিরকালই রয়ে যাবে। বুকের ভিতর এই বিদগ্ধ হৃদয় শুধু তোমাকেই ভালোবেসে যাবে, আর কোন কিছুর প্রত্যাশা না করেই............
ভিজে উঠা চোখের পাতাগুলি মুছে ফেলে চুপিচুপি আমি পরমা'র সামনের দিনগুলির শুভ কামনা করে আমার অসহায় ভালোবাসার জীবন্ত সমাধি দিয়ে দিলাম। নশ্বর এই পৃথিবীর কেউ জানলোই না, গভীর আবেগের একটা প্রচন্ড ভালোবাসার মরণ হলো একদম নিভৃতেই!
পুনশ্চঃ হঠাৎ ছয়মাস পরে একদিন মোবাইলে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলে রিসিভ করার পর পরমা'র কন্ঠ শুনে আমি বেশ বিব্রত হলাম। পরমা জানালো সেদিন বাসায় যাবার সময় রাস্তায় ওর মা ওর কাছ থেকে আমার কাগজটা কেড়ে নিয়েছিল। এতদিন ধরে ও শুধুই পাগলের মতো এই কাগজটা খুঁজে ফিরছিল। আজকে একটু আগে পেয়েই ফোন দিয়ে সজোরে কান্না করতে করতে ওর ব্যর্থতার জন্য বারবার ক্ষমা চাইলো! নিঃশব্দে ভালোবাসার কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল আমার চোখ থেকে। পরমা’কে নিয়ে যে ভুল আমি বুঝেছিলাম সেটা ভেঙ্গে দেবার জন্য এতকিছুর পরেও ওকে খুব করে ধন্যবাদ দিলাম। আর বুঝলাম ভগবান শেষ পর্যন্ত আমাকে কৃপা করেন নি!
উৎর্সগঃ
শ্রদ্ধেয় সহ-ব্লগার এবং আমার অকৃত্রিম ব্লগীয় বন্ধু পদাতিক চৌধুরীকে। এই গল্পটা উনাকে উৎর্সগ করার জন্য লিখা হয়েছে! গল্পের প্লটটা তৈরী হবার পরই এবার চরম একটা দুঃসাহসিক কাজ করলাম। প্রথমবারের মতো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে লিখলাম। ধর্মীয় কোন বিষয়ে ভুল লিখলে ঠিক করিয়ে দেবার জন্য সবাইকে অনুরোধ রইল। আমি আপ্রান চেস্টা করেছি যতটুকু সম্ভব শুদ্ধভাবে লেখার। একজন গল্পকারের কোন বিষয়েই লেখার সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত নয়। ইচ্ছে আছে এদের সামাজিক আচার আর বিশ্বাস নিয়ে আরও লিখার……
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, জুলাই ২০১৯