যেই সকল আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশকে বিজ্ঞানে অনগ্রসর, আর করুন দেশ হিসেবে প্রচার করে তাদের জন্য এই পোস্ট চাপেটাঘাত।
বাংলাদেশকে নিয়ে কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মিথ্যা প্রপাগান্ডা নতুন নয়। কিছু মিডিয়া আমাদের দেশকে নিয়ে এমন সব কটু মন্তব্য করে যেন অশক্ষিত আর মুর্খদের স্বর্গ ভুমি আমাদের এই দেশ। শিক্ষা দীক্ষা আর বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া একটা হতভাগ্য জাতী। কিন্তু এই হতভাগ্যদের মাঝেও কিছু নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিলো। যারা পৃথিবী থেকে চলে গেছেন কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া কাজ আমাদের কে করবে উচ্চাকাংখী, ভাবুক আর স্বপ্নবিলাসী। যাদের কারনে বাংলাদেশের তরুনরা ভবিষ্যতের উন্নতির ছোয়া। আর যে কারনে আমি বাংলাদেশী হিসেবে এখনো অহংকার করতে পারি।
বাংলাদেশের বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি ও পুরকৌশলী(এপ্রিল ৩, ১৯২৯ - মার্চ ২৭, ১৯৮২) । তিনি পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ ভবন শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার এর নকশা প্রণয়ন করেন। হ্যা, আমি ফজলুর রহমান খানের নামটি বলছি।
ফজলুর খান ঢাকা শহরে ১৯২৯ সালের ৩রা এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, শিবপুর) পড়াশোনা করার পর তিনি ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ফুলব্রাইট বৃত্তি লাভ করে তিনি ১৯৫২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান, এবং ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় এট আর্বানা-শ্যাম্পেইন এ পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে তিনি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ এবং তত্বীয় ও ফলিত মেকানিক্সে দুইটি মাস্টার্স ডিগ্রি, এবং স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি শিকাগো শহরের স্কিডমোর, ওউইং ও মেরিল নামের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন।
বর্নাঢ্য কর্ম জীবনঃ
জনাব এফ আর খান ১৯৫২ তে যুগপৎ সরকারী বৃত্তি ও ফুল ব্রাইট বৃত্তি নিয়ে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন ৷ সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আরবানা শ্যাম্পেইন থেকে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংসহ তত্ত্বীয় এবং ফলিত মেকানিক্স-এ যুগ্ম এম এস করার পর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ৷ তিনি মাত্র তিন বছরে দুটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালে দেশে ফিরে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পূর্ব পদে যোগদান করেন ৷
পরবর্তীতে আমেরিকার স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিড মোর এর আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে এ কোম্পানীর শিকাগো অফিসের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ৷ পাশাপাশি তিনি আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি এর স্থাপত্য বিভাগে অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হন ৷ সেখানে পরে তিনি প্রফেসর এমিরিটাস হয়েছিলেন ৷ এছাড়া ডঃ এফ আর খান নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, লি হাই বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইস ফেডারেল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ৷
বিশেষ কৃতিত্ত্বঃ
শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার তার অনন্য কীর্তি। তিনি ১৯৭২ সনে 'ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড'-এ ম্যান অব দি ইয়ার বিবেচিত হন এবং পাঁচবার স্থাপত্য শিল্পে সবচেয়ে বেশী অবদানকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত হবার গৌরব লাভ করেন (৬৫,৬৮,৭০,৭১,৭৯ সালে)৷১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সনে আমেরিকার 'নিউজ উইক' ম্যাগাজিন শিল্প ও স্থাপত্যের উপর প্রচ্ছদ কাহিনীতে তাঁকে মার্কিন স্থাপত্যের শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে ৷ স্থপতি ডঃ এফ, আর, খান আন্তর্জাতিক গগনচুম্বী ও নগরায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ৷ তাঁর অন্যান্য অবদানের মধ্যে রয়েছে শিকাগোর জন হ্যানকক সেন্টার, জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের, হজ্ব টার্মিনাল এবং মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য মডেল অংকন ৷
১৯৯৮ সালে শিকাগো শহরের সিয়ার্স টাওয়ারের পাদদেশে অবস্থিত জ্যাকসন সড়ক পশ্চিম পার্শ্ব এবং ফ্রাঙ্কলিন সড়কের দক্ষিণ পার্শ্বের সংযোগস্থলটিকে নামকরণ করা হয় "ফজলুর আর. খান ওয়ে"।
গবেষনাঃ
এফ, আর, খান মুসলিম স্থাপত্য বিষয়ের উপর নানা ধরনের গবেষণা করেছেন ৷ ডঃ খান Tube in Tube নামে স্থাপত্য শিল্পের এক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন যার মাধ্যমে অতি উচ্চ (কমপক্ষে একশত তলা) ভবন স্বল্প খরচে নির্মাণ সম্ভব ৷ গগনচুম্বী ভবনের উপর সাত খন্ডে প্রকাশিত একটি পুস্তকের তিনি সম্পাদনা করেন।
বিশেষ অবদান ঃ
• সিয়ার্স টাওয়ার (Sears Tower) এর নকশা প্রনয়ন করেন।
• জন হ্যানকক সেন্টার এর নকশা। (১০০ তলা)
• জেদ্দা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর।
• হজ্ব টার্মিনালের ছাদ কাঠামো। (৫০,০০০ বর্গফুট)
• মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য নকশা।
১৯৯৯ সালে তাকে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।
১৯৯৯ সালে ফজলুর রহমান খানের স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। ৪ টাকা মূল্যমানের এই টিকিটটিতে রয়েছে ফজলুর রহমান খানের আবক্ষচিত্র, আর পটভূমিতে রয়েছে সিয়ার্স টাওয়ারের ছবি।
১৯৮২ সনের ২৬শে মার্চ জেদ্দায় বাংলার এই মহান সন্তান মৃত্যুবরণ করেন৷
পরিশেষে আমার কথা ঃ
আমি জানি, আমার দেশের অনেক মানুষ অসুখ হলে এখনো ওঝার কাছে যায় ঝাড়-ফুক করার জন্য। ঘর-বাড়িতে জ্বীন ভুতের আছর হয়েছে হলে পীর-হুজুরের কাছে গিয়ে তাবিজ দিয়ে ঘর বন্ধ করানো হয়। মাজার আর ভন্ড পীরের ব্যাবসা এই একবিংশ শতাব্দিতেও জমজমাট ভাবে চলছে। ইভেন আমার গ্রামের বাড়িতেও দেখেছি ঘর-বাড়ী জ্বীনের আছর মুক্ত রাখার জন্য কোরবানীর গরুর মাথা, শিং ঘরের চালের উপরে ফেলে রাখা হয়। গত পরশু দেখলাম খোদ ঢাকাতেই টাইগার বাবার কান্ড(একুশে টিভিতে)। আরো দেখি বিদেশের এভিয়েন টিভি, সিবিস নিউজ সহ অনেক নিউজ। আমি লজ্জিত হই সেসব দেখে। আমি জানি না গ্রাম-বাংলার চরাঞ্চলে ও রিমোট এরিয়াতে কি ভয়ানক অবস্থা। যদিও আমরা ২০১১ সালে আছি। কিন্তু ফজলুর রহমান খান আজকে থেকে প্রায় একশতাব্দি আগে জন্ম নিয়েও দেখিয়ে দিয়েছেন কি ভাবে মাথা উচু করে বাচতে হয় কি ভাবে অন্য জাতির কাছ থেকে সম্মান নিতে হয়।
আমি জানি না আজকে থেকে ৭০-৮০ বছর আগে গ্রাম-বাংলার অবস্থা কতো খারাপ ছিলো। জানি না কতো ভয়ানক বিভৎষ কু-সংস্কারে আচ্ছন্ন ছিলো। কিন্তু সেই খারাপ সময়ে থেকেও ফজলুর রহমান বাংলাদেশীদের জন্য যেই উদাহরন তৈরি করে দিয়ে গেছেন সেই জন্য আমার পক্ষ থেকে তাকে লাল সালাম জানাই। আজকে টিভিতে যখন সিয়ার্স টাওয়ার কে দেখি মনে মনে ভাবি এটা বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ারের কৃতিত্ত্ব। যারা আধুনিক স্থাপত্য সভ্যতার দাবীদার,যারা আমাদের কে করুন রাষ্ট্র বলে সেই আমেরিকা, ইউরোপের ইঞ্জিনিয়ারাও তার গবেষনা করে লিখা বই কে ফলো করে। আমেরিকার সেরা সেরা ইঞ্জিনিয়াররাও ভবিষ্যত স্ট্রাকচার দাড়া করানোর ব্যাপারে ফজলুর রহমানের কাছে পরামর্শ চাইতো।
বাংলার এই মহান সন্তানকে বাংলাদেশীরা চিরজীবন মনে রাখবে।
তথ্য সুত্রঃ উইকি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৩৭