দাড়া = দৈন্য
রাখলেন সাঁই কূপজল করে, অন্ধেলা পুকুরে।
এবার যদি না পায় চরণ, আবার কি পড়ি ফেরে ॥
নদীর জল কি কূপজল হয়, বিল বাওড় ও তা প্রায়
সাধ্য কি তা গঙ্গাতে যায়, গঙ্গা না এলে পরে,
তেমনি জীবের ভজন বৃথা, তোমার দয়া নাই যারে ॥
যন্ত্ররে পড়িয়ে মন্ত্র, রয় যদি তা লক্ষ বৎসর
যন্ত্রী বিহনে যন্ত্র, কভু না বাজতে পারে
গুরু, তুমি যন্ত্রী, আমি যন্ত্র, সু-বোল ধরাও আমারে ॥
পতিতো পাবনো নামটি, শান্ত্রে শুনেছি খাঁটি
পতিত না তরাও যদি, কে ডাকবে ঐ নাম ধরে,
লালন বলে তরাও গো সাঁই, এ ভব কারাগারে ॥
শব্দার্থ: কূপজল - কূয়োর জল। আন্ধেলা পুকুরে - বদ্ধ পুকুরে, কানা পুকুরে। পড়ি ফেরে - চুরাশি লক্ষ যোনির ঘোর ফেরে। বাওড় - বড় বিল। জীবের ভজন বৃথা - মানুষের মিথ্যে ভজন-সাধন। যন্ত্র - বাদ্য যন্ত্র বিশেষ। মন্ত্র - পূত-পবিত্র বাক্য। লক্ষ - শত হাজার। যন্ত্রি - যন্ত্র বাদক। সুবোল - সুন্দরতম সুর। পতিত পাবন - পাপীর ত্রাণকর্তা। শান্ত্র - ধর্মীয় বিধান পুস্তক। তরাও - তারণ কর। ভব কারাগারে - একজন সাধকের জন্য ভব সংসার কারাগার স্বরূপ।
ভাবার্থ: এই পদটি “দৈন্য” দাড়ার পর্যায়ভুক্ত। দৈন্য হচ্ছে দীনতা প্রকাশের ধারা। নিজারাধ্য ও পূজনীয়দের স্বকাশে নিজকে দীন অর্থাৎ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রূপে উপস্থাপন করাটাই দৈন্য বা দীন দাড়ার মূল ভাব। এখানে বলা হচ্ছে যে, সাঁই আমাকে চিরদিন বন্ধ বা কানা পুকুরের জল মনে করে সংসার আবর্তে ও সংকীর্ণতার বেড়াজালে আটকিয়ে ফেলে রেখেছেন। এবার যদি তিনি নিজগুণে দয়াকরে আমাকে উদ্ধার না করেন, তাহলে পাপ কর্মদোষে আমি চুরাশির ফেরে পড়ে যাবো। নদী, বিল ও বাওড়ের জল কূয়োর জলের মত যার যার অবস্থানে পড়ে থাকে, কিন্তু বন্যার সময় গঙ্গার জল প্লাবিত হয়ে ঐ সকল জায়গায় এসে সমস্ত জলকে নিজ পবিত্র ধারার সঙ্গে মিশিয়ে সবই পবিত্র করে নেয়। তেমনি শিষ্য, গুরুর একান্ত করুনাধারায় মিশে পূণ্যবান হয়ে যেতে পারে। লক্ষ বৎসর ধরে মন্ত্রপাঠ করলেও যন্ত্রী ব্যতীত যেমন বাদ্যযন্ত্র বাজানো যায় না, তেমন গুরুর করুণাধারা ব্যতিত শিষ্যের মোক্ষলাভ কখনও সম্ভব হতে পারে না। শান্ত্রে শুনেছি গুরুদেবই একমাত্র পাপী তাপী শিষ্যের তারণ কর্তা। পাপীকে যদি গুরুদেব তারণ না করেন, তাহলে ঐ নামের মহিমা বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অধিক থাকে। কিন্তু নিষ্ঠাবান ভক্ত কখনও গুরুদেবের করুনা হতে বঞ্চিত হয় না।
পরিশেষে মহাত্মা লালন ফকির সবিনয়ে বলছেন যে, এই ভব সংসারের মায়া হতে মুক্তি দিয়ে দয়াল গুরুদেব যেন তাকে পার করে নেন।
(নিয়ামত মাষ্টারের ১১০৯ টি লালনগীতির ভাবার্থ থেকে সংকলিত)