মরম হচ্ছে মানব দেহভান্ডের কোমলতম, অন্তরতম ও নিগূঢ়তম একটি প্রদেশ, যার প্রভাবে মানুষ অজ্ঞেয় অতীন্দ্রিয়ের ধ্যান-জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বোধের দ্বারা নিজাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মহামিলন ঘটাতে সক্ষম হতে পারেন। মরমীতত্ত্ব হচ্ছে, পরম সত্ত্বা ও পরমাত্মার মর্ম উপলদ্ধি যদি সাধক হৃদয়ে লীন হয় তাকে মরমীতত্ত্ব বলে। এছাড়া মরমীয়া সাধক হচ্ছেন, যিনি আপন হৃদয়ে ও মর্মে বিশ্বপ্রকৃতির গূঢ়তত্ত্ব অবলোকন করে, সজ্ঞানে অতিন্দ্রীয়কে সম্যক উপলব্ধির মাধ্যমে সহজেই আত্মার গতি-প্রকৃতি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। মহাত্মা লালন ফকির এই বিবিধ জ্ঞান ও মতকে তার গীতিকাব্যের অংগ ও অংশরূপে গ্রহণ করেছিলেন। এতদবিষয়ে অসংখ্য ভক্তিমূলক গানে তাঁর সক্রিয় প্রভাব ও উদাহরণ বিদ্যমান দেখতে পাওয়া যায়। সেই কারণে লালন ফকিরকে মরমীয়াবাদী গীতিকার বললে অত্যুক্তি হবে না, কারণ তিনি ইন্দ্র ও অতীন্দ্রিয় বিষয়ক জ্ঞানের বা তত্ত্বের সম্যক উপলব্ধিকারী ছিলেন।
অন্তর্দৃষ্টি, বহির্দৃষ্টি, বাকশক্তি, শ্রবণশক্তি ও সঞ্চালন শক্তি মিলে পঞ্চশক্তির সাধকগণ পঞ্চশক্তির মাধ্যমে তার নিজ অন্তরের বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব ও তথ্য হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি ও প্রয়োজন বোধে বিশ্লেষণ করতেও পারেন। লালন ফকিরও তাঁর ভাবগীতিতে, দর্শনের ক্ষেত্রে এবং সাধন-ভজনের মূলে এই পঞ্চ শক্তি পূর্ণভাবে ব্যবহার করে গেছেন। তিনি উচ্চভাবের আবেষ্টনির মাধ্যমে মহাভাবের প্রকাশ ও বিন্যাস ঘটিয়েছেন। সেই জন্য তিনি আত্মোপলব্ধিকারী সাধক ইমাম গাজ্জালী, হাফিজ, জামী, রুমি বায়েজিদ বোস্তামী সহ প্রভুত মরমী সাধকগণের সমগোত্রীয় হয়েছেন। সজ্ঞাধারী ও অন্তদৃষ্টির দিক দিয়ে তিনি মুনছুর হাল্লাজ (আমিসত্য), ইবনুল ফরিদ (আমি সেই সুন্দর নারী) বায়োজিদ বোস্তামী (আমিই পবিত্র) জালালুদ্দীন রুমি (আমিই মদিরা) এই সকল প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের সমপর্যায়ভুক্ত বললেও অত্যুক্তি হয় না। মরমী ফকির লালন তাঁর ভক্তিরসের আচ্ছাদনে ভাববাদী গীতি কাব্যগুলি মরমস্পর্ষকারী বস্তুবাদী মদিরা রসে রসোপ্লুত করে, গড়ে তুলেছিলেন সুমহান গীতিকাব্যের সু-উচ্চ মরমী স্মৃতিসৌধ।
উল্লেখ্য যে, মহাত্মা লালন ফকির কিন্তু মরমীবাদী সাধকদের মত জীবন বিমুখ ছিলেন না। তিনি দেহ, মন, আত্মা ও জীবনকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই বাছাই ও ভক্তিরসের অমীয়ধারায় দেহ মধ্যস্থ অটল স্থিতির সন্ধান জেনে অটল সাঁই‘র সন্নিধ্য লাভের চেষ্টা করেছেন। এবং এতদবিষয় সম্প্রসারণের জন্য সাধারণ মানুষকে সাদরে শিষ্যত্বে গ্রহণ করে উপযুক্ত শিক্ষাদান করে গেছেন। তিনি মানুষকে “মানুষ রতন” বলে আখ্যায়িত করে মানুষকে যথাযত ভাবে মূল্যায়ন ও সম্মানিত করে গেছেন। মরমী সাধক ও সুফী সাধকগণের কাওয়ালীগান এবং লালনগীতির ভাববাদের মধ্যে কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না। সাধনার দিক দিয়ে তাঁরা সবাই একই বৃন্তে ফোটা পুষ্পের মত। এছাড়া লালন ফকির গীতগোবিন্দের অনুসরণের মধ্য দিয়ে পরবর্তিকালের বিধ্যাপতি ও চন্ডিদাস প্রদত্ত সংগীতের পরমপদ প্রাপ্তি এবং দেবারাধনার প্রকৃত পদ্ধতির ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। ঐ সকল সর্বজনিন শ্রদ্ধেয় ও মরমী সাধকগণের মাজারগুলিকে ভাববাদী ও ভক্তিমূলক সংগীত প্রচারের ক্ষেত্র, কেন্দ্র বা গাদী বললেও অত্যুক্তি হবে না।
এতদদৃষ্টে সহজে অনুমেয় যে, সহজ ও সাধারণ মানুষের মনে, মরমী সংগীত ও মর্মস্পর্ষী লালনগীতিগুলির আবেদন সহজ ভাবেই সংক্রমিত হয়েছে। সেই জন্য সজ্ঞাধারী সহজ মানুষগুলি সহজেই ও স্বইচ্ছায় এই সহজ পথের অনুগামী হয়েছেন।
পরিশেষে মহাত্মা লালন ফকির সম্বন্ধে পৃথিবীর অন্যান্য গবেষক ও দার্শনিকদের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে যে, তিনি মরমী ভাবকবি হিসাবে রুমি, জামী ও হাফিজের সমগোত্রীয় এবং কবীর, দাদু, ব্রহ্মানন্দ ও রজবের উত্তরসূরী। এছাড়া তিনি দার্শনিক, ধর্মবেত্তা, বিশ্বপ্রেমিক ও মরমীকবি হিসেবে জগতে পরিচিতি লাভ করেছিলেন, এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আসুন আমরা মহাত্মা লালনের মর্মস্পর্ষী গীতিকাব্যগুলির বিশ্বায়ন ও সার্বিক উন্নয়নে, যে যার সাধ্যমত চেষ্টা অব্যহত রেখে তাঁকে বিশেষিত ও সম্মানিত করি।
(নিয়ামত মাষ্টারের লালন বিষয়ক শতাধিক প্রবন্ধ থেকে সংকলিত।)