জাত-ছেফাত
আমি মরছি খুজে সেই দোকনের সহজ ঠিকান।
সেথা আল্লা, হরি, রাম, রহিম, গড, এক সাথে করে লেনা-দেনা ॥
ভক্তি যোগের আগুন জ্বেলে, গৌর রামকৃষ্ণ কড়াই এ ঢেলে
বুদ্ধ, নানক, যিশু ছেঁকে, প্রেম রসের মিহিদানা ॥
জ্ঞান ছানাতে কর্ম চিনি, বুদ্ধ নানক মাখে
দয়ার সাথে ক্ষমার মাঝে বড়াই নাহি থাকে
লালন বলে যায় না কেনা, বিনা কড়ির লেনা-দেনা
সহজে সহজ মিশিলে, জ্ঞান যোগে যায় চেনা ॥
শব্দার্থ: ঠিকানা - পরিচিতি, অবস্থিতির স্থান। লেনা-দেনা - লেনদেন। ভক্তি যোগ - সেবা, পূজা, আরাধনা। প্রেমরস - যে রসে অনুরাগ জন্মে। বড়াই - অহংকার। বিনাকড়ি - অর্থছাড়া, টাকা পয়সা ব্যতীত। জ্ঞানযোগ - স্বজ্ঞানে কোন কিছু জানা। সহজ - ভক্তিভাব সম্পন্ন ব্যক্তি।
ভাবার্থ: এই পদটি “জাত-ছেফাত” দাড়ার আওতাধীন। খাসজাত হচ্ছেন খোদাপাক স্বয়ং এবং ছেফাত হচ্ছে তার গুণবাচক নাম ও গুণাবলি। কিন্তু শাধুসাস্ত্রে বলা হচ্ছে যে, একই ব্যাক্তি জাত-ছেফাত অর্থাৎ আহাদ-আহাম্মদ রূপে জীবে বর্ত থেকে সবকিছু ঘটাচ্ছেন। সেই জন্য ফকিরগণ দুই রূপকে এক জেনে সাধন-ভজন করেন। যদিও দাড়াটি জাত-ছেফাতের অন্তর্গত তবুও পদে জাতাজাতির বিভেদ ভুলিয়ে সৃষ্ট মানুষকে এক জাতিভুক্ত করা এবং ভিন্ন ধর্মের হোতাগণকে “মানব” ¯্রষ্টারূপে পরিচিতি করার সার্বিক প্রয়াস উল্লেখ যোগ্য। এখানে পদকর্তার নিজেস্ব মতামত অত্যন্ত গভীর উপলব্ধির মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলছেন যে, আল্লা, হরি, গড যদি একত্র হয়ে বিশ্বমানব জাতির মিলিত ¯্রষ্টা হতেন তাহলে কতই না ভাল হত। এ বিশ্বে এত হানাহানি বিদ্বেষ কিছু থাকতো না। যে সকল প্রাতঃস্মরণীয় মহামানব (মোহাম্মদ, বুদ্ধ, চৈতন্য, নানক, যিশু) ও মনিষীগণ দয়া ও ক্ষমার মাধ্যমে মানব জাতিকে এক করতে চেয়েছিলেন তাদের প্রয়াস আংশিক ব্যর্থ হলেও সফলতার সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু আমরা যারা পৃথিবীতে বসবাস করি তারা জাত্যাভিমানের বড়াই করে তাঁদের জ্ঞান ও উপদেশ ভুলে এই সুন্দর পৃথিবীকে মানুষ বসবাসের অযোগ্য করে তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছি।
পরিশেষে জীব দরদী ভক্তপ্রেমি মহাত্মা লালন ফকির স্বখেদে বলছেন যে, ঐ সকল মহামানবের উপদেশগুলি বিনামূল্যে প্রাপ্ত হওয়াই আমরা সেগুলো সৎউদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারি নাই। কারণ মানুষের জ্ঞানই হল তার পরিচালক, কিন্তু সেই জ্ঞানকে পরিচালনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
আঃশঃ লেনা-দেনা - লেন দেন। বড়াই - অহমিকা ভাব।
(নিয়ামত মাষ্টারের ১১০৯ টি লালনগীতির ভাবার্থ থেকে সংকলিত)