বিচিত্র এই ভব সংসারে ক্ষণজন্মা মনিষীগন নিজস্ব চিন্তা চেতনা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে জগতবাসীর কল্যাণের জন্য আচার আচারণ ও নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের পন্থা উৎসর্গ করে গেছেন, তারাই মানবজাতির হৃদয় আকাশে উজ্জল নক্ষত্রের মত জ্বোজুল্যমান হয়ে আছেন। তাদের মুখ নি:সৃত বাণী মানুষের জীবনে দৃষ্টান্তস্বরূপ পালনীয় কর্তব্য হয়ে প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। এমনই একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হচ্ছেন মহাত্ম লালন ফকির। তিনি তার ভাব দর্শনের ছত্রে ছত্রে সাধু তত্ত্বের সার কথা বলে গেছেন যে, বিলাসী খাদ্যাভ্যাস ও অবৈধ যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে অধিক রেত: স্খলনই হচ্ছে, জাগতিক, মানুষিক ও পারলৌকিক অধ:পতনের প্রধান কারণ এবং এই দুটি পন্থা কঠিন সংযমের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে প্রকৃত সাধুত্ব। আসুন আমরা সাধু সন্তুদের সুনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের পথ ও পদ্ধতি সম্বদ্ধে কিছু অবগত হওয়ার চেষ্টা করি।
প্রথমতপেট বা উদর নিয়ন্ত্রণ রীতি) জীবের চালিকা শক্তি হচ্ছে পেট বা উদর পুর্তি। যন্ত্রকে সচল রাখার জন্য তেল ও পানির প্রয়োজন হয়, তেমনই মানব দেহ যন্ত্রকে চালু রাখতে হলে খাদ্য ও পানির প্রয়োজন সমধিক। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্য মানব দেহের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে। সাধনরীতি অনুযায়ী দেহকে সুস্থ্য রাখার জন্য নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহনই মানুষকে দীর্ঘায়ু ও কার্যক্ষম রাখার জন্য যথেষ্ট। এতদবিষয়ে গাউজ-কতুব, মনিষী ও সাধু সজ্জন্যদের জীবন যাপনের পদ্ধতি উদহরণ স্বরূপ অবলোকন করা যেতে পারে।
লালন ফকির বলছেন যে,
সিরাজ সাঁ কয় পেট শেখালি
তাই নিয়ে পাগল লালন।
পুন:
শুধু পেট সার করনা।
অর্থাৎ লালন গুরু সিরাজ সাঁ তাকে শেখালি (ছোট বস্তা) সম পেট ভরতে নিশেধ করেছেন। কারণ ঐ বস্তা ভরতেই জীবনের অধিকাংশ সময় বিনষ্ট হয়ে যাবে, তার পক্ষে সাধন ভাজন করা কোন ক্রমেই সম্ভব হবে না। মানুষ নিজের ও পরিবারের অসম ও বিলাসী পেটের চাহিদা পুরনের জন্য জগতের যত প্রকার অন্যায় ও অবৈধ কর্মে নিয়োজিত হয়ে থাকে। যেমন অসৎ ব্যবসা, সুদ ও ঘুষখোরি, অসত রাজনীতি, সন্ত্রাসী, রাহাজানী অর্থাৎ অসম ও অসামাজিক কাজ করতে বিবেক তাকে বাঁধা দান করে না। উদ্দেশ্য শুধু একটাই, উত্তম খাদ্য গ্রহন এবং বিলাসী জীবন যাপন। বিলাসী খাদ্য গ্রহনে দেহের স্থুলতা বৃদ্ধি পেয়ে মানুষের কাম ভাব তীব্র করে। এই কাম প্রবনতা মানুষের ইহ জীবন ও পরজীবনে সমস্ত রকম দু:খের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধু ফকিরগণ স্বল্পাহার ও সুনিয়ন্ত্রিত আহারে দীর্ঘজীবন লাভ করে থাকেন, যার যথেষ্ট প্রমান রয়েছে। তারা বলেন যে, অধিক মাংস আহারে শরীরের হিয়শ্রতা ও কাম শক্তি বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, বাঘ ও সিংহ সহ অন্যান্য মাংসাষী প্রাণী, কিন্তু শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে নিরামিষাসী প্রাণী। যেমন হাতি, গন্ডার ও মহিষ, এদের সঙ্গে কোন ভাবেই শক্তিতে টিকে থাকতে পারে না। বাঘ সিংহের হিংস্রতা যদি না থাকতো তাহলে বুদ্ধিও শক্তির দিক দিয়ে হাতি সব সময় এগিয়ে থাকতো। হাতি কিন্তু মাংস খাইনা। এজগতে যারা নিজের মনকে যথাযথ ভাবে মানুষের মত করে লালন পালন করতে চায়, তারা কিন্তু মাংসসহ সকল প্রকার উত্তেজক খাদ্যকে এড়িয়ে চলে এবং নিরামিষ খাদ্যে অভ্যস্থ হবার চেষ্টা করেন।
দ্বিতীয়ত: (জননাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ রীতি) পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, অন্যায় পথে উপার্জিত অবৈধ অর্থে ক্রয়কৃত বিলাসী ও উত্তেজক খাদ্য গ্রহনের ফলে দেহে কাম ভাব ও হিংস্রতা প্রবল হয়। তখন ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, কাম কামনার হাত থেকে অব্যহতি পাওয়া সম্ভব হয় না এবং অতিরিক্ত রেত:পাতে দেহ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মনের পবিত্রতা নষ্ট হয়। সেই কারণে সাধু শাস্ত্রে বলা হয়ে থাকে যে, নিয়ন্ত্রিত স্বল্পাহারই কাম কামনাকে স্ববশে রাখতে পারে। মুসলমান ধর্মে বলা হয়েছে যে, কামের ক্ষতিকর প্রভাব হতে বাঁচতে হলে সিয়াম পালনের আবশ্যকতা আছে।
লালন : কামেই মরণ প্রেমেই তারণ
তাই প্রেমাশ্রয়ে রই সাধুগণ
পুন:
যার কাম নদীতে চর পড়েছে
তার প্রেম নদীতে জল আটেনা ॥
যারা ভেকধারী প্রকৃত ফকির, তারা সর্বদা গুরুর শিক্ষা-দীক্ষানুযায়ী বৈধ স্ত্রী কিংবা সাধন সঙ্গিনী ব্যতিরেকে জগতের সমস্ত রমণীকুলকে মাতৃজ্ঞানে সম্বোধিত করে থাকেন, অর্থাৎ মা বলে ডেকে থাকেন। মা সম্বোন্ধনের ফলে নারীর প্রতি পুরুষের কাম ভাব দুর হতে বাঁধ্য, (পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে) জগতে যত বড় পাপী পাষন্ডই থাকুক কেন, সে যদি কোন মেয়েকে মা বলে সম্ভোধন করে থাকে, তাহলে তার ওই মেয়ের প্রতি কোনক্রমেই কাম ভাব আসতে পারে না। যদি এই উক্তিটির সত্যতা না থাকতো, তাহলে জগত সংসার থেকে মা ডাকের মহিলা উঠে যেত। ফকিরদের ক্ষেত্রে, যেদিন হতে সে গুরুর নিকট শিষ্য হিসেবে দীক্ষা গ্রহণ করবে, সেদিন হতে মেয়েদের মা সম্বোধন করার শিক্ষাটাও তাকে গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া গুরুভক্তি, সাংসারিক দীনতা, স্বল্পাহার, সাধন ভজন এবং ঈশ্বরভীতি ও লোকলজ্জার ভয় ফকিরদের কাম কামনা ও যৌন চিন্তাভাবনা হতে তাদের দুরে রাখে। এছাড়া ঘর বা ঘরানা ভেদে কিছু গুরুকরণী আছে যে বিষয়টা গুরু ধরে শিখতে ও জানতে হয়। পরিশেষে বলা চলে যে পেট ও জননাঙ্গের হেফাজতকারীগনই শুধুমাত্র দুনিয়াবী ফললাভসহ মোক্ষপ্রাপ্তির আশা করলেও করতে পারেন।
(নিয়ামত মাষ্টারের লালন বিষয়ক শতাধিক প্রবন্ধ থেকে উৎকলিত।)