দাড়া- “দেহতত্ত্ব”
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়।
তারে ধরতে পারলে মনো বেড়ি দিতাম পাখির পায় ॥
আট কুঠুরী নয় দরজা আটা মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা
তার উপরে সদর কোঠা আয়না মহল তায় ॥
কপালের ফে’র নয়লে কি আর পাখিটির এমন ব্যবহার
খাঁচা ছেড়ে পাখি আমার কোন খানে পলায় ॥
মন তুই রইলি খাঁচার আশে খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে
কোন দিন খাঁচা পড়বে খ’সে লালন ফকির কয় ॥
শব্দার্থ :- খাঁচার ভিতর = দেহ অবকাঠামোর অভ্যন্তরে ॥ : অচিন পাখি = আত্মারূপী কর্তা, যিনি দমেরসনে দেহে আসা যাওয়া করেন ॥ : মন বেড়ী = মনরূপ বেড়ী বা শৃঙ্খল ॥ : আটকুঠুরী = মুখ, মস্তক, কপোল, গ্লীবা, বাম স্তনের নিচে নাভী, মেরুদণ্ড ও মূলাধার ॥ : নয় দরজা = চক্ষু, কর্ণ নাসিকা (ছয় দ্বার) এবং মুখ, উপস্থ, গুহ্য (তিন দ্বার) ॥ : ঝরকাটা কালবের রন্ধ্রসমূহ ॥ : সদর কোঠা = সহস্রা বা মস্তিক্য ॥ : আয়না মহল = জ্ঞান পদ্ম বা আজ্ঞাচক্র, যেখানে রূপ প্রতিভাত হয় ॥ : ফে’র = দুর্ভোগ ॥ : খাঁচার আশে = দেহের উপর নির্ভরতা ॥ : কাঁচা বাঁশে = ক্ষণভঙ্গুর বা নশ্বর বস্তুতে সৃষ্ট ॥ : পড়বে খ’সে = মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যার পরিসমাপ্তি ঘটবে ॥
ভাবার্থ : এই পদটি দেহতত্ত্ব দাড়ার অন্তর্গত দাড়ার পরিচিতি হচ্ছে, স্রষ্টার সমগ্র সৃষ্টবস্তুর মধ্যে অন্যতম ও স্বার্থক সৃষ্টি হল মানব দেহ অবকাঠামো। ফকিরগণের সাধন-ভজনের ক্ষেত্রে বা কেন্দ্রও হচ্ছে এই মানব দেহ। তাদের স্থির বিশ্বাস “অটল সাঁই” মানবের দেহভান্ডে অবস্থান করে মানবের সঙ্গে তার আনন্দানুভুতি ও সুখ-দু:খের সমভাগিদার রুপে বিরাজ করেন। সেই জন্য এই দেহভান্ডটি তাদের কাছে কাবা ঘরের সমতুল্য। তারা বলেন, আরবের কাবা ইব্রাহীম খুলিলের তৈরী, কিন্তু দেহ কাবার স্থপতি হচ্ছেন সাঁই স্বয়ং অর্থাৎ তিনি নিজে তৈরী করেছেন। অর্থাৎ দেহ ভজলেই তাঁকে ভজনা করা হয়।
এই পদে পদ কর্তা বলছেন যে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকে প্রতীকী নাম দিয়ে সাধন ভজন প্রক্রিয়া সংগঠিত হয়ে থাকে। সাধু শাস্ত্রানুযায়ী কাম ও কর্ম ইন্দ্রীয় আঠকিয়ে আট কুঠুরী ও নয় দরজার সাধন ভজন করতে হয়।
পিঞ্জিরা স্বরূপ দেহভান্ডে সদা জাগ্রত আত্মা রূপী কর্তা অর্থাৎ সাঁই সর্বদা হওয়ার রূপ ধরে দমের মাধ্যমে দেহাভ্যন্তরে আসা যাওয়া করেন। সেই জন্যই মানবাত্মা দেহ নির্ভর, অর্থাৎ দেহকে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকে। কিন্তু মনের দোষে আমি কোন দিন তার সন্ধ্যান পেলাম না। গুরুগুণগ্রাহী ও সৎ গুণ সম্পন্ন মানুষ সাধন ভজন গুণে হয়তো বা তার দর্শন পেলেও পেতে পারেন।
এক্ষণে বিশ্ব মানবতার জাগ্রত প্রহরী মহাত্মা লালন ফকির বেদনাহত চিত্ত্বে অধিক কাতর হয়ে রোদন ভরা কণ্ঠে বলছেন যে, ক্ষণভঙ্গুর নশ্বর দেহ নিয়ে গর্ব করা কখনই কারও উচিত নয়। কারণ এই দেহ একদিন কালের আবর্তে বিলীন হয়ে যাবে, এবং অতি আদরে পোষা প্রাণ পাখিটিও এই সাধের খাঁচা ছেড়ে পালিয়ে যাবে। তখন জাগতিক কারণে দেহ খাঁচাটি মাটির গর্ভে নিপতিত হয়ে বিলীন হয়ে যাবে। পঞ্চভূতে সৃষ্ট দেহভান্ডটির পরিসমাপ্তি এমনি ভাবেই ঘটবে।
(নিয়ামত মাষ্টারের ১১০৯ টি লালনগীতির ভাবার্থ থেকে সংকলিত)