লালনগীতির ভাবার্থকরণ অত্যন্ত দুরুহ কাজ। আমার মত অবোধের পক্ষে তা আরও কঠিন। শুধুমাত্র অতি উৎসাহী লালনগীতি প্রেমিদের পুনঃ পুনঃ তাগিদের কারণে গানগুলির ভাবার্থ করতে চেষ্টা করেছি মাত্র। ভুলত্রুটি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রিয় ও পরম শ্রদ্ধেয় পাঠকবৃন্দ, আপনারা নিজগুণে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে মার্জনা করবেন। আমার এই প্রয়াস সার্থক হলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করবো।
আমার বিভিন্নভাবে সংগৃহিত ১১০৯ টি লালনগীতির ভাবার্থ করেছি। প্রথমে গীতিগুলিকে দাড়াভুক্ত করে নিয়ে তাকে সংজ্ঞায়িত করেছি। কারণ দাড়ার সংজ্ঞা না জানলে ভাবার্থ বোঝা কঠিন হয়। অত;পর ছন্দের মধ্য হতে কঠিন কঠিন শব্দ বেছে নিয়ে তার শব্দার্থ ও প্রয়োজনবোধে গূঢ়ার্থ করেছি। আমি লালনগীতি ও ভাব-সংগীত হতে ৮২ টি দাড়া খুজে পেয়েছি। দাড়া হচ্ছে ধারা বা পর্যায় (রবীন্দ্র কাব্যে প্রেম, পূজা বাউল পর্বের উল্লেখ আছে ঠিক তেমন)। প্রয়োজনবোধে আগামীতে এতদবিষয়ে বিশ্লেষণের আশ্বাস রইল।
লালনগীতির ভাবার্থ বুঝতে হলে নিম্নোক্ত নির্দেশনাগুলি দেখা আবশ্যক :
১) প্রথমে নিজের মনকে ধর্মনিরপেক্ষভাবে স্থির করে নিতে হবে।
২) লালনগীতি গুলি প্রশ্ন ও উত্তর রীতি অনুযায়ী রচনা করা হয়েছে। আমিও ওই মত ভাবার্থ করেছি।
৩) লালনগীতি প্রধানত: দেহতত্ত্ব , ( যা আছে ব্রহ্মান্ডে তায় আছে দেহভান্ডে) গুরু শিষ্যের অকৈতব গোপনীয় সাধন ভজনরীতি ও বিভিন্ন ধর্মের মর্মবাণী এবং ফকিরী লোকজ ধর্মের রীতিনীতি নিয়ে রচিত হয়েছে। ভাবার্থের ক্ষেত্রে আমি যতটুকু বলা যায় শুধু মাত্র ততটুকুই বলেছি, বাদবাকী গুরু ধরে জানুন বলে (গু,ধ,জা) উল্লেখ করেছি ॥
৪) লালনগীতিতে ব্যবহৃত শব্দের অর্থ হবে ছন্দে ব্যবহৃত ভাব অনুযায়ী। আভিধানিক অর্থ না ও হতে পারে।
৫) ছন্দ অনুযায়ী ভাবার্থ করা হয়েছে। এই ভাবের কিছুটা ব্যত্যয় ও অসংগতি থাকলেও থাকতে পারে।
৬) ভাবার্থ করা হয়েছে ফকিরী লোকজ ধর্মের রীতিনীতির আঙ্গিকে। আমি শুধু কঠিন ভাবার্থের ক্ষেত্রে কঠিন কঠিন ভাব, তথ্যও তত্ত্বগুলিকে সহজ করে পরিবেশনের চেষ্টা করেছি মাত্র। এক্ষেত্রে আমার নিজেস্ব কোন পক্ষপাতিত্ব বা অভিমত নেই। যদি মনের অগোচরে কিছু এসে পড়ে তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
৭) লালনগীতির ভাবার্থকরণ প্রক্রিয়াটিতে একান্তই আমার নিজের মতামত প্রাধান্য পেয়েছে। এতে অন্যকোন লেখকের কোন কিছুই অনুসরন করা হয়নি।
লালনগীতি
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে দাড়া
তিন পাগলে হল মেলা নদেয় এসে ॥ গৌউর লীলা
একটা নারকেলের মালা, তাতে জল তোলা ফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সঙ্গে যাবি, পাগল হবি, বুঝবি শেষে ॥
একটা পাগলামী করে, জাত দেয় অজাতেরে, দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে, ধুলার মাঝে ॥
পাগলের নামটি এমন, বলিতে ফকির লালন, হয় তরাসে
আবার ওতে, নিতে, চতে পাগল নাম ধরে সে ॥
...............................................................................
শব্দার্থ : পাগল= বুদ্ধি প্রতিবন্ধি ॥ : নদেয় = নদীয়া জেলায় ॥: মেলা - মহামিলন স্থল ॥ : করঙ্গ + সমুদ্র নারকেলের মালা বা খোলা যা দ্বারা সাধু ফকিরগণ পানাহার করেন ॥ : তরাসে= ভয়ে ॥ : জাত দেয় অজাতেরে= নীচু জাতের হাতে খেয়ে গৌরাঙ্গ জাত খুইয়েছিলেন ॥ : ওতে = অদৈত ॥: নিতে = নিত্যানন্দ ॥ ; চতে= চৈতন্য মহাপ্রভু : তিন পাগল অদৈত, নিত্যানন্দ ও চৈতন্য মহাপ্রভু ॥
দাড়ার সংজ্ঞা = জগৎপ্রভু নারায়ণের অবতাররুপে শ্রীকৃষ্ণ মানব তারনের জন্য মানবে জন্ম গ্রহণ করে যে লীলা করে গেছেন তা লীলাকারী নামে পরিচিত এবং তিনি শ্রীরাধিকার প্রেম ঋণ পরিশোধনের জন্য কলিযুগে নদীয়া জেলায়শাচী গর্ভে জন্ম নিয়ে যে লীলা করে গেছেন তা চৈতন্যলীলা নামে খ্যাত।
ভাবার্থ : এই পদটি “লীলাকারী” দাড়ার অন্তর্ভূক্ত হলেও “চৈতন্য লীলোর” পর্যায়ভুক্ত। এখানে বলা হচ্ছে যে, তোরা কেউ তিন পাগলের (অদৈত, নিত্যানন্দ ও চৈতন্য) দলভুক্ত হোসনে, কারণ ঔ দলভুক্ত হলে তোদেরও ওদের মত পাগল অবস্থা হবে। ভাববাদী তিন পাগল রাধা কৃষ্ণের নাম সুধা বিতরণ উপলক্ষে নদীয়া নগরে প্রেম ভাবের মেলা বসিয়েছেন। প্রেম ও নাম বুভুক্ষগণ মেলায় গিয়ে হরিনাম সুধা ও প্রেমরসে মন প্রাণ ও অন্তর পরিতৃপ্ত করে নিচ্ছেন। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু জগৎবাসীর মহামিলনের জন্য উচ্চ নীচ, ধনী দরিদ্র সবাইকে প্রেম সুধারস বিতরণের মাধ্যমে একাকার করে দিচ্ছেন। তিনি নিজে অজাতের হাতে আহার করে নিজের জাত খুইয়েছিলেন। তাঁরা একটা নারকেলের ক্ষুদ্র মালাতে পানাহার করে জগতে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। গৌর যখন রাধাভাবে আপ্লুত হতেন, তখন তিনি ধুলার মাঝে গড়াগড়ি দিতেন। তাঁর জাগতিক জ্ঞান অবলুপ্ত হয়ে যেত।
পরিশেষে, মহাত্মা লালন ফকির বলছেন যে, ওই সকল প্রাত: নমস্য মহাপুরুষদের নাম মুখে আনতেও অন্তরে ভয় লাগে। কারণ মনে সন্দেহ থাকে যে, হয়তোবা কোন ত্র“টি বিচ্যুতি রয়ে গেল। তাঁরা মানব তারনের জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন ॥
(নিয়ামত মাষ্টারের লালন বিষয়ক ১১০৯ টি লালনগীতির ভাবার্থ থেকে সংকলিত)