আতিফা। আমাদের বাসার ছুটা কাজের বুয়া। বাড়ী ময়ময়নসিংহ। সিলেটের এক বাসায় কাজের বুয়া হিসেবে তার হাতেখড়ি হয়। তখন তার বয়স দশ। সেই থেকে শুরু। তার বাবা গৃহস্থ ছিলেন। নিজের অল্প কিছু জমি ছিল। গ্রামে একটা বাড়ীও ছিল। তিনি অনেক কিছু জানতেন। কিন্তু অভাব দূর করতে জানতেন না। আর যেটা তিনি জানতেন না তা হল লেখাপড়ার গুরুত্ব। আতিফা ক্লাস ফাইভে পড়ত। পড়া থেকে ছাড়িয়ে তাকে তিনি দূরদেশে কাজে পাঠান দুটো বাড়তি আয়ের জন্য। ওইটুকু বয়স থেকে সে খাটছে। খেটেই চলেছে। ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করার ফল হয়েছে এই যে, তার মুখের ভাষাটা হয়েছে আন্তর্জাতিক। সে যে কি বলে তার অর্ধেক আমার মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমার আম্মা এই বিরক্তিকর পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার পর থেকে সে আমাদের বাসায় কাজ শুরু করে। সেই হিসেবে সে বারো বছর ধরে আমাদের পরিচিত। আমার আম্মাকে সে দেখেনি। আম্মার ছবি দেখেছে, গল্প শুনেছে। আম্মার ছবি দেখতে দেখতে সে প্রায়ই একটা কথা বলত, এইরাম সংসার ফালাইয়া মনে করেন খালাম্মা শান্তিতো আছুইন? নাই নাই, শান্তিতো নাই।
আমাদের বাসায় একটানা ছয় বছর বাঁধা বুয়ার কাজ করার পর সে ঘোষণা দেয় যে সে আর এ বাসায় থাকবেনা। স্বাধীন ভাবে কাজ করবে। সারাদিন এক বাসার কাজ করতে তার নাকি ভাল লাগেনা। আসল কথা হল সে আমাদের বাসায় চলত নবাবের মত। কাজে সে যে ফাঁকি দিত তা নয়। বরং তার অতি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বাতিকের জ্বালায় দেখা যেত মাসের অর্ধেক যেতে না যেতেই কাপড় কাচার গুঁড়ো সাবান শেষ। হারপিক শেষ। সে যখন কাপড় কাচত সেই বাথরুমের পাশ দিয়ে যাওয়া যেতনা। কাপড় আছড়ানোর সময় বোমা পড়ার মত আওয়াজ হত। আমার মেজকাকা অন্যমনস্কভাবে একদিন বাথরুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। বাথরুমে আতিফা ঠিক তখনই আসুরিক শক্তিতে ভেজা কাপড় তুলে দিয়েছে এক আছাড়। মেজকাকা অ্যাই, অ্যাই, কি হল! কি হল! বলে ভয়ে কিচেনে ঢুকে কাঁপতে লাগলেন। আতিফার শারীরিক শক্তি ছিল দেখার মত। বছরে একবার আমার আম্মার খাটের আধমনী ওজনের তোষক জাজিম সে একাই খাট থেকে নামিয়ে কাঁধে করে ছাদে নিয়ে যেত ঝাড় পোঁছ করার জন্য। বাসার কোন ভারী কিছু সরাবার দরকার? ডাকো আতিফাকে। কোন উঁচু জায়গা থেকে কিছু নামানোর দরকার? ডাকো আতিফাকে। মাঝে মাঝে কলিং বেলের আওয়াজ পেলে সে দৌড়ে যেত দরজা খোলার জন্য আর আমার মনে হত ঘরের মধ্যে ভুমিকম্প হচ্ছে। আতিফার মূল সমস্যা ছিল সে আমার খালার মুখের উপর কথা বলত। আম্মা মারা যাবার পর আমার খালাই সংসারের কর্ত্রী হয়ে ওঠেন। আতিফা প্রায়ই খালার কথার অবাধ্য হত। আসলে কোন একটা ব্যাপারে সে যা ভাল মনে করত সেভাবেই সেটা করা সে পছন্দ করত। অন্য কেউ তাকে উপদেশ দিতে আসলে সেটা তার একেবারেই ভাল লাগত না। এভাবেই গন্ডগোলের সূত্রপাত। প্রায়ই তর্কাতর্কি হতে লাগল। এবং একদিন সে তার বোঁচকা প্যাটরা নিয়ে বিদায় হল।
বছর খানেকের মাঝেই সে আবার আমাদের বাসায় হাজির হয়। আমরা তাকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি। জাঁহাবাজ আতিফা তার বিশাল ডাইনোসরের মত শরীর নিয়ে বিদায় নিয়েছিল। ফিরে এসেছে টিকিটিকির মত হয়ে। এতটা পরিবর্তনের কারণ যে খেতে না পারা সেটা তখন চট করে বুঝে উঠতে পারিনি। জানলাম গ্রামে তার বিয়ে হয়েছিল। একটা ছেলেও হয়েছিল, কিন্তু জন্মের এক সপ্তাহের মাথায় ছেলেটা মারা যায়। ময়মনসিংহের আর পাঁচটা বুয়াদের বরের মত তার স্বামীও কিছুই করেনা। কিংবা বলা যায় রাজা উজীর মারে। আজ এটা ধরে তো কাল সেটা ছাড়ে, এই আরকি। আতিফা ফিরে এসেছে আবার বুয়ার কাজ করতে। তবে সে বাঁধা বুয়ার কাজ আর করবেনা। ছুটা বুয়ার কাজ করবে, আমরা যদি তাকে রাখতে চাই রাখতে পারি। আমার খালা একহাতে মঙ্গল গ্রহের চাঁদ ফোবোস আর অন্য হাতে ডিমোস পেলেও মনে হয় এতটা খুশী হতেন না। কারন এর মধ্যে কম করে হলেও পাঁচটা বুয়া তিনি চেঞ্জ করেছেন, কারো কাজই তার পছন্দ হয়নি। কথায় কথায় তিনি বলতেন, আতিফাকে কিছু বলতে হতনা। সব কাজ কি সুন্দর গুছিয়ে করত। আর এদেরকে এক কথা দশবার বলার পরও হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের কারণে আমার মাথার সব চুল পড়ে যাচ্ছে মাথা গরম হয়ে! সুতরাং আতিফা আবার কাজে বরাদ্দ হল। এবং যথারীতি সে নিজের জমিদারী প্রতিষ্ঠা শুরু করল। খালা প্রথম প্রথম খুশীতে গদগদ থাকতেন। কিন্তু অচিরেই তার ইগোতে সূক্ষ্ম জ্বলুনী শুরু হল যখন তিনি দেখলেন আতিফা আবার তার মুখের উপর কথা বলা শুরু করেছে। আবার তিনি যেভাবে মাসের শুরুতে গুঁড়ো সাবানের হিসেব করছেন, মাসের মাঝামাঝি আসতেই তা মেলানো যাচ্ছেনা। আতিফা বাথরুমে থাকলে মেজকাকা আবার খুব সাবধানে বাথরুমের পাশ দিয়ে যাতায়াত করেন। আবার শুরু হল গন্ডগোল। এবং একদিন আবার পত্রপাঠ বিদায়।
আতিফা এখন আমার খালার বাসায় সপ্তাহে একদিন কাজ করে। খালার সাথে এটা তার সপ্তম যুদ্ধ বিরতি চলছে। সে আমার বাসায় কাজ করে সপ্তাহে পাঁচদিন। শুক্র আর শনিবারটা আমরা তাকে ছুটি দিয়েছি। তারপরেও বাসায় আমরা দুজন কখন থাকি না থাকি তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই বলে প্রায়ই বহ্নি ওকে ফোন করে আসতে নিষেধ করে দেয়। এমনও দেখা যায় সে মাসে পাঁচ দিন কাজ করেছে কিনা সন্দেহ। আতিফা নিজেই প্রায়ই বহ্নিকে ফোন করে ধমক দিয়ে বলে, আজকেও আসুম না? বাথরুম কবে ধুইছি মনে আছে আপনার? এইভাবে কাম না করলে চলব? ওকে দিয়ে না করালেও বহ্নি কোন কাজ ফেলে রাখেনা। আতিফাকে আমরা কিছুটা ব্রেক দিতে চাই। ওর একটা মেয়ে আছে তিন চার বছরের। তাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। সে তাকে সুরভি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। তার স্বামীটা অপদার্থ। তাকে সে রিকশা কিনে দিয়েছিল। কিছুদিন চালানোর পর সে রিকশাটা বিক্রি করে ফেলে। আতিফা তার নিজের জমানো টাকা দিয়ে তার স্বামীকে ড্রাইভিং শিখিয়েছে। সে লোক কিছুদিন অন্যের সিএনজি চালিয়েছে। এখন তার নিজের সিএনজি দরকার। নিজের সিএনজি ছাড়া নাকি তার রাস্তায় বের হতে ভাল লাগেনা। আতিফাকে সে বলছে সিএনজির টাকা জোগাড় করে দেবার জন্য। আমরা বুঝতে পারি তার বর তার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাচ্ছে। কিন্তু আতিফার ভাষায় তার বরটা আলাভোলা। হাবাগোবা টাইপের একটা মানুষ। আতিফা আমার বাসায় এসে মাঝে মাঝে কোন কাজ না করে উদাস হয়ে বসে থাকে। সে বহ্নিকে ডাকে বউ-বেগম। সে বলে,বউ-বেগম, আমি আর কতদিন কাম করমু বলেন তো? সেই কবে ছোট বেলা থেইকা কাম করতেছি, কিছু তো জমাইতে পারলাম না! সে স্বপ্ন দেখে তার মেয়েটা অনেক পড়ালেখা করবে। তার দেশের বাড়ীতে সে একটা ছোট ঘর তুলবে। একটা ছোট পুকুর থাকবে। সেখানে সে তার মেয়েকে নিয়ে আর তার আলাভোলা স্বামীকে নিয়ে জীবনের কোন এক অজানা সুখের সময় সে পার করবে। সেই সময়টা যে কবে সেটাই শুধু সে জানে না।
--------------------------------------------------------------------
Young Stranger!
I've been a ranger
In search of pleasure throughout every clime;
Alas! 'tis not for me!
Bewitch'd I sure must be,
To lose in grieving all my maiden prime.
- John Keats. [1795–1821]