স্যার, মাছি লাগবে? ভাল জাতের মাছি ছিল স্যার। আঁতকে উঠে পাশে তাকাই। আকাশের অবস্থা ভাল না দেখে একটু আগে আগে বাসায় যাবার জন্য বেরিয়েছি। রাস্তায় একটা রিকশাও নেই। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। কোন ফাঁকে উদ্ভট, ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরা ঝোলা কাঁধে এক লোক আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। বললাম, মাছ কিনবনা এখন। হাতের ঝাপটায় লোকটা আর বাজে আবহাওয়া দুটোকেই তাড়ানোর চেষ্টা করলাম। সে বুকপকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, মাছ কেন হবে? আমাকে দেখে কি মাছওয়ালা মনে হয়? মাছের ঝুড়ি দেখতে পাচ্ছেন আমার সাথে? - তাহলে? আমি বোকার মত তাকিয়ে থাকি। - মাছ নয় স্যার, মাছি। ঝোলা থেকে একটা হরলিক্সের বোতল বের করে সে আমাকে দেখায়। - এখানে উন্নত প্রজাতির মাছি আছে, পোষা। পোষা মাছি? খাবি খাব কিনা চিন্তা করতে গিয়ে কাশি দিয়ে ফেলি একটা। - ফাজলামী করছেন? মাছি পোষ মানে? - কেন মানবেনা স্যার? মাছ পেলেছেন কখনও? অ্যাকুরিয়ামে? তারা যদি পোষ মেনে যায়, তাহলে মাছি পোষ মানতে সমস্যা কি? সমস্যা যে কি তা চট করে মাথায় এলনা। এদিকটায় বেশ অন্ধকার। আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছেনা। কয়েক বছর আগে আট নম্বর লেকের পাশের গলিটায় ঠ্যাকু বাবাদের পাল্লায় পড়েছিলাম। অন্ধকার গলিতে আমার রিকশাটা হঠাৎ থেমে যায় আর পাশের রিকশা থেকে এক লোক আমার কাছে এসে বলে, ভাইয়া থাকেন কোথায়? লোকটা এখনও যদি তার প্রোফেশনাল ক্যারিয়ার চালিয়ে যায় তবে আমার কথা সে মনে রাখবে। সে কিছু বোঝার আগে, এমন কি আমি নিজেও পুরো ব্যাপারটা বোঝার আগে এমন ঝেড়ে দৌড়টা যে দেব সেটা দৌড় দেবার আগ পর্যন্ত আমি নিজেও জানতাম না। এখানেও সেরকম কিছু হতে যাচ্ছে কিনা মনে মনে ভেবে একটু সতর্ক হলাম। ভেজা ম্যাচে লোকটা বিড়ি ধরাতে না পেরে বিড়িটা আবার পকেটে রেখে বলল, আপনি কি ভাবছেন আমি ছিনতাইকারী? তা নয়। এই যে হরলিক্স এর বোতল দেখছেন, এতে চল্লিশটা মাছি আছে। সব পোষ মানা। সবগুলো স্ট্রঙ্গার এবং শার্পার। তবে টলার নয়। যে কাজে এগুলোকে লাগে তাতে টলার হবার দরকার নেই। লম্বা মাছি জোরে উড়তে পারেনা। আমি বোকার মত তার কথাগুলো শুনতে থাকি। - নেবেন নাকি? অনেক কাজের কিন্তু। এবার বিরক্ত লাগে। এই সময়টায় রিকশা পাওয়া কঠিন ঠিকই, তবে একটা দুটো পাওয়া যায়। কিন্তু আজকে যেন এরা প্রতিজ্ঞা করেছে বৃষ্টিতে বের হবে না। হুশ করে পাশ দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল। আমি বিরক্ত হয়ে হাঁটা দেব ভাবছি। লোকটা আবার বলল, শুনুন। ভাবছেন মাছি আর কি কাজে লাগে তাইতো? মাছের বাজারে গিয়েছেন কখনো? এত যে মাছি দেখেন মাছের গায়ে, ভাবছেন সেগুলো এমনি এমনি মাছের গন্ধে উড়ে আসে? কক্ষনো নয়। আমরাই সেই মাছি মাছওয়ালারদের সাপ্লাই করি। ঘন্টা হিসেবে ভাড়াও দেই। তবে কিনে নিলেই লাভ বেশী। মাছে ফরমালিন নেই এটা বোঝানোর জন্য অনেকেই আজকাল মাছি কিনছে। কিন্তু ঢাকা শহরে এত মাছি পাবে কোথায়? আমরাই সাপ্লাই দেই। ট্রেনিং পাওয়া মাছি এরা। মাছের মাথার কাছটায় গিয়ে গিজ গিজ করে। কতগুলো আবার লেজের কাছটায়। যাকে যেভাবে ট্রেনিং দেয়া হয় সে সেভাবেই মাছকে ঘিরে মচ্ছব বসায়। লোকেরা ভাবে আহা! এত মাছি ভনভন করছে, মাছে ফরমালিন থাকতেই পারেনা! সব গর্দভের দল! ফরমালিন ছাড়া মাছ হয় আজকাল? আগে তো তাও মাছে কম ফরমালিন মাখানো লাগত। এখন চাহিদা এত বেড়ে গেছে যে একেবারে বলার বাইরে! কেন জানেন? এই মাছিগুলোর জন্যই। ফরমালিন খেয়ে খেয়ে একেবারে নেশাগ্রস্তের মত হয়ে যায় এরা। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, যে মাছে ফরমালিন নেই সেটাতে বসতেই চায় না এরা! বাধ্য হয়ে মাছয়ালারা তাদের মাছে ফরমালিন মাখিয়ে রাখে যাতে এরা সেগুলোতে বসে ভনভন করে। এদিকে আবার ফরমালিন বিরোধী অভিযান চলছে। না খেতে পেয়ে আমার সোনামানিকগুলো মারাই যায় কিনা রীতিমত টেনশনে আছি!
আমি বিরক্তির বদলে এখন বিস্ময়ের সাথে তার কথা শুনছি। মাছি ভাড়া খাটানো যায়? মাছি ফরমালিন খায়? পাগল নাকি? একটু দূরে সরে দাঁড়াই। বলা যায়না। ঘ্যাঁক করে কামড় দিয়ে বসতে পারে। কিংবা জাপ্টে ধরতে পারে। সোনারগাঁ হোটেলের সামনে একবার এক দিগম্বর পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম। একে অবশ্য তার তুলনায় ভদ্র মনে হচ্ছে। তাও বলা যায়না। সে পকেট থেকে একটা ম্যাচের কাঠি বের করে সেটা দিয়ে চোখ বুজে পরম আরামে কান চুলকাচ্ছে। একচোখ বুজে, অন্যচোখে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, আপনি ওই সামনের অফিসটায় কাজ করেন না? আমি দেখি আপনাকে প্রায়ই। অনেক বছর ধরেই তো আছেন মনে হয়, তাইনা? আমি কি বলব বুঝতে পারছিনা। এ ব্যাটা আমাকে ফলো করে নাকি? আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই মনে হয় সে বলল, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আপনাদের বাবুর্চির কাছে মাছি বিক্রি করতে গিয়েছিলাম। সে নেয়নি। কেন জানেন? তার নিজেরই এ ব্যবসা আছে। আমাকে সে চিনে ফেলেছে। সে যে প্রতিবছর আপনাদের অফিসে আম নিয়ে আসে চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে, সেগুলো কি কার্বাইড আর ফরমালিন ছাড়া আম বলে মনে করেন? কক্ষনোই না! ফল আর মাছের ব্যবসা যারা করে তারা দুটো জিনিস ছাড়া ব্যবসা করতে পারবেনা। এক হল ফরমালিন, আরেক হল কার্বাইড। আর আমার মাছি হল তাদের ব্যবসা ধরে রাখার জন্য সামান্য একটা অনুঘটক আর কি! এবার একটু কাছে এগিয়ে এসে গলার স্বর নামিয়ে সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি ফল খান? আমি বলি, খাই, তবে না খাওয়ার মতই। - মাছ খান? - সেও ওই না খাওয়ার মতই। সে বিরক্ত হয়ে দূরে সরে যায়। - খাওয়াটা একেবারে বাদ দিতে পারেন না? একবছর কোন ফল খাবেন না। কোন মাছ খাবেন না। দেখেন তারপর কি হয়! আমি বললাম, কি হবে তাহলে? - ধনে প্রাণে মারা পড়বে বদমাইশগুলো। কত ফরমালিন মাখাবি, কত কার্বাইড মাখাবি, মাখা। কেউ যদি তোদের পসরা না কেনে, তাহলে বুঝবি মজা! আমি বলি তাহলে আপনার ব্যবসার কি হবে? মাছি বেচবেন কিভাবে? সে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকায়। - আপনার তো কোন বিজনেস বুদ্ধিই নেই মনে হচ্ছে। তাহলে তো আমার আরো পোয়াবারো। আরো বেশী মাছি বেচব ওদের কাছে! সারাদিন বসে থেকেও কেউ যখন আসবেনা তাদের কাছে, কিছুই যখন বিক্রী হবেনা তখন করবেটা কি ব্যাটারা? মাছিই তো মারতে হবে নাকি? সে মাছি টা আসবে কোথা থেকে বলুন?
সে একগাল হেসে আমাকে আবার হরলিক্সের বোতলটা দেখায়।