মানুষ পাগল হয় কেন? অল্পবয়সে প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল। একটা সময় ছিল যখন কৌতুহল থেকে আমি পাগলদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছিলাম। এ ব্যাপারে আমার সবচেয়ে রিসোর্স ফুল গাইড ছিলেন আমার এক প্রতিবেশী। পাগলের ব্যাপারে তার ফার্স্ট হ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স ছিল। কারণ তিনি পাগল ছিলেন। আমার বয়স তখন তের। থাকি রায়েরবাজার নিমতলায় চারতলার একটা ফ্ল্যাটে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে তিনি থাকতেন। অনেক ভাইবোনের পরিবারে এই মানুষটি যে অন্যদের থেকে আলাদা তা আমার তের বছর বয়সেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি। ওনার নাম ছিল জাবের। ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়স। আমি তাকে ডাকতাম জাবের মামা। জাবের মামারা ছিলেন আট ভাইবোন। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি তৃতীয় বা চতুর্থ। বাবা মা ছিলনা। বড় দুই ভাই এর সংসারে তিনি থাকতেন। তার থেকে ছোট কয়েক ভাই বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তারা আলাদা থাকত। সঙ্গত কারণেই তার ভাই বোনেরা তাদের অসুস্থ এই ভাইয়ের কোথাও বিয়ে দেবার চেষ্টা করেন নি। পাগলদের সম্পর্কে আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে। প্রায়ই বলা হয় অমুক অনেক মেধাবী ছিল। বেশী পড়ালেখা করে পাগল হয়ে গেছে। আমার মা-ও জাবের মামা সম্পর্কে বলতেন এ কথা। তিনি নাকি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পড়ালেখার অতিরিক্ত চাপ নিতে গিয়ে পাগল হয়ে গেছেন ইত্যাদি। আমি অবশ্য ওনার মেধার তেমন কোন প্রমাণ পাইনি। একটা কাজ তিনি ভাল পারতেন। ঘুড়ি গোত্তা খেলে সেটাকে ব্যালেন্স করার জন্য ঘুড়ির একদিকে কাগজের ছোট টুকরা লাগাতে হয়। এটাকে “ফেরা” বলে। একবার গোত্তা খেতে শুরু করলে সে ঘুড়ি কন্ট্রোল করা কঠিন ছিল। ঠিক মাপের ফেরা লাগানোটাও কঠিন ব্যাপার। তিনি অসম্ভব দ্রুততার সাথে মাপ মত ফেরা লাগিয়ে গোত্তা খাওয়া ঘুড়ি ব্যালেন্স করে দিতে পারতেন। এটাকে যদি মেধা বলা যায় তিনি অবশ্যই মেধাবী ছিলেন। আমাদের বয়সী ছেলেদের সাথে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ানোকেও ওনার মাথা খারাপের একটা লক্ষণ হিসেবে দেখা হত।
ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়া তার কাজ কর্মের কিছু নমুনা দেওয়া যেতে পারে। লাল ইটের তৈরি সেই চমৎকার বাড়ীটার একটা কুৎসিত ব্যাপার ছিল, যেটা বাইরে থেকে বোঝা যেত না। আমাদের ফ্ল্যাটের একটা কমন বাথরুম ছিল বাসার বাইরে। বাসায় ঢোকার মূল দরজার পাশে ছিল সেটা। একই ভাবে জাবের মামাদের কমন বাথরুম ছিল ঠিক তার পাশে। পাশাপাশি দুই বাথরুম। বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে এগুলো বাথরুমের দরজা। আমরা আমাদের কমন বাথরুম কখনোই ব্যবহার করতাম না। জাবের মামাদের বাসায় অনেক সদস্য বলে তারা নিজেদের বাসার বাথরুম ছাড়াও এই দুটো ব্যবহার করতেন। তাতে আমাদের কোন আপত্তি বা সমস্যা ছিলনা। জাবের মামার জন্য বাইরের কমন বাথরুম বরাদ্দ ছিল। তিনি যে কাজটা করতেন তা হল বাথরুমে যাবার সময় আমাদের কলিংবেল বাজাতেন। কেউ দরজা খুললে বলতেন, বাথরুমে যাব। তাকে বাথরুমের দরজা দেখিয়ে দেবার পর তিনি শান্ত ভঙ্গিতে বাথরুমে ঢুকে যেতেন। দিনের মধ্যে আমাদের কম করে হলেও দশ থেকে পনের বার কলিং বেল শুনে দরজা খুলতে হত এবং ওনাকে বাথরুমে যাবার অনুমতি দিতে হত। এছাড়া প্রায়ই যেটা করতেন তা হল দরজা খোলা পেলেই তিনি যে কারো বাসায় ঢুকে যেতেন এবং সোফায় বসে পেপার পড়া শুরু করতেন। পেপার না পেলে সোফায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ভদ্রভাবে বাসায় যেতে বললে তিনি চলে যেতেন। না বললে শুয়েই থাকতেন। খাবার সময় হলে তার বাসার কাজের লোক তাকে খুঁজে বের করে বাসায় নিয়ে যেত। এই উদ্ভট ব্যাপারটায় সবাই বিরক্ত হত, কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য কোন ফ্ল্যাটের কেউ কোনদিন তার পরিবারের কাছে ব্যাপারটা নিয়ে অভিযোগ করেছে বলে শুনিনি। মানুষের মধ্যে মানবিকতাটা হয়ত তখন একটু বেশী ছিল।
পাশাপাশি বাসা হবার কারণে কিনা জানিনা আমাদের বাসাতেই তিনি আসতেন বেশী। কোন এক কারণে আমাকে একটু পছন্দও করতেন। আমার মনে আছে আমি ওনার সাথে অনেক গল্প করতাম। কথা যা বলার আমিই বলতাম। তিনি চুপ করে শুনতেন। মাঝে মাঝে কথা বলতেন। খুব নীচু স্বরে, কেউ শুনে ফেলবে এমন ভঙ্গিতে কানের কাছে মুখ নিয়ে তিনি কথা বলতেন। আমাকে তার জন্য পেপার পড়ে দিতে হত। চোখ বন্ধ করে তিনি আমার পেপার পড়া শুনতেন। মাঝে মাঝে মন্তব্য করতেন। মন্তব্যগুলো শুনে আমার কাছে তাকে সুস্থই মনে হত। এটা মনে আছে যে একবার ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উনি পাগল হলেন কিভাবে। তিনি বলেছিলেন তিনি পাগল না। তবে তার মাথায় একটা পোকা আছে। পিঁপড়ার মত পোকাটা নাকি তার মাথার ভেতর হাঁটাহাঁটি করে। তখন তার অস্থির লাগে। আমি জিজ্ঞেস করতাম পোকা হাঁটে কেন। তিনি বলতেন, পোকার তো আলো বাতাস দরকার। মাথার ভেতর অন্ধকার। পোকা আলো খাওয়ার জন্য বেরিয়ে আসতে চায়। এ জন্যই হাঁটাহাঁটি করে। তার সহজ স্বাভাবিক কথাবার্তায় আমার নিজেরও মনে হত তিনি পাগল নন। তবে তার মাথার পোকার ব্যাপারটা সত্যি হতে পারে। এই পোকাটা সবচেয়ে বেশী হাঁটাহাঁটি করত পূর্ণিমার সময়। আকাশে ভরাট চাঁদ আর তিনি নিজের বাসাতে বসে আছেন এটা হতেই পারেনা। জগত উদ্ভাসিত করে যেদিন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ থাকত সেদিন জাবের মামা পাঁচতলা বেয়ে একবার ছাদে উঠতেন, আরেকবার রাস্তায় নামতেন। অস্থির হয়ে উঠতেন তিনি। আর যেটা করতেন তা হল দুহাত দিয়ে নিজের দুই কান ডলতেন। ডলতে ডলতে চামড়া উঠিয়ে ফেলতেন। আমি অবাক হয়ে রক্তাক্ত কানে জাবের মামার ছোটাছুটি দেখতাম। একবার উনি আমাকে বলেছিলেন পাগল দুইরকম। চন্দ্রপাগল আর সূর্যপাগল। চন্দ্রপাগল হল যাদের মাথার পোকা চাঁদের আলো খায়। আর সূর্যপাগলদের মাথার পোকা সূর্যের আলো খায়। উনি নিজে হচ্ছেন চন্দ্রপাগল। এসব লেখার সময় এখন বুঝতে পারছি আমি ওনার কথাগুলো বিশ্বাস করতাম। এখনও অবিশ্বাস করছিনা। হতেও তো পারে। আমরা কতটুকুই বা জানি। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ওনারা সে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যান। জাবের মামার সাথে আমার এর পরে আর কখনো দেখা হয়নি।
জাবের মামা আমার জীবন থেকে বিদায় নিলেন। কিন্তু রেখে গেলেন অপ্রকৃতিস্থ মানুষের প্রতি আমার অপরিসীম কৌতুহল। তারপর থেকেই আমি রাস্তাঘাটে অস্বাভাবিক কাউকে দেখলে তার কাজকর্ম লক্ষ্য করতাম। অবশ্যই নিরাপদ দূরত্বে থেকে। আমার অবজার্ভেশন হচ্ছে ঢাকা শহরের অধিকাংশ পাগলই ড্রেস অ্যাজ ইউ লাইকের সাজা পাগল। এরা সবাই সুস্থ স্বাভাবিক। জীবিকার তাগিদে কিংবা অন্য কোন কারণে তারা পাগলের অভিনয় করে। এরকম এক পাগলের পাল্লায় একবার পড়েছিলাম সোনারগাঁ হোটেলের পাশের সিগন্যালে। ভর দুপুর বেলা আমি আর বহ্নি সিএনজি করে যাচ্ছি। কঠিন জ্যামে বসে আছি। ঢাকা শহরে তখনও সিএনজির দুপাশে দরজা লাগানোর চল হয়নি। হঠাৎ আমার পাশ থেকে এক লোক এসে বলল, বিশটা টাকা দে। তাকিয়ে দেখি পুরো দিগম্বর এক লোক। এক হাত বাড়িয়ে সে টাকা চাইছে। অন্য হাতটা মুঠো করে সামনের দিকে বাড়ানো। সেখান থেকে হলুদ বর্ণের কিছু উঁকি দিচ্ছে। দুর্গন্ধেই বস্তুটা তার পরিচয় জানান দিচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর মুঠো করা হাতে সে কি নিয়ে এসেছে এবং আমি যদি তার কথা না শুনি সে কি করবে। আমি বহ্নির দিকে তাকালাম। যা ভেবেছিলাম তাই। রাগে সে থমথম করছে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে আর পাঁচটা মেয়ের যেখানে ভয়ে আধমরা হয়ে যাবার কথা সেখানে সাধারণত তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। পাগল কি করবে জানিনা কিন্তু আমি কিছু না করলে সে যে পাগলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং একটা তুলকালাম হবে সেটা বুঝতে পারছিলাম। এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি ওর কিছুই হবেনা। মাঝখান থেকে ওকে ছাড়াতে গিয়ে আমি হাগু মেখে গোসল হয়ে যাব। দৃশ্যটা কল্পনা করেই শিউরে উঠলাম। তাড়াতাড়ি মানিব্যাগ বের করলাম। মানিব্যাগে একটা দশটাকার নোট ছাড়া কোন খুচরো টাকা নেই। পাঁচশ টাকার নোট আছে কয়েকটা। আমি তাকে দশ টাকার নোটটা দিলাম। সে বলল, বিশ টাকা দে। বড় নোট দে। ততক্ষনে আমার মাথাও গরম হয়ে গেছে। ব্যাটা বদমাশ। হাতে হাগু নিয়ে দিনেদুপুরে ডাকাতি করছে! আমি নিজেও এককালে অনেক ত্যাঁদড়ামি করেছি। বেশী ঝামেলা করলে ওর হাগুই ওর গলা দিয়ে ঠেসে দেব ঠিক করলাম। শান্ত গলায় বললাম, আমার কাছে আর কোন ভাংতি নেই। যা আছে তাই দিলাম, রাস্তা মাপ এবার। পাগলদের সিক্সথ সেন্স ভালই থাকে। আর এতো সাজা পাগল। আমার দিকে তাকিয়ে সে বুঝল যে তার ট্রিক এখানে খাটাতে গেলে খবর আছে। সে কেটে পড়ল।
মাঝে মাঝেই রাস্তাঘাটে অপ্রকৃতিস্থ লোকজন চোখে পড়ে। পাগল সাজার জন্য রাস্তায় জামাকাপড় ছেড়ে যারা ঘোরে তারা যদি পাগল নাও হয়, কতটা খারাপ পরিস্থিতিতে পড়লে এরকম একটা কাজ তারা করে সেটাই ভাবি আমি। পাগল সেজেও যে তারা খুব শান্তিতে থাকে তা তো মনে হয়না। আমাদের দেশে পাগলদের উত্তক্ত করা হচ্ছে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ঢাকা শহরে ব্যাপারটা অনেক কম হয়। মফস্বলে কিংবা গ্রামে পাগলদের উত্তক্ত করাটা যে শুধু সাধারণ তা নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে সেটা নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পড়ে। রহিম নামে আমাদের গ্রামে এক পাগল ছিল। পাগলদের সাথে রসিকতা করাটা গ্রামের লোকজনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটা ব্যাপার। রসিকতার অংশ হিসেবে একবার একটা সুপুরী কাটার ছরতা রহিমের এক হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। কেউ একজন রহিমের অন্য হাতের একটা আঙ্গুল ছরতার নিচে বসিয়ে বলে, রহিম চাপ দে তো দেখি। রহিম বোকার মত চাপ দিয়ে তার আঙ্গুল কেটে ফেলে। এই গল্প যতবার গ্রামে গেছি আমাকে ততবার শুনতে হয়েছে। গল্পকার হাসিমুখে গল্পটা বলেছে আর আমি শিউরে উঠেছি। রহিমকে আমি কাছে থেকে দেখেছি। বোকাসোকা একজন মানুষ। আমি গেলেই তিনি দেখা করতে আসতেন। হাসিমুখে আমার সাথে গল্প করতেন। তার একটাই গল্প। কোন একবার গ্রামে বেড়াতে এসে আমার মা তাকে সীমের বিচি রান্না করে খাইয়েছিলেন, সেই গল্প। গল্প করতে করতেই হঠাৎ জিজ্ঞেস করতেন, তোমার মা আসেনি এইবার? আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আমার মা যে অনেকদিন আগে না ফেরার দেশে চলে গেছেন এটা তিনি মনে রাখতে পারতেন না। কিছুদিন আগে আমার আব্বা গ্রাম থেকে ফিরে জানালেন রহিম মারা গেছে। তার ডায়াবেটিস ছিল। তার পরিবার কখনোই গুরুত্ব দিয়ে তার চিকিৎসা করায়নি। পাগল মানুষ। এর চিকিৎসা করে কি হবে। এক সকালে বিছানায় হাসি হাসি মুখ করে পড়ে থাকতে দেখা যায় তাকে। সারাক্ষণ বোকার মত হাসতেন। গ্রামের সবার রসিকতার ঊর্ধে চলে যান হাসি মুখেই।
ধানমন্ডিতে একজনকে দেখতাম সারাক্ষণ দুই হাতে দুমুঠো মাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। মুখে হাসি। আলমাস শপিং মলের পাশের রাস্তায় তাকে বেশী দেখা যেত। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাকে দেখতাম। দুপুরের পরে তাকে দেখতাম না। অনেক দিন হল তাকে দেখিনা। আমার ধারণা প্রতিটা পাগলের কার্যক্রমের টাইম আর রেঞ্জ ভাগ করা থাকে। এক রাস্তার পাগল অন্য রাস্তায় যায়না। যার সকাল বেলায় পাগলামি করার কথা থাকে সে সকালেই করে, বিকাল বেলায় করেনা। মিতালী রোডে আমার খালার বাসায় যাবার গলিতে একটা প্লাস্টার বিহীন পুরনো দোতলা বাড়ী আছে। আশেপাশের হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্টের রাজত্বের মধ্যে এটা এখনও কিভাবে টিকে আছে সেটা এক রহস্য। এ বাড়ীর দোতলায় গলির দিকে মুখ করা একটা জানালায় একজন বসেন। এনার রেঞ্জ হল তার জানালা। আর তার টাইম হল সকাল দশটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত। এই সময়টাতে তিনি জানালার পাশে বসে চীৎকার করে মানুষকে গালাগালি করেন। এমন কোন গালি নেই যা তিনি দেন না। গলিতে কাউকে ঢুকতে কিংবা বের হতে দেখলেই চোখ বড় বড় করে গালাগালি শুরু করেন। যারা এ পাড়ায় নতুন তারা ভড়কে যায়। আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। একদিন একটা মজার ব্যাপার হল। খালার বাসা থেকে বের হয়েছি। বাসায় যাচ্ছি। পাশের গলি থেকে বোরকা পরা এক তরুণীও বের হল। দুজনেই গলি ধরে হাঁটছি। মেইন রোডে ওঠার গলি এই একটাই। গলির মাথায় পৌঁছানো মাত্র উপর থেকে চীৎকার, “শুয়োরের বাচ্চা বোরকা পইরা বাইর হইছস!!” মেয়েটা আমার পিছনে ছিল। তার হাঁটা বন্ধ হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি হতভম্ব হয়ে সে আশেপাশে তাকাচ্ছে। উপর থেকে সুধাবর্ষণ চলছেই। “ওই শালা হারামীর বাচ্চা ড্রাইভার! আমার গাড়ি কই? ওই ড্রাইভারের বাচ্চা আমার বোরকার টাকা ফেরত দে!! শালা ড্রাইভার তুই বোরকা পিন্দা গলিতে ঢুকসস!! শুওরের বাচ্চা!!” কাল্পনিক কোন এক ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে তার আগডুম বাগডুম চলতেই থাকল। মেয়েটা দেখি কাগজের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বুঝলাম এ পাড়ায় সে নতুন। আমি তাকে চুপচাপ গলি থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম। আমাকে দেখে পাগলের উৎসাহ বেড়ে গেল। মুখে ফেনা উঠিয়ে গালাগালি করতে লাগল। আমি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। দুপুর দু'টা দশ বাজে। তার ডিউটি এখনই শেষ হবার কথা। যা ভেবেছিলাম তাই। একটা চুড়ি পরা হাত দেখা গেল জানালায়। পাগলের মাথা মুছিয়ে দিচ্ছে। তার বোন? তার স্ত্রী? জানি না। কিন্তু পাগলের মাথা ঠান্ডা হয়ে যায় তাতে। আমি যতদূর জানি এখন সে খেতে যাবে। খেয়ে ঘুমাবে। প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময় সে তার জীবনের যত রাগ, ক্ষোভ, না পাওয়া উদ্গীরন করে গালাগালির মাধ্যমে। তার পর সে শান্ত হয়ে যায়। এলাকার লোকজন ব্যাপারটা জানে। তাই তারা এটাকে পারসোনালি নেয় না।
ইংরেজীতে পাগলের একটা প্রতিশব্দ হল Lunatic. উইকিপেডিয়া বলছে, The term lunatic derives from the Latin lunaticus which originally referred mainly to epilepsy and "madness" as diseases caused by the Moon. তার মানে কি? চাঁদের সাথে কি আসলেই পাগলামির সম্পর্ক আছে? জাবের মামা কি তাহলে সত্যিই চন্দ্রপাগল ছিলেন? জানি না। পাগলদের সব রাষ্ট্রীয় আইনের ঊর্ধে রাখা হয়। যতদূর জানি ধর্মীয় আইনেও পাগলদের কোন অন্যায়কে শাস্তির আওতায় আনার বিধান নেই। তারা মুক্ত স্বাধীন বিহঙ্গ। খালার বাসায় প্রায়ই যাই। গলিতে ঢোকা মাত্রই উপর থেকে “ওই শুয়ো...” ভেসে আসে। খুব সূক্ষ্ম একটা ঈর্ষা মাঝে মাঝে কাজ করে সে সময়। মনে হয়, ইশ! এত চমৎকার করে গালি দিচ্ছে। এরকম সুযোগ যদি কখনো আমি পেতাম! আহারে!