আমার বাসা থেকে অফিস যাবার পথে একটা রেস্টুরেন্ট পড়ে। নাম ডায়মন্ড হোটেল। ডালপুরি, সিংগাড়া কিংবা সমুচার মত দেবভোগ্য খাবার ছাড়াও সেখানে দুপুর এবং রাতে ভাত পাওয়া যায়। প্রচুর লোক খায়। ছোটবেলা থেকেই দেখছি রেস্টুরেন্টটার গেটআপে কোন পরিবর্তন নেই। আগে ঢাকা শহরের প্রায় সব রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডের একদিকে একটা মোরগ আর অন্যদিকে একটা হাস্যমুখী ছাগলের ছবি দেখা যেত। যারা খেতে আসবে তারা যেন দূর থেকে ছবি দেখে বুঝতে পারে সেখানে কি পাওয়া যায় সেজন্যই এ ব্যবস্থা। এসব হোটেলে ঢুকলে দেখা যায় একদিকের দেয়ালে অয়েলপেইন্ট দিয়ে ছোট একটা অংশ রঙ করা। সেখানে খাবারের মেনু আর দাম লেখা। কোন কোন খাবারের দামের উপর আবার অন্য রঙের ডাবল পেইন্ট। ডাবল পেইন্ট খাবারটার দাম পরিবর্তনের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে। ডায়মন্ড হোটেল হচ্ছে সেরকম একটা হোটেল। কলেজে পড়ার সময় প্রায়ই যেতাম সেখানে। চা খেতাম। দুটাকা করে কাপ ছিল। এক কাপ খাবার পর মনে হত আরেক কাপ খাই। এভাবে চার পাঁচ কাপ খেয়ে ফেলতাম। বাসায় আসার পর পাঁচ কাপ চায়ের সাথে খেয়ে ফেলা পোয়াখানেক চিনি শরীরে জানান দেয়া শুরু করত। শুরু হত গা গোলানো।
অনেক দিন হল ডায়মন্ড হোটেলে যাই না। তবে তার সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করি। আমার বাসা থেকে মঙ্গল গ্রহে যেতে হলেও ভদ্র রাস্তা এই একটাই। বাকী রাস্তাগুলো সব ভাঙ্গাচোরা। বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি হোটেলটার গা ঘেঁষে ছোট একটা মাংসের দোকান হয়েছে। সেই সাথে কয়েকটা কাক সারাক্ষণ মাংসের দোকানের আশেপাশে ওড়াওড়ি করে। এরা লক্ষ্য রাখে কোন উচ্ছিষ্ট ফেলা হচ্ছে কিনা। ফেলা মাত্রই ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। যদিও এদের প্রধান লক্ষ্য মাংসের দোকানের উচ্ছিষ্ট কাড়াকাড়ি করে খাওয়া, তবে এর বাইরে আরেকটা কাজ তারা গুরুত্বের সাথে করে। সেটায় পরে আসছি।
একদিন অফিসে যাচ্ছি। আমার পাশের রিকশায় অল্পবয়সী একটা মেয়ে আর মোটা ফ্রেমের চশমা পরা একটা ছেলে। জ্যামের মধ্যে বসে এদের কথা শুনছি। ইচ্ছা করে যে শুনছি তা না। ছেলেটার গলার স্বর বেশ মেয়েলী। মেয়েদের মত হাই পিচ ভয়েজে কথা বলে। হাই পিচ ভয়েজের কারণে তার নীচু স্বরে বলা কথাগুলোও আমার কানে আসছে। লক্ষ্য করলাম ছেলেটা যে শুধু মেয়েলী গলায় কথা বলে তা না, তার স্বাস্থ্য হাতুড়ী মার্কা সুতার চাইতে একটু ভাল। তবে খুব বেশী ভাল না। শুনলাম মেয়েটাকে সে টেনে টেনে বলছে, “তুমি যে আজ বের হতে পারবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।” মেয়েটা বলল, “কথা কম বল। হুড ওঠাও। এলাকার কেউ দেখলে সমস্যা হবে।” ছেলেটা হুড না উঠিয়ে তাচ্ছিল্যের ভাব করে মেয়েটার দিকে তাকাল। অল্পবয়স্ক ছেলেরা হৃদয় বৈকল্যের সময় অনেক রিস্ক নেয়। বুঝলাম ছেলেটা তাই করছে। মেয়েটাকে পিক করার জন্য তার এলাকায় এসে হাজির হয়েছে। এরা অনেক সময় এ ব্যাপারগুলোকে তাদের পৌরুষের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। রিস্ক আছে জেনেও এনিমি জোনে হাজির হওয়াটা এ ছেলের জন্য পৌরুষের কাজ। জ্যাম ছুটে গেল। আমার রিকশার আগে ওদেরটা চলে গেল। ডায়মন্ড হোটেলের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওদেরকে ক্রস করছি। শুনলাম মেয়েটা বলছে, “একটা টিস্যুও নাই তোমার কাছে? দেখি এদিকে তাকাও তো। এ মা ছিঃ!” তাকিয়ে দেখি ছেলেটার চশমার এক পাশের কাঁচে সাদা রঙের অর্ধতরল জাতীয় কিছু। তার গাল এবং ঠোঁটের একপাশ থেকেও সুজির হালুয়ার মত কিছু একটা ঝুলছে। মেয়েটা প্রাণপনে একটা টিস্যু দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। হুড না উঠিয়ে পৌরুষ দেখানোর ফল সে পেয়েছে হাতে হাতে। উপরে ইলেক্ট্রিক লাইন থেকে একটা কাক কৌতূহলী চোখে সেদিকে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত এটা তারই কাজ। মিশন কতটুকু সাকসেসফুল হয়েছে সেটা এখন সে সারেজমিনে পর্যবেক্ষন করছে বলে মনে হল।
আরেকদিন ডায়মন্ড হোটেলের সামনেই জ্যামে বসে আছি। হুড উঠিয়েই বসেছি। এ জায়গাটা দিয়ে হুড ফেলে যাবার প্রশ্নই আসেনা। পাশের রিকশায় এক ভদ্রলোক হুড ফেলে বসে আছেন। হুড ওঠালে তিনি বসতে পারতেন না বলেই আমার ধারণা। এরকম আজদহা আয়তনের কাউকে ঢাকা শহরে অনেকদিন চোখে পড়েনি। রিকশাওয়ালার জন্য মায়া হল। এই জিনিষ সে কিভাবে টানছে আল্লাহই জানে। রিকশার চাকা যে ফেটে যায়নি এটাই অনেক। জ্যামের মধ্যে বসে এই ভদ্রলোক এক নাগাড়ে প্রায় দশ মিনিট ধরে চীৎকার করে মোবাইলে কারো সাথে কথা বলে যাচ্ছেন। জ্যামে পড়লে সম্ভবত ঢাকার ড্রাইভারদের মাথায় শর্ট সার্কিট হয়ে যায়। বিন্দুমাত্র এগোনোর সম্ভাবনাও যেখানে নেই আমি দেখেছি সেখানেও তারা কিছুক্ষন পরপর হর্ন দিতে থাকে। এখানেও তাই হচ্ছে। কার হর্ন কত ডেসিবলের আউটপুট দিতে পারে সেটার কনটেস্ট হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তার উপর এই ভদ্রলোক চিৎকার করে কথা বলেই যাচ্ছেন। কথাগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছেনা। আশে পাশের সবাই বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল তিনি খুব মজার কোন কথা শুনেছেন। “...কি বললা? আমারে পাঙ্গাশ খাওয়াবা? পাঙ্গাশ তো আমি খাইনা। হা হা হা...”। পাঙ্গাশ মাছ তিনি খান না এ ব্যাপারটার মধ্যে হাসির কি আছে বুঝলাম না। ভদ্রলোক মাথা উপরের দিকে হেলিয়ে হা হা করে হাসতে লাগলেন। হঠাৎ কি হল কে জানে। তিনি লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে গেলেন। রাস্তার পাশে বসে ওয়াক ওয়াক করতে থাকলেন। আশে পাশ থেকে লোকজন ছুটে এল তার দিকে। ডায়মন্ড হোটেলের দশ বার বছরের ওয়েটারটা ছুটে এল। ভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “ওই একটা মাম পানি দে...বড় বোতল... কুইক!” প্রচন্ড আওয়াজ করে বমি করতে থাকলেন তিনি। আমি উপরের দিকে তাকালাম। যা ভেবেছিলাম তাই। তাকিয়ে আছে সে। মুখ কিঞ্চিত ফাঁক। ঘাড় যথারীতি একদিকে কাত করা। পাঙ্গাশ মাছ না খেলেও ভদ্রলোক কি খেয়েছেন তা বুঝতে অসুবিধা হলনা।
সত্যজিত রায় তাঁর কর্ভাস গল্পে একটা বুদ্ধিমান কাকের গল্প বলেছিলেন। আমাদের দেশেও কোথায় জানি কাককে মানুষের মত কথা বলতে কেউ শিখিয়েছে শুনেছিলাম। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কাককে বুদ্ধিমান পাখির দলে ফেলব। মানুষের সাথে যে ফাজলামিটা তারা করে সেটা ইচ্ছা করেই করে বলে আমার ধারণা। বেশ কয়েকদিন আমি হুড ফেলে ডায়মন্ড হোটেলের সামনে দিয়ে গেছি। আমাকে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। আমি যেটা করি তা হল হোটেলটা পার হবার সময় আমি উপরের দিকে তাকাতে তাকাতে যাই। তারা সেখানেই ইলেক্ট্রিক লাইনে বসে আকাশ বাতাস দেখতে থাকে। এমন একটা ভাব করে যেন আমাকে দেখতেই পায়নি। আমার ধারণা আমি যে তাদের লক্ষ্য করছি এটা তারা ভালই বুঝতে পারে। আমার প্রতি তাদের ইন্টারেস্ট কম হবার সেটা একটা কারণ হতে পারে। কিংবা কে জানে হয়ত বিষ্ঠা ত্যাগের সময় কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে এ ব্যাপারটায় তারা লজ্জাবোধ করে। লজ্জাবোধ করাটাই স্বাভাবিক। তারা বেছে নেয় এমন কাউকে যে তাদের লক্ষ্য করছেনা। তারপর দেখেশুনে নিঃশব্দে মিশন কমপ্লিট করে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়াও হল, মনটাও হালকা হল। মানুষ কাককে নিয়ে কিছু ভাবুক না ভাবুক, কাকরা ভাবে। “ত্যাগের আনন্দই প্রকৃত আনন্দ“, মনুষ্য রচিত এই বাণীটা নিয়ে কাক সমাজ ভেবেছে এবং এটা তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয় বলেই আমার ধারণা।